ম্যাকআইভারের ভাষায় আমরা যা তাই সংস্কৃতি। অর্থাৎ আমরা নিয়মিত যা করি এবং আমাদের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থাই হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি। নাগরিকদের রাজনীতি চর্চা দেখে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বরূপ অনুধাবন করা যায়। দেশের অবস্থান, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি দ্বারা তার রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্ধারিত হয়ে থাকে যা দেশ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। রাজনীতি একটি জাতির অগ্রগতির ভিত্তি। আদর্শিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হলো সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক কাঠামো ও সংস্কৃতি। কিন্তু আজকের দিনে আমাদের সমাজে রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রায়শই যে চিত্রটি উপস্থাপন করে তা একটি নেতিবাচক ধারণা দেয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই বেহাল অবস্থায় পরিবর্তন আনতে হলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, ইতিবাচক মানসিকতা ও কার্যকর নেতৃত্ব প্রয়োজন।
বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আজ এক বিপদজনক মোড়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যমান এ সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে আছে অহেতুক দলবাজি, চাটুকারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক দলীয়করণ, প্রশাসনিক কাঠামোর অনিয়ম, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সমাজের কল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রায়ই দেখা যায় রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতাকে নিজের আয়ত্তে রাখতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চক্রান্ত করেন এবং বিরোধী দলগুলোকে সুযোগের বাইরে রাখেন। এর ফলে একদলীয় মনোভাব, বাকস্বাধীনতার সংকোচন এবং জনগণের মৌলিক অধিকারগুলোর অবহেলিত হচ্ছে।
এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবটি হলো সাধারণ জনগণের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে এবং নিজেদের সমস্যাগুলোর সমাধানে রাজনীতির উপর নির্ভর করতে চায় না। ফলে, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যখাতসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ খাতেই প্রভাব পড়েছে। আর্থিক খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম, বিচার ব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্ব এবং শিক্ষায় দলীয় প্রভাব সমাজে চরম অসাম্য ও অবিচার সৃষ্টি করেছে। এতে সাধারণ জনগণের জীবনমান উন্নতির পরিবর্তে আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।
একটি স্থিতিশীল সমাজ গড়তে এবং দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে নতুন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এ সংস্কৃতির মূলমন্ত্র হবে সবার সমান অংশগ্রহণ ও ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। প্রয়োজন একটি অংশগ্রহণমূলক ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে প্রতিটি মতামতকে শ্রদ্ধা করা হবে এবং সকল শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও স্বার্থের প্রভাবমুক্ত একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই লক্ষ্যে, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, সেবার মানসিকতা এবং নৈতিকতার প্রতি অঙ্গীকারে দৃঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন।
এমন এক নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যেখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং পক্ষপাতিত্বের কোনও স্থান থাকবে না। বরং এসব করতে সবাই লজ্জা ও ভয় পাবে। এ জন্য রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের মধ্যে সৎ হতে হবে এবং তাদের প্রত্যেকটি কাজ জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিচালিত করতে হবে। সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সকলের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিরোধী দলকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা এবং সবার মতামতকে সম্মান জানানো এই সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে হবে। একদলীয় মনোভাব ও সিদ্ধান্ত চাপানোর প্রবণতা বন্ধ করে অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। নাগরিকরা যেনো অন্ধ সমর্থন না দিয়ে সচেতন হয়ে দেশের জন্য কল্যাণকর প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে সে ধরনের সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের আদর্শগত শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। এই শিক্ষা ছাত্র জীবন থেকেই শুরু হওয়া উচিত, যেন পরবর্তীতে তারা জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্বের গুরুত্ব বোঝেন। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে ভবিষ্যৎ নেতাদের গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনার বিকাশ ঘটানো যেতে পারে। নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরিতে যুব সমাজের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উদ্যম, সৃজনশীলতা এবং পরিবর্তনের ইচ্ছা প্রবল থাকে। এদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে তারা উন্নয়নমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভ‚মিকা রাখতে পারে এবং নেতিবাচক প্রবণতাগুলো পরিবর্তন করতে সহায়ক হতে পারে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা। নীতি-নির্ধারকদের কর্মকাÐের উপর জনসাধারণের সহজ প্রবেশাধিকার থাকতে হবে এবং জনসাধারণের কাছে তাঁদের কাজের প্রতিটি দিক পরিষ্কার থাকতে হবে। এ ধরনের সংস্কৃতি গড়ে তোলা গেলে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। গণমাধ্যম রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণের কাছে প্রকৃত সত্য তুলে ধরার পাশাপাশি নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়া সঠিকভাবে এই দায়িত্ব পালন করলে জনগণ নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবে এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়বে।
পরিশেষে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশ ও সমাজের মঙ্গলের জন্য একটি শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক কাঠামো অপরিহার্য। দেশপ্রেম, সেবার মানসিকতা এবং নৈতিকতার ভিত্তিতে গঠিত একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি কেবল জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে না, বরং একটি উন্নত, সুশৃঙ্খল এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনেও ভ‚মিকা রাখবে।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়