ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার এখনই সময়

অমিত হাসান

প্রকাশিত: ১৯:০৬, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার এখনই সময়

আমাদের দেশে মাদকাসক্তি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শহর থেকে গ্রাম, অভিজাত এলাকা থেকে বস্তি, অলি থেকে গলি সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়ছে মাদকের বিষাক্ততা। আবার কোথাও কোথাও প্রকাশ্য দিবালোকেই চলে মাদকসেবন। মূলত যে সকল দ্রব্য গ্রহণের ফলে মানুষের শারীরিক মানসিক অবস্থার নেতিবাচক অবনতি ঘটে এবং এই দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পর্যায়ক্রমে তা বৃদ্ধি পায় তাই মাদক। মাদকের সহজলভ্যতা, হতাশা, একাকীত্ব, বিষণœতা, কৌতুহল, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, অপসংস্কৃতি, প্রেম চাকরিতে ব্যর্থতা বা বেকারত্বসহ বিভিন্ন কারণে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে হাজারো মানুষ। যার মধ্যে একটা বড় অংশ হচ্ছে কিশোর এবং তরুণ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বাংলাদেশে কয়েক মিলিয়ন মানুষ মাদক গ্রহণ করে এবং মাদকের পেছনে প্রতি বছর খরচ হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

বর্তমানে মাদক বিক্রেতাদের মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে দেশের কর্মক্ষম যুব সমাজ। যাদের হাত ধরে জাতি আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মানে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই মুহূর্তে আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটা বড় অংশ সর্বনাশা মাদকের শিকার। আজকাল এসকল মাদকাসক্তদের দ্বারা সমাজে  চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, গুম, খুনের মত ঘটনা অহরহ ঘটেই চলেছে। যা সমাজ রাষ্ট্রকে ভয়াবহ সতর্কবার্তা দিচ্ছে। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ভৌগোলিক নানা কারণে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না মাদকের অবাধ সরবরাহ। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য ধরা পড়ে তা বিক্রি হওয়া মাদকের মাত্র ১০ শতাংশ।

মাদক গ্রহণের কারণে মাদকাসক্তরা নানা ধরনের জটিল রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তির কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জীবনীশক্তি ধ্বংসকারী ইয়াবা সেবনকারীরা অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলছে চিরতরে। বিশেষজ্ঞদের মতে মাদকাসক্তদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও অন্য যে কারো তুলনায় বেশি। তাছাড়া মাদকাসক্তদের অনেকেই ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য প্রয়োগ করে। আর সেজন্য অনেক সময় একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করে যার ফলে এইডসের মত সংক্রামক রোগগুলো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মাদকের সাথে এদেশের মানুষের পুরনো সম্পর্ক রয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার সূচনীয় পরাজয়ের পর ইংরেজরা চলে আসে বাংলার শাসন ক্ষমতায়। তারপর একের পর এক বাঙালি জাতির উপর চলতে থাকে অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার। এক পর্যায়ে চির সবুজ এই বাংলার কৃষকদের প্রতি নজর পড়ে ইংরেজদের। সুযোগ পেয়েই ভারতবর্ষের উর্বর মাটিতে শুরু হয় আফিমের চাষাবাদ। কৃষকদেরকে দিয়ে জোর করিয়ে আফিম চাষ করিয়ে তা বিক্রি করা হতো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাছাড়া এদেশেও প্রকাশ্যে দোকান দিয়ে অবাধে বিক্রি হতো আফিম। ঐতিহাসকদের ধারণা বঙ্গদেশের সাথে আফিমের সম্পর্ক আরো পুরনো। পর্তুগিজ পর্যটক পাইরেসের লেখায় আফিমের উল্লেখ পাওয়া যায়। বস্তুত সে সময়ে মাদকের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল কেবলমাত্র ধনী শ্রেণীর লোকেদের এবং তা সাধারণের মাঝে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও ছিল কম।

ইংরেজ আমলে মাদকের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন ৪৭ দেশ ভাগের পর নানা সময়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে শুরু করে। এরপর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে বিভিন্ন সময়ে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিভিন্ন নীতিমালা আইন প্রণয়ন করা হয়। সরকারের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও মাদকের বিরুদ্ধে নানা সময়ে অভিযান পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। তাই জাতিকে মাদকের ভয়াল থাবা থেকে বাঁচাতে প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে। মাদকের সহজলভ্যতাসহ যে কারণগুলো দেশে মাদক বিস্তারের জন্য সহায়ক মিকা পালন করছে সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রæ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সীমান্ত এলাকা এবং যে পথগুলো দিয়ে মাদক আসে সে পথে নজরদারি আরো বৃদ্ধি করতে হবে। একইসাথে মাদকের সাথে সম্পর্কিত মামলাগুলো দ্রæ নিষ্পত্তি করার মাধ্যমে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া কিশোর-কিশোরী এবং অভিভাবকসহ সবার মাঝে মাদকের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, এর কুফল সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। সবার মাঝে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত মাদকবিরোধী সভা, সেমিনার, র্যালি আয়োজন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে গণমাধ্যমে একাধারে গণসচেতনতামূলক ভিডিও বার্তা দিতে হবে। সেই সাথে চাকরি, ভর্তিসহ সর্বত্র ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাছাড়া সামজিক ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেও নতুন প্রজন্ম নিজেদেরকে মাদক থেকে দূরে রাখতে পারে।

একটা দেশের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে সে দেশের যুবসমাজ। আর জাতি ধ্বংসে যুবসমাজকে মাদক দিয়ে যে আক্রমণ করা হচ্ছে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কিশোর-তরুণদেরকে মাদক থেকে দূরে রাখতে পরিবার,সমাজ রাষ্ট্রের প্রত্যেক সুনাগরিকের উচিৎ তাদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। তরুণদের জন্য সুস্হ বিনোদনের পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা। বেকারদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা, পরিবার সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা। একইসাথে মাদকের সরবরাহ বন্ধ করতে সীমান্তসহ মাদকের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় এমন জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে নজরদারি বাড়াতে হবে। সর্বোপরি সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি,পারিবারিক সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা এবং দেশপ্রেম জাগ্রত করার মাধ্যমে জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর এখনই সময়। তাই আসুন মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ গড়ে তুলি, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ি।

 

শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

×