ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটনে বিজ্ঞান

ড. জাকিয়া বেগম

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ৯ নভেম্বর ২০২৪

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটনে বিজ্ঞান

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একজন মহাশক্তিধর স্রষ্টার সুনিপুণ হাতে তৈরি

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একজন মহাশক্তিধর স্রষ্টার সুনিপুণ হাতে তৈরি- অনেক বিজ্ঞানী এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব সৃষ্টি থেকে আরম্ভ করে পরমাণু পর্যায়ের ক্ষুদ্র কণাগুলো বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমন কিছু সত্যের সম্মুখীন হচ্ছেন, যা তাদের অবিশ্ব¦াসের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে। কিছু কিছু বিজ্ঞানী এ ব্যাপারে নিজস্ব বিশ্বাস তুলে ধরলেও মহাশক্তিধর স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে অনেকেই ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। বর্তমানে যেসব কারণ অবিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের মহাশক্তিধর একজন ঐশী শক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে ইতিবাচক করে তুলেছে, সেগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হলো।
বিশ্বব্রহ্মা- কবে এবং কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিজ্ঞান সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারলেও কে এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে এই ব্রহ্মা- সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। পূর্বে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন বিশ্বব্রহ্মা- চিরন্তন এবং এর জন্য কোনো সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু বর্তমানে ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, বিশ্বব্রহ্মা- একটা নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্টি হয়েছে। এই তত্ত্বমতে, মহাবিশ্বের সূচনা হয় অসীম ঘনত্ব এবং তাপমাত্রাবিশিষ্ট একটি বিন্দু থেকে; যা হঠাৎ স্ফীত হয়ে প্রচ- শক্তিতে বিস্ফোরিত হয় এবং সম্প্রসারিত হতে থাকে। যে সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া আজও চলমান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেহেতু বিশ্বব্রহ্মা- চিরন্তন নয় এবং এর একটা আরম্ভ আছে, তবে কে এই আরম্ভটা করল এবং এই প্রচ- বিস্ফোরণ ঘটার জন্য যে মহাশক্তির প্রয়োজন, তা কোথা থেকে এলো!
বিশ্বব্রহ্মা-ে প্রধান চার ধরনের বল বিরাজমানÑ অভিকর্ষ বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল, বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল এবং সবল নিউক্লিয় বল। এছাড়াও আছে কতগুলো মৌলিক ধ্রুবকÑশূন্যস্থানে আলোর গতি, মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, প্লাঙ্কস্ ধ্রুবক, বৈদ্যুতিক ধ্রুবক ইত্যাদি। আবার চার ধরনের বলের ধর্ম ও ধ্রুবকগুলোর নির্দিষ্ট মান ও সঠিক মাত্রা বিশ্বব্রহ্মা-ের সর্বত্র একই এবং এগুলোর সমন্বয় ও সহযোগিতায় বিশ্বব্রহ্মা- তথা মহাবিশ্ব টিকে আছে। সব ধরনের প্রাকৃতিক র্কাযকলাপ সুষ্ঠু ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে কোনো একটির সামান্য পরিমাণ হেরফের পৃথিবী তথা বিশ্বব্রহ্মা-ের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলতে পারে।
অভিকর্ষ বলের ওপর নির্ভর করেই বিশ্বব্রহ্মা-ের গঠনগত কাঠামো নির্মাণ। ছায়াপথ থেকে শুরু করে নক্ষত্র, গ্রহ ইত্যাদি মহাজাগতিক কাঠামোগুলোর নিজস্ব অবস্থানে টিকে থাকার ভিত্তিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বলটি। অভ্যন্তরমুখী অভিকর্ষ বল এবং নিউক্লিয় ফিউশনের কারণে সৃষ্ট বহির্মুখী চাপ সৃষ্টিকারী বলের ভারসাম্যতার মাধ্যমে সূর্যসহ সব ধরনের নক্ষত্রের টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে। যদি অভিকর্ষ বল আরও শক্তিশালী হতো, তবে অভ্যন্তরমুখী আকর্ষণ বৃদ্ধির কারণে নক্ষত্রগুলো নিজস্ব ওজনের ভারে ধসে পড়তো অথবা বেশি মাত্রার ফিউশনের কারণে দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে জ্বলে যেত এবং জীবন বিকশিত হয়ে ওঠার মতো পর্যাপ্ত সময় পেত না। 
