.
প্রথম পর্বে চার বছরেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল ট্রাম্পের ‘পপুলিজম’। অভিবাসী আইন, চিকিৎসা ক্ষেত্রে জনপ্রিয় ‘ওবামা কেয়ার’সহ ডেমোক্র্যাটদের পুরনো কাজ ও উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতিগুলো ফিরিয়ে এনেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছেচল্লিশতম প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেন।
দু’হাজার ষোলো সালে রাজনীতিতে পপুলিজম টার্মটি বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হয়ে সতেরোয় ছড়িয়ে পড়েছিল। পশ্চিমা পুঁজিবাদের মুখপত্র বাঘা বাঘা সব পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হওয়ায় বিভ্রান্তিও বেড়েছিল সমান্তরালভাবে। ক্ষমতায় যেতে ট্রাম্পের মূল পুঁজি ছিল সেটাই। এসব তথাকথিত ‘তত্ত্ব’ আমদানির আসল উদ্দেশ্য বিভ্রান্তি ছড়ানো। পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার প্রচ- সংকট আড়াল করতে কিছুদিন পরপর এ ধরনের সংস্কারবাদী ফর্মুলার প্রয়োজন হয়।
উনিশশ’ বিরানব্বই সালে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ‘দ্য এ্যান্ড অব হিস্ট্রি এ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ বইয়ে তত্ত্ব দিয়েছিলেনÑ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ এবং পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় হয়েছে। শ্রেণি সংগ্রামের অবসান হয়েছে। তিনি মার্কসকে পরাজিত এবং হেগেলের ভবিষ্যদ্বাণীকে বিজয়ী ঘোষণা করে বলেছিলেন, পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্রই হচ্ছে সভ্যতার চূড়ান্ত রূপ। বর্তমান সভ্যতা সেই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষের এখন সুখের দিন শুরু হলো। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়ার জোর প্রচারে ফুকুয়ামার তত্ত্ব যতই ঝড় তুলুক, বাস্তবে দেখা গেল ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রের’ স্বর্গরাজ্যে বেশিরভাগ মানুষের জীবনে সুখের নহর বইছে না। একটা বিকল্প ব্যবস্থা অনুসন্ধান তারা করেই চলল। দু’হাজার আট থেকে চৌদ্দর অর্থনৈতিক মন্দা সেই বিকল্প হিসেবে সমাজতন্ত্র বা অন্য কোনো ফর্মে বৈষম্যহীন সমাজকেই বারবার তাদের মননে ও মগজে মূর্ত করেছে। একে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পুঁজির পক্ষে। তাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্করা থেকে থেকে তাই এমন সব ‘তত্ত্ব’ হাজির করে যা শুনলে হঠাৎ মনে হয় এরা বুঝি পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলছে। তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলছে। কিন্তু বিভ্রান্তি কাটিয়ে স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে তাকালে দেখা যাবে এর পুরোটাই অন্তঃসারশূন্য। ধূর্ততায় ভরা কিছু অর্থহীন কথামালার সমষ্টি।
‘তত্ত্বগুলো’ এসেছে বিভিন্ন ফর্মে। ধাপে ধাপে। কখনো সমান্তরালভাবে। সহস্রাব্দের প্রথমদিকে ‘ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম’ নামে একটি প্ল্যাটফরম আন্তর্জাতিকভাবে গলা চড়িয়ে ‘বিকল্প নতুন বিশ্ব’ গড়ার আওয়াজ তুলে তৃতীয় ধারা বা বিকল্প পৃথিবী গড়ার কথা বলেছিল। নয়া উদারনীতিবাদী বিশ্বায়নের বিপরীতে এরা সংহতির অখ- বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিশ্বের শোষণমূলক সংস্থাগুলোর শান্তিপূর্ণ বিরোধিতা করে সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য সমালোচনা এবং সুপরামর্শ দেওয়া এদের লক্ষ্য। কিন্তু উল্লিখিত সংস্থাগুলোর শান্তিপূর্ণ বিরোধিতা করে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির প্রতিপক্ষ এরা কীভাবে হবে, সে বিষয়ে আলোকপাত করেনি। সুতরাং লম্বা চওড়া কথার আড়ালে আসল উদ্দেশ্য যে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার ক্ষতগুলো আড়াল করা, ঢাল হিসেবে একে রক্ষা করা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
