ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

আমাদের শিশু সন্তান ও একজন মুনতাহা

মো. মাসুদ হোসেন

প্রকাশিত: ২১:১৬, ১২ নভেম্বর ২০২৪

আমাদের শিশু সন্তান ও একজন মুনতাহা

মূল্যবোধ নীতি নৈতিকতার চর্চার অভাবে দেশে দিন দিন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাÐের বৃদ্ধি হচ্ছে এরই অংশ হিসেবে আমাদের দেশে একের পর এক ঘটছে শিশু ধর্ষণ কিংবা হত্যাকান্ডের মত ঘটনা শুধু ধর্ষণ করে ক্ষান্ত থাকছে না পাষÐরা, ধর্ষিত শিশুটিকে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করছে না বাড়ির আঙিনায়, মাদরাসা, বাসে-লঞ্চে, পথে-ঘাটে-মাঠে বা স্কুলের চার দেয়ালে- শিশুর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কোথাও নেই আজ

শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলছে এসবই তে জড়িয়ে আছে বড়দের স্বার্থ গত নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাটে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলার ফাঁকে হারিয়ে যাওয়া পাঁচ বছরের শিশু মুনতাহা শিশু মুনতাহার নিখোঁজ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফলে মুনতাহার সন্ধান দিতে পারলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক জুড়ে আসে পুরস্কারের ঘোষণা

কেউ ঘোষণা দেন, স্বর্ণের চেইন উপহার দেয়া হবে, কেউ লাখ টাকা সহ বিভিন্ন অংকের আর্থিক উপহার আবার কেউ দেবেন চাকরি সবারই একটি আশা, মুনতাহা ফিরে আসুক সবার মাঝে কিন্তু সে ফিরে এলেও যেভাবে এসেছে, তা সবাইকে স্তব্ধই করে দেয় গোটা দেশের মানুষ মুনতাহার সন্ধান করে বেড়ালেও বাড়ির পাশের ডোবায় পুঁতে রাখা হয়েছিল তার লাশ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের দেওয়া সূত্র মতে, প্রায় চার মাস আগে মুনতাহার গৃহশিক্ষিকা হিসেবে শামীমা বেগম মার্জিয়া পড়ানো শুরু করেন

তবে মুনতাহার পরিবারের সদস্যদের না জানিয়েই তিনি পড়াতে আসতেন না পরে মুনতাহার পরিবার তাকে পড়াতে মানা করে দেয় এতে ক্ষুব্ধ হন শামীমা এর মধ্যে মুনতাহাদের পরিবারে কিছু কাপড় হারানোর ঘটনা ঘটে সেসব কাপড় শামীমাদের বাড়িতে পাওয়া যায় চুরির অপবাদ দেওয়া হয় তাকে

সেদিন অসুস্থতার কারনে ঘুম থেকে উঠতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে ফ্রেস হয়ে সকাল ৯টায় ফেসবুকে ঢুকে ব্রাউজিং করছিলাম আমি টাইমলাইনের চতুর্থ পোস্টে দেখলামশিশু মুনতাহাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে এমন ক্যাপশনের সাথে ছিল ফুটফুটে হাঁসিমাখা শিশু মুনতার ছবিখানাও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু সামনে যেতেই দেখি ভিন্ন চিত্র

কাঁদামাখা একটি লাশের ছবি দিয়ে পোস্ট করা ক্যাপশনে ছিল- মুনতাহার প্রকৃত খুনিদের দৃষ্টান্ত শাস্তি দাবি করছি এমন পোস্ট দেখে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যদিও আমি ফেসবুকের সবার পোস্ট সচরাচর বিশ্বাস করি না যতক্ষণ না পর্যন্ত কোন সংবাদমাধ্যমের পেজে না দেখি তারপরও উপরোক্ত পোস্টগুলো দেখে কিছুটা স্তব্ধ হয়ে যাই এর একটু পরেই নজর পড়লো দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকার ফেসবুক পেজে চারঘন্টা পূর্বে আপলোড দেয়া মুনতার হত্যাকান্ডের নিউজ নিউজটা দেখেই স্বাভাবিকভাবে মনটা বিষাদময় হয়ে গেল নতুন একটা দিন শুরু হলো ফুলের মতো একটা শিশুর নির্মম মৃত্যুর খবরের সাক্ষী হয়ে

তখনই হারিয়ে যাই আমার বাস্তবিক জীবনে কারন আমারও ফুটফুটে দুইটি কন্যাশিশু রয়েছে তাদের মধ্যে বড়জনকে প্রতিনিয়ত স্কুল কিংবা নানা কারনে বাইরে যেতে হয় একা একা অন্যজন তো বেশিরভাগ সময়ই প্রতিবেশীদের কাছাকাছি থাকছে

জানা মতে, কানাইঘাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরদলের ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে বছরের কন্যা শিশু মুনতাহাকে সারাদিন খোঁজাখুঁজির পর ফিরে না আসায় থানায় জিডি করে পরিবার নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর, ১০ নভেম্বর রোববার ভোররাতে প্রতিবেশী আলিফজান বিবি লাশ ডোবা থেকে পুকুরে ফেলার সময় হাতেনাতে আটক করা হয় তাকে

ঘটনায় হতবাক এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী আগুন দিয়েছে ঘাতক পরিবারের বাসায় ঘটনায় শামীমা বেগম মার্জিয়া তার মা আলিফজান বেগম, তাদের প্রতিবেশী ইসলাম উদ্দিন নাজমা বেগমকে আটক করেন পুলিশ আজ যারা শিশু, ভবিষ্যতে তারাই হবে দেশ গড়ার কারিগর একটি শিশু পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে স্নেহ, ভালোবাসা, আদর-সোহাগ, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আর সুন্দরের প্রত্যাশা নিয়ে শিশুকে দেখলেই কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে সবার

