সমাজে দৃশ্যমান অদৃশ্যমান বিভিন্ন নিয়ম কানুন, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও নানাবিধ প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান। সমাজ স্বয়ং সৃষ্ট কোনো গোষ্ঠী নয়, বরং এটি একটি মানব সৃষ্ট সামাজিক গোষ্ঠী। চিন্তা ভাবনার পার্থক্যের কারণে সমাজ কথাটি একেক জনের কাছে একেক ভাবে সমাদৃত হয়ে থাকে। সুশীল সমাজের কাছে যেটা গভীর এবং অভিনব ভাবনার ব্যাপার, সাধারণ জনমনে সেটা গতানুগতিক। চিন্তার নিয়ন্ত্রণে মানব মন ও মস্তিষ্কের বিক্রিয়ার প্রতিফলন হচ্ছে বর্তমান সমাজব্যবস্থা। এই সামাজিক গোষ্ঠীকে পরিচালনা করার জন্য বিশিষ্ট নামধারী এক দল প্রতিনিধি প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে। যাদের হাত ধরে অতীত কাঠামো এর ওঠা নামা হয়ে থাকে। কখনো বা সেই সম্ভাবনাকে অবহেলা করে সমাজ কাঠামো নিজ অবস্থানে অনড় থাকে। তাই হয়ত চারিদিকের এই অনড়কে নাড়া দেয়ার জন্য চিন্তার জগৎ এ পরিবর্তন আনা অতীব জরুরি। তবেই সমাজ পরিবর্তন এর মুখ দেখবে।
সমাজ ব্যবস্থাকে সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকÑ এই চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেখানে অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থায় 'অর্থই অর্থ আনে' আবার 'অর্থই অনর্থের মূল'। সামাজিক সমাজব্যবস্থায় 'দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ' আবার একই সাথে সমান ও সমতার পার্থক্য প্রগাঢ়, সামাজিক শ্রেনীর আধিক্যও লক্ষ্যনীয়। রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থায় জনগণের মুখপাত্র হয়ে সমঅধিকার নিশ্চিত করতে যেমন সচেষ্ট, তেমনি 'জোড় যার মুল্লুক তার' ভাবধারাও বিরাজমান। ক্ষমতার চেয়ারে বসে বাম পাশে সমতার কথা বলে ডান পাশেই কর্মক্ষেত্রে আত্মীয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার সংবাদও অহরহ ঘটে। সাংস্কৃতিক সমাজব্যবস্থা একই সাথে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবশ্যক। সংস্কৃতি একই সাথে বিশ্ব সমাজব্যবস্থাকে নিজ সমাজে এনে বিশালতার জানান দেয়, আবার নিজ সমাজব্যবস্থাকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করে বিশালতা ছিনিয়ে আনে। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থা নিয়ে জনমনে নানা অসন্তোষ। কোথাও বাজারের চড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ে বাকবিতÐা, কোথাও চাকরির বয়স নিয়ে অসন্তোষ, কোথাও বা পোশাকের স্বাধীনতা চাই নামক আন্দোলনের জোয়ার। গোড়া থেকে মূলোৎপাটন করা সম্ভবত না হলেও চেষ্টা করে যেতে হবে পরিবর্তনের। সমাজ যারা পরিচালনা করে জনপ্রতিনিধি হয়ে তারা যেমন জনগণের মাধ্যমে আসে, তেমনি তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে শতভাগ জনগণের কাছেই। এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জনকল্যাণমূলক কাজে সরকারি সহযোগিতার নিশ্চয়তা হতে হবে শতভাগ। সিন্ডিকেট এর কোনো সুযোগ থাকবে না।
মৌলিক চাহিদা গুলো যেমনÑ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সকল ক্ষেত্রে সচেতনতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি থাকতে হবে। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে নিষ্ক্রিয় প্রশাসন সমাজের সাধারণ মানুষ চায় না। শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তনে দিনের পর দিন অভিভাবকের আন্দোলনও তারা চায় না। যেহেতু জনগণের জন্য সমাজ, তাই সমাজের জন্য গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারাও হবে একটি পরিবর্তন। তাই চিন্তাধারায় পরিবর্তন এনে পরিবর্তনকে নিয়ে সমাজ গড়তে হবে। কারণ চিন্তা চেতনা মানুষের আচরণ ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে -
১. শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। গতানুগতিক পরীক্ষা নির্ভর না করে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখাতে হবে। সমালোচনার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে এবং গবেষণাধর্মী কাজের জন্য সুযোগ সৃষ্টিসহ দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। নাহলে সকল দেশীয় মেধাবী বিদেশি ব্রান্ডে পরিণত হবে।
২. মিডিয়া জগতের সুস্পষ্টতা থাকতে হবে। অনলাইন প্লাটফর্মগুলোকে একই সাথে চিন্তা ও গঠনমূলক সমালোচনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ এর মাধ্যমে দেশের এক প্রান্তের মানুষের চিন্তা অন্য প্রান্তে পৌছে যাবে।
৩. নেতৃত্বের সংজ্ঞা শুধু প্রবীণদের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে তরুণদের মাঝেও ছড়িয়ে দিয়ে দায়িত্বশীল নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। অনভিজ্ঞতা নিয়ে তাচ্ছিল্য করা অনুচিত। কারণ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেলে সেও তার অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে।
৪. জনমনে চিন্তাচেতনার পরিবর্তন আনতে হবে। আধুনিকতার সাথে তালমিলিয়ে যেমন চলতে হবে, একই সাথে অত্যাধুনিকতা এনে জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করাও অনুচিত। কারণ সবাই আধুনিক হতে পারেনি।
৫. যার অক্ষর জ্ঞান আছে সে যেনো চিন্তার জন্য হলেও জ্ঞান অর্জন করে। আর যা সে পড়বে বা জানবে, যার অক্ষর জ্ঞান নেই তাকে গল্প করে হলেও বোঝাবে। কারণ তার সন্তানও সেই সমাজের একজন। নিজে অক্ষর জ্ঞানহীন হলেও সন্তানকে মার্জিত রুচিশীল ও চিন্তাশীল প্রত্যেক পিতামাতাই দেখতে চান।
সুতরাং সমাজকে পুনরায় গঠন করা তখনই সম্ভব হবে যখন সমাজের মানুষের চিন্তাভাবনা সুগঠিত হবে এবং প্রতিনিধিরা সহনশীলতার সহিত মতামতের ভিত্তিতে কাজ করবে। যদি সীমিত কয়েক জনের কথায় সমাজ পরিচালিত হয়, তবে চিন্তাও হবে সীমাবদ্ধ। তাই আসুন পরিবর্তিত হই, সমাজ পরিবর্তনে সহায়তা করি।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়