‘পপুলিজম’ও এ রকম বাগাড়ম্বরপূর্ণ চাতুরী। ডিকশনারিতে এর বাংলা প্রতিশব্দ করা হয়েছে ‘লোকরঞ্জনবাদ’। এদের বক্তব্য এরা যা করে তা সবই জনগণের স্বার্থে। বিশ্বায়নের কারণে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে যে জনগোষ্ঠী, যারা চাকরি হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত, সামাজিক গঠন বদলে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক মানুষ, যারা অসহায় ও মর্যাদা হারানোর আতঙ্কে ভোগে সব সময়, পপুলিস্টরা তাদের জন্য কাজ করে।
শুনলে মনে হয় বুঝি দুনিয়ার সব গরিব মানুষের অবস্থা পরিবর্তনের মহান ব্রত নিয়ে মাঠে নেমেছে এরা। অনেকটা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকারীদের মতো। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে আন্দোলন সংগ্রাম করে। পপুলিস্টদের কোনো রাজনৈতিক দর্শন নেই। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই। যেসব পরিবর্তনের কথা তারা বলে, সেসব বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা নেই। আবেগী কথার মধ্য দিয়ে জনগণকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা। যার বিষয়বস্তু প্রধানত তীব্র জাতীয়তাবাদ, অতীতের জন্য আক্ষেপ ইত্যাদি। পপুলিস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন বলেন, ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন।’ কিংবা হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী বা নেদারল্যান্ডসের পার্টি ফর ফ্রিডম দলের গির্ট ভিল্ডার্স মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়াতে জনগণের সামনে এমন এক খ্রিস্টীয় ইউরোপের ছবি তুলে ধরেন, যেন দলে দলে মুসলমানরা এসে ওদের দেশ দখল করে নিয়েছে। ওসব দেশের জনগণের মনে খ্রিস্টীয় ইউরোপের জন্য নস্টালজিয়া তৈরি হয়।
পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের ফলে উন্নত দেশগুলোতেও চাকরি হারাচ্ছে অনেক মানুষ। সম্পদের বৃহত্তর অংশ করপোরেশন আর ধনীদের দখলে। ‘আমরাই নিরানব্বই’ শতাংশের জীবনমান অব্যাহত খারাপের দিকে। পপুলিস্ট নেতারা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ দেখান না। দেখানো তাদের উদ্দেশ্যও নয়। কেননা, তারা এসবের সমাধান চান না।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পপুলিজমের নামে এ ভেক টার্মের আবির্ভাব হলো কেন? পপুলিজম শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দিকে আমেরিকায়। তখন এ শব্দটি যে তাৎপর্য বহন করত এখন তা বদলে গেছে। আমেরিকান একচেটিয়া তন্ত্রের বিরুদ্ধে সে দেশের কৃষকদের সম্মিলিত প্রতিবাদ আন্দোলনকে সে সময় ‘পপুলিজম’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। এখন এ শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় সরকারি, বেসরকারি, করপোরেট সুবিধাভোগী অভিজাতদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভ। যার প্রকাশ খুব ভাসা ভাসা। কারণ, যাদের কাছ থেকে এ ক্ষোভের তীব্র বহির্প্রকাশ হওয়ার কথা, সেই শ্রমিক ও কৃষকদের শক্তি কমে গেছে। বড় পুঁজির আক্রমণ থেকে ছোট পুঁজিকে রক্ষা করতে রাষ্ট্র যে ভূমিকা নিত, ফিন্যান্স পুঁজিকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে রাষ্ট্র তা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে।
এতে হস্তশিল্পী, মৎস্যজীবী, কারিগরদের মতো ছোট উৎপাদকরা বড় পুঁজির গ্রাসে চলে যাচ্ছে। ফলে, শ্রমিকরা দুর্বল হয়ে আন্দোলনের ক্ষমতা হারাচ্ছে। ‘শ্রমবাজারের নমনীয়তা’ কেড়ে নেওয়া শ্রমিকদের দুর্বল হয়ে পড়ার আরেক কারণ। এ ব্যবস্থায় শ্রমিকরা ন্যূনতম যে সুরক্ষা পেত, শ্রমআইন সংশোধনের মাধ্যমে তা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে শ্রমিকদের গঠনগত পরিবর্তনসহ শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতা কমে গেছে। একদিকে করপোরেট ফিন্যান্সিয়াল অভিজাতদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বেড়েছে, অন্যদিকে শ্রমিক কৃষকরা উৎপাদন থেকে ক্রমশ সরতে সরতে ব্যাপক দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যুগে শ্রেণি সম্পর্কের ভারসাম্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার রাজনৈতিক দলও নয়া উদারবাদে আক্রান্ত হয়ে দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ শূন্যস্থানে পপুলিস্টরা অনায়াসে জায়গা করে নেয়। ট্রাম্প সাহেব তার সামনের এ পর্বে এদের জন্য কি করেন সময়েই তা দেখা যাবে।