সেই শিশুর জীবনই যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে গোটা সমাজই বিপদের সম্মুখীন হবে একসময় তবে শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন কন্যাশিশুরা প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজের কিছু নরপিশাচদের ছোবলের শিকার হচ্ছেন কোন না কোন মেয়ে এর থেকে রক্ষা পাননি কন্যাশিশুরাও তারা পরিবার পরিবারের বাইরে বিভিন্ন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে অহরহ

পরিবারের কেউ না কেউ, আত্মীয় স্বজন কিংবা পাড়া প্রতিবেশীর দ্বারা যৌন হেনস্থা ধর্ষণ নয়, নৃশংস হত্যার শিকার হচ্ছে আমাদের কন্যা শিশুরা অথচ শিশুরা এসবের কিছুই বোঝেন না বুঝে ওঠার আগেই দুনিয়ার কিছু হিংস্র মানবজাতির নৃশংস কর্মকাÐ তাদের সুন্দর পৃথিবী দেখার স্বাদ এক নিমিষেই বিলীন করে দেয়

২০২২ সালে ঘটে যাওয়া চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেডে অপহরণের পর পাঁচ বছরের শিশু আয়াতকে হত্যা করে ছয় টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনা সমাজে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে আর্তনাদে ভারি হল চট্টগ্রামের বাতাস আয়াতের ছয় টুকরার মধ্যে প্রথমে দুই টুকরা পা উদ্ধার করলেও মা-বাবার সেই ছোট্ট আয়াতের মাথাটি দেখার জন্য আর্তনাদ করেন

এছাড়াও এর আগে নওগাঁয় ইব্রাহিম নামে ছয় বছরের এক শিশু নিখোঁজ হয় এক পর্যায়ে শিশু ইব্রাহিমের বাবার শোবার ঘরে জানালার পাশে একটি চিঠি পাওয়া যায় চিঠিতে বলা হয়- একটি সিম এবং একটি মোবাইল কিনে বাবুর দোকানের সামনে চুলার মধ্যে রেখে যেতে একই সঙ্গে আরও ছয় লাখ টাকা প্রস্তুত রাখতে বলা হয়

এরপর ২৬ নভেম্বর শিশুর বাবাকে একটি অজ্ঞাত মুঠোফোন থেকে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করা হয় খুনি বুলবুলের দোকানে গিয়ে শিশু ইব্রাহিম পাঁচ-ছয়টি বেলুন ফাটায় শিশুটিকে দোকান থেকে চলে যেতে বলা হলেও চলে না গিয়ে আরও বেলুন ফাটাতে চায় তাই রাগ করে শিশুটিকে গলা টিপে হত্যা করে চা স্টলের পিছনে ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে বস্তাবন্দী করে পুঁতে রাখে

১৮ নভেম্বর বালতিতে করে শিশুটির অর্ধগলিত মরদেহ পাশে আত্রাই নদীতে পুঁতে রেখে একটি বড় কংক্রিটের বস্তা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখে ইব্রাহিম, আয়াত মুনতাহার মত অসংখ্য শিশুকে হত্যাকান্ডের মত এমন কাজ আমাদের সমাজে হচ্ছে প্রতিনিয়ত বড়দের সাথে শত্রæতার জের ধরেই সমাজের বিভিন্ন প্রতিশোধের বলি হচ্ছেন অনেক মা বাবার আদরের অবুঝ শিশুকে

এসব ঘটনায় নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা কতটা বিচার পেয়েছে, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ পত্রিকার পাতা ওল্টালেই এর কিছু না কিছু আমরা দেখতে পাই তবে বারবার ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো এটাই প্রমাণ করেছে, আমাদের বিচার-প্রক্রিয়া এবং আইনি পরতার দুর্বলতার কারণে উপযুক্ত শাস্তি থেকে বেঁচে যায় অপরাধীরা এই পার পেয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সমাজে আরো অনেককে একই ধরনের অপরাধ সংঘটনে সাহিত করে

আগামীর শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে পরিবারের সদস্যদের তাদেরকে স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে ঘরে থাকার সময়ে যতœশীল হতে হবে শিশুর সামান্য ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো ব্যক্তির কাছে যেতে না দেয়াই ভালো শিশুকে বাসায় একা রেখে কোথাও যাওয়া উচিত নয় যথা সম্ভব মেয়ে শিশুকে স্কুলে আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে মা বাবার মিকা থাকতে হবে ব্যাপক সেই সাথে ধর্ষণ রোধে মনিটরিং বা নজরদারি জোরদার করতে হবে আমাদের সমাজের সকল স্তরের মানুষের

পরিবারকে তাদের সন্তানের প্রতি যতœশীল হতে হবে মানুষের ভেতরে নৈতিকতাকে জাগ্রত করতে হবে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মাঝে নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে নৈতিকতার সঠিক চর্চা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে পারে তবে কন্যা শিশুর পাশাপাশি ছেলেশিশুকেও ধর্ষণ যৌন হয়রানিবিরোধী মূল্যবোধ শেখাতে হবে

যেন বড় হয়ে ভবিষ্যতে সে ধরণের আচরণ থেকে বিরত থাকে সবশেষে শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে সমাজের

লেখক : সমাজকর্মী

 

 

×