গ্রহগুলোকেও অভিকর্ষ বলই নক্ষত্রের চতুর্দিকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তিত করতে সাহায্য করছে। যদি এই বল আরও কিছুটা শক্তিশালী হতো তাহলে গ্রহগুলো প্রচ- আকর্ষণে সূর্যের ভেতর ঢুকে যেত। ফলে সৌরজগৎ সৃষ্টি হতে পারতো না। অথবা গ্রহগুলো আকর্ষিত হয়ে নক্ষত্রের এতটাই কাছাকাছি চলে আসতো যে প্রচ- উত্তপ্ত হয়ে যেতÑ যা হতো জীবন বিকশিত হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায়। আবার অভিকর্ষ বল যদি আরও কিছুটা দুর্বল হতো তবে গ্রহগুলো নক্ষত্রের চারদিকে কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান না থেকে মহাশূন্যে বিভিন্ন প্রান্তে ছিটকে যেত অথবা নিউক্লিয় ফিউশন চলমান থাকার পর্যায়ে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে শক্তি উৎপাদনে অক্ষম হয়ে যেত। ফলে এগুলো কম উত্তপ্ত হতো, উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলতো এবং জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহে ব্যর্থ হতো। 
মহাজাগতিক বস্তু ছাড়া অতিক্ষুদ্র কণাগুলোর ক্ষেত্রেও দেখা যায় বৈদ্যুতিক বল কিছুটা বেশি হলে অরবিটে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের মধ্যে ঢুকে যেত। ফলে পরমাণুগুলোর স্থায়িত্ব নষ্ট হয়ে যেত। আর পরমাণু না থাকলে কোনো প্রকার পদার্থ তথা জীবন সৃষ্টি হতো না। আবার নিউক্লিয় বল যদি আরও একটু শক্তিশালী হতো, তাহলে বিশ্বব্রহ্মা-ের প্রাথমিক অবস্থাতেই হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো অন্য হাইড্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে একীভূত হয়ে হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়ে যেত। হাইড্রোজেন নেই মানে পানিও নেই। আর তাই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া সম্ভব হতো না। আবার যদি নিউক্লিয় বল কিছুটা দুর্বল হতো, তবে তা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় জটিল পরমাণুগুলো তৈরি করতে পারত না।
ধ্রুবকগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ‘ধ্রুবকগুলো’ (ফিজিক্যাল কনস্ট্যান্ট) এমন বিশেষ কিছু মান প্রকাশ করে যেগুলো কোনো তত্ত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না, কিন্তু পরীক্ষামূলকভাবে মাপা যায়। এগুলোর মানও ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই নির্দিষ্ট করা আছে এবং এগুলোর মানের সামান্য তারতম্যও মহাবিশ্বের ভারসাম্য বিনষ্ট করে ফেলতো। তাই অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন বলগুলোর এই নির্দিষ্ট মান ও ধরন এবং ধ্রুবকগুলোর ক্রমাঙ্কন ও পরিমাপের এই সূক্ষ্মতা কখনই নিছক সম্ভাব্যতার ওপর ভিত্তি করে দৈব চয়নে নির্ধারিত হওয়া সম্ভব নয়, বরং অসীম শক্তিধর কারও ইচ্ছা ও নকশা প্রণয়নের ক্ষমতা দ্বারাই সম্ভব। 
বিশাল এই বিশ্বব্রহ্মা-ের মধ্যে অতিক্ষুদ্র আমাদের এই পৃথিবীর অবস্থানও একটা বিস্ময়কর ও চমকপ্রদ ব্যাপার। পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর অবিরামভাবে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। নিজের অক্ষে ঘোরার সুনির্দিষ্ট এই গতিই পৃথিবীকে রাত আর দিন উপহার দিয়ে যাচ্ছে, আর সূর্যের সঙ্গে সঠিক কৌণিক অবস্থানই ঋতুবৈচিত্র্য ঘটিয়ে চলেছে। ‘মিল্কিওয়ে’ বা ছায়াপথ ও সূর্য থেকে এর সুনির্দিষ্ট দূরত্ব এবং অবস্থান এতটাই নির্ভুল যে, তাপমাত্রা সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে থেকে পানিকে তরল অবস্থায় ধরে রেখে পৃথিবীকে জীবনধারণের উপযোগী করে তুলেছে।

