গণমাধ্যম হলো সমাজের নির্ভরযোগ্য আয়না, যা প্রতিটি ঘটনার বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও সত্যকে তুলে ধরে। কিন্তু আজকের সময়ে, গণমাধ্যম যেন তার আদর্শ থেকে সরে যাচ্ছে। জনপ্রিয়তা ও ভাইরাল কন্টেন্টের মোহে অনেক সংবাদমাধ্যমই বস্তুনিষ্ঠতার মূল নীতিকে ত্যাগ করছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তার এবং ভাইরাল হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা সাংবাদিকতাকে এক নতুন দিকনির্দেশনায় ঠেলে দিয়েছে, যেখানে সত্যের চেয়ে আকর্ষণীয়তা এবং চটকদারতার মূল্য বেশি। এমন অবস্থায় গণমাধ্যম যে সমাজের দায়িত্বশীল অংশ, সে কথা যেন ভুলতে বসেছে।
সা¤প্রতিক সময়ে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেকোনো ঘটনা বা তথ্য যাচাই না করেই ‘ভাইরাল’ তকমা লাগিয়ে দ্রæত জনগণের সামনে হাজির করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় বহু ভিত্তিহীন তথ্য ও মিথ্যা গুজব ছড়ানো হয়েছিল। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম এমনকি বলেছিল যে, গরুর গোবর বা নির্দিষ্ট ধরনের ভেষজ পান করে করোনা প্রতিরোধ করা যায়।
এই ভুল তথ্য জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এমনকি অনেক মানুষের জীবন বিপন্ন হয়। একইভাবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সামাজিক সংঘাতের ক্ষেত্রে অর্ধসত্য সংবাদ পরিবেশন করা যেন একধরনের প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়েছে। চটকদার শিরোনাম ও ভাইরাল কন্টেন্টের কারণে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। ভাইরাল সাংবাদিকতার এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে।
জনপ্রিয়তার লোভে সংবাদমাধ্যম যখন নৈতিকতা ও সততা থেকে বিচ্যুত হয়, তখন তা সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে এবং গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয়। একসময় যে গণমাধ্যম সমাজের আদর্শ স্থাপন করত, জনসাধারণের মঙ্গল চিন্তা করত, আজ সেই গণমাধ্যমই আস্থার সংকটে ভুগছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন বর্তমান গণমাধ্যমগুলো সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা ও ভাইরাল হওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগী।
এই পরিসংখ্যান আমাদের জন্য গভীরভাবে চিন্তার বিষয়। গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস পাওয়া মানেই সমাজে সত্যের স্থান সংকুচিত হয়ে পড়া। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের প্রয়োজন গণমাধ্যমের মৌলিক দায়িত্বের প্রতি ফিরে আসা। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মাধ্যমে গণমাধ্যমে আস্থা ফিরিয়ে আনাই একমাত্র পথ। প্রত্যেক সংবাদকর্মীর বোঝা উচিত, তাদের কাজ শুধু খবর প্রচার নয়, বরং সমাজের প্রতি একটি দায়িত্ব পালন। এই দায়িত্ব হলো প্রকৃত তথ্য সরবরাহ করে সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। একইসাথে, তাদের দায়িত্ব হলো গুজব ও বিভ্রান্তির স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে সঠিক ও তথ্যবহুল সংবাদ পরিবেশন করা।
ভাইরাল সাংবাদিকতা থেকে বেরিয়ে আসার কিছু কার্যকরী উপায় রয়েছে। প্রথমত, সংবাদ পরিবেশন করার আগে প্রত্যেকটি তথ্যের যাচাই অত্যন্ত জরুরি। এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, প্রচারিত সংবাদ জনমনে সঠিক প্রভাব ফেলছে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। দ্বিতীয়ত, সংবাদ পরিবেশনের সময় এমন শব্দ ও ভাষার ব্যবহার করতে হবে যা শুধু জনপ্রিয়তার জন্য নয়, বরং সত্য ও দায়িত্ববোধের প্রতিফলন ঘটায়।
তৃতীয়ত, সংবাদমাধ্যমের প্রতিটি সাংবাদিককে নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নৈতিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতার আদর্শের সঙ্গে পরিচিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, সাংবাদিকতার স্বচ্ছতা ও পেশাগত নীতিমালার প্রতিও গুরুত্বারোপ করা উচিত, যাতে সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব আরও দৃঢ় হয়। একটি উন্নত, দায়িত্বশীল এবং বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যমই পারে সমাজকে স্থিতিশীলতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার পথে নিয়ে যেতে।
ভাইরাল সাংবাদিকতার চমক নয়, বরং বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের আলোতেই সমাজের সঠিক চিত্র ফুটে উঠতে পারে। আমরা একটি সত্যভিত্তিক সমাজ চাই, যেখানে গণমাধ্যম জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে এবং সত্যকে তুলে ধরবে এমনভাবে, যা সমাজের অগ্রগতিতে সহায়ক হবে।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়