ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

শিশির স্নাত হেমন্তে নবান্নের বার্তা

এস এম মুকুল

প্রকাশিত: ২০:১১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

শিশির স্নাত হেমন্তে নবান্নের বার্তা

-

হেমন্ত আসে ধীর পায়ে শিশির স্নাত শীতল পরশ আলতো গায়ে  মেখে। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে সূচনা হয় নবান্ন উৎসব। ঋতুর রানী হেমন্তে নতুন ফসলের ম ম গন্ধে প্রকৃতিতে চলে আসে প্রশান্তির ভাব। ভোরের কুয়াশায় ফসলের মাঠে, গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমে। নতুন ধানের ম ম গন্ধে  ফসলের মাঠে ওড়াউড়ি করে প্রজাপতি, ভ্রমর আর ঘাসফড়িংয়ের দল। হেমন্তে ফোটে ফুল শিউলি। দোলনচাঁপাও সুবাস ছড়ায় চারদিকে। হেমন্তের বৈচিত্র্য এখন অন্যরকম। ঋতুচক্রে বাংলায় কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হেমন্তকাল। এখন সকালের মিষ্টি রোদ কুয়াশা চিরে অনেকটা ধরণীতে এসে পড়ে। ভোরের শিশির বিন্দু ও রোদের মিষ্টি তেজ নিয়ে আসে শীতের আমন্ত্রণ।  
সবুজ ফসলের মাঠজুড়ে কাঁচাপাকা ধানের আভা ছড়িয়ে শুরু হয় অগ্রহায়ণ। হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসা হেমন্ত সবুজ-হলুদ রঙে আমনের ম ম সুবাস ছড়িয়ে দিগন্তজোড়া আনন্দ আহ্বানে কৃষক পরিবারের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেয় নতুন ফসলের বার্তা। আমাদের জাতীয় সংগীতে কবিগুরু যথার্থই বলেছেনÑ ‘ওমা অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কি দেখেছি/, ও মা কি দেখেছি মধুর হাসি...।’ সত্যিই হেমন্তে অগ্রহায়ণ মাসের আগমন বাঙালি কৃষক পরিবারে যেন সেই বার্তাই দেয়। অগ্রহায়ণ মাসে মাঠজুড়ে ধান কাটার ধুম পড়ে। ফসল তোলার কাজে ব্যস্ত সময় কাটে কৃষক-কৃষাণীর। মানব সমাজে জীবিকার প্রয়োজনে কৃষিপ্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। তখন থেকেই বিভিন্ন কৃষ্টি মেনে ঘরে ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, সেগুলোর অন্যতম নবান্ন।
নবান্নের ঋতু হেমন্তকে ঘিরে কবি-সাহিত্যিকরা লিখেছেন গল্প, কবিতা আর গান। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন- ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরেÑ এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের  দেশে’। সত্যিই কবিতার মতোই সুন্দর নবান্নের চিরায়ত এই বাংলার গ্রামীণ রূপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আজি হেমন্তের শান্ত ব্যাপ্ত চরাচরে জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার স্বর্ণশ্যাম ডানা  মেলি।’ আবহমান এই বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধি শুরু মা-মাটি-কৃষি থেকে। হেমন্ত নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুুর ঋতু। তাই বোধ হয় হেমন্তকে অনুভবের ঋতুও বলা হয়। আবার হেমন্তকে মৌন, শীতল বা অন্তর্মুখী ঋতুও বলা যায়।  প্রকৃতির হিম হিম ভাব আর হাল্কা কুয়াশায় শীতের আগমন বার্তা নিয়ে জানিয়ে ১ কার্তিক থেকেই শুরু হয়েছে হেমন্তকাল। এক হেমন্তের দুটি রূপÑ ঋতুর শুরুতে মরা কার্তিকে অভাব আর ক্ষুধার হাহাকার। আবার শেষে অগ্রহায়ণে ধানের প্রাচুর্য। প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশ যথার্থই বলেছেনÑ ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপর মাথা রেখে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে-কার্তিকের ক্ষেতে;/মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার/ চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ/তাহার আস্বাদ পেয়ে পেকে ওঠে ধান’। কবির বর্ণনা যেন প্রকৃতির প্রতিচিত্র। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। হেমন্তের অঘ্রানে কৃষকের ঘরে নতুন আমন ফসল ওঠে। এ কারণে হেমন্তকে বলা হয় নবান্নের ঋতু। অগ্রহায়ণ মাসে ফসলে মাঠে মাঠে কাঁচাপাকা অপরূপ দৃশ্য মন কাড়ে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জাতীয় সংগীতে অঘ্রানের মোহমায়ার চিত্ররূপকেই উপস্থাপন করেছেন- ‘ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা খেতে, (আমি) কি দেখেছি মধুর হাসি।...’
অগ্রহায়ণের শেষ দিন পর্যন্ত বহাল থাকবে হেমন্তের আধিপত্য। হেমন্তের প্রকৃতি হিম হিম ভাব নিয়ে কুয়াশার শীতল আভা ছড়িয়ে দেয়। হেমন্ত হলো ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু। শরৎকালের পর এই ঋতুর আগমন। শীতের আগাম আভাস দেয় বলে তাকে শীতের পূর্বাভাস ঋতুও বলা হয়। প্রকৃতির মায়ায় নানা রঙ-রূপের বৈচিত্র্য নিয়ে আগমন করে বলে গ্রাম-বাংলায় এই ঋতু উৎসবের ঋতু বলেও পরিচিত। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী পূর্বাভাস পাওয়া যায় হেমন্তের শুরু থেকেই। কৃষকের কষ্টের সম্পদ ফসল তখন মাঠজুড়ে কাঁচাপাকা ধানের বর্ণিল অপরূপ সাজে কৃষকের মনে আনন্দের দোলা দেয়। এই শোভা দেখে কৃষকের মন নেচে ওঠে আনন্দে। বাড়ির আঙিনা-উঠোন পরিষ্কার করে সোনার ফসল ঘরে তোলার প্রস্তুতি নেয় কৃষক-কৃষাণীরা। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষকবধূ মনের আনন্দে ধান শুকায়। প্রতি ঘর থেকে ভেসে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। বাড়ির চারপাশে লাউ, শিম, মুলা, বেগুনসহ সবজিগাছগুলো সতেজতায় প্রাণজাগায় প্রকৃতির সবুজ অঙ্গনে। ভোরের হাল্কা কুয়াশার পরশ, সকালের সোনারোদ, দুপুরের ঝকঝকে উচ্ছল রদ্দুর, বিকেলে হিমেল আভা প্রকৃতির সবকিছুতে যেন আনন্দের নতুন বার্তা ভেসে বেড়ায়। এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো ধান উৎপাদনের ঋতু হেমন্ত দিয়ে। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ বেড়ে ওঠে শরতে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়। এভাবেই হেমন্ত আসে কৃষকের দুয়ারে ফসলের হাসি নিয়ে। এ ঋতুতে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম, বকফুল ফুটে প্রকৃতিকে করে তোলে অনিন্দ্য রূপময়ী।
লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

×