কিন্তু এই দূরত্ব কমে গিয়ে সূর্যের আরও কিছুটা কাছে চলে এলে পৃথিবী তার সমস্ত সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যময় জীবনসম্ভার নিয়ে জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেত। আর এই দূরত্ব কিছুটা বেশি হলে ঠা-ায় সব কিছু জমে যেত এবং পৃথিবী জীবনধারণের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলত। পৃথিবীর এই সঠিক অবস্থানকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ‘গোল্ডিলকস্ জোন’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
পৃথিবীর বায়ুম-ল আরও এক বিস্ময়। অভিকর্ষ বলের সাহায্যেই পৃথিবী নিজস্ব বায়ুম-লকে ধরে রাখতে পারছে। আবার পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র আর এই বায়ুম-ল সম্মিলিতভাবে সূর্য এবং মহাজাগতিক অন্যান্য বস্তু থেকে আসা রেডিয়েশন এবং উল্কাপাতের আঘাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে থাকে। বায়ুম-লে অক্সিজেনের মাত্রাও এতটাই অনুকূল যে, শ্বাস গ্রহণ সম্ভব হয়ে উঠেছে। অথচ একই সঙ্গে নাইট্রোজেনের সঠিক মাত্রা বাতাসে আগুন ধরে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। এছাড়াও পৃথিবীর জলম-ল ও বায়ুম-লকে জীবনধারণের উপযোগী পর্যায়ে ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক চক্রও পরিচালিত হয়ে আসছে। 
মহাজাগতিক ঘটনাগুলোর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম একত্রীকরণ এবং সঠিক সময়ে সঠিক উপায়ে এগুলো ঘটে চলার কারণেই প্রকৃতি এখনকার রূপ ধারণ করেছে। পৃথিবীর আশ্চর্যজনক সাম্যাবস্থা, সুদৃঢ়তা, সুনিয়ন্ত্রণ এতই সূক্ষ্ম যে, এগুলো কাকতালীয়ভাবে একসঙ্গে ঘটে যাওয়া অসম্ভব। বলা যায়, একঝাঁক সৌভাগ্যপূর্ণ পরিস্থিতির অবতারণা ঘটানো হয়েছে পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করে তোলার জন্য। যে কোনো একটি ঘটনার সামান্য বিচ্যুতিও পুরো বিশ্বের ছন্দপতন ঘটাতে ও বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। 

উইলিয়াম প্যালে বলে একজন বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক তথা বিজ্ঞানী দাবি করেছেন যে, নিখুঁত এই পৃথিবীর সব সৌন্দর্য, ছন্দ ও বিস্ময়ের পেছনে অবশ্যই মহাশক্তিধর একজনের দক্ষ হাতের নকশা ও সুপরিকল্পনা রয়েছে। লেজার গবেষণায় যুক্ত নোবেলজয়ী (আরও দুজনের সাথে যৌথভাবে) পদার্থবিদ উইলিয়াম ডি ফিলিপস বলেছেন, আমরা এমন একটি সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল বিশ্বে বাস করি যেখানে সব ভৌত প্রক্রিয়া কতগুলো সহজ গাণিতিক সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করা যায়। কিন্তু যদি বিশ্বকে সামান্য একটু ভিন্নভাবে সৃষ্টি করা হতো, তবে সেখানে গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি সম্ভব হতো না।

এক্ষেত্রে কেন মহাবিশ্ব একটু ভিন্নতরভাবে সৃষ্টি হলো নাÑ তার পেছনে গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক কোনো কারণ বা যুক্তি দাঁড় করানো সম্ভব নয়। ১৯৬৪ সালে এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস্ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি)-তে কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্সের ওপর গবেষণারত থাকাকালীন নোবেল বিজয়ী আর একজন বিজ্ঞানী ড. টাউনস মনের ভাব প্রকাশ করেন এভাবেÑ ‘মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যত বাড়বে ততই তারা এই উপসংহারের দিকে পৌঁছবেন যে, মহাবিশ্বের জন্ম দৈবাৎ কোনো ঘটনা নয় বরং এটা কোনো ঐশী শক্তিরই ইচ্ছার প্রতিফলন।’ তিনি বিশ্বাস করেনÑ বিজ্ঞানীরা, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করতে পারছেন যে, এই বিশ্ব এমনই বিশেষায়িতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যেখানে যা কিছু ঠিক যতটুক পরিমাণে থাকা দরকার ঠিক ততটুকু পরিমাণেই সুশৃঙ্খলভাবে সুবিন্যস্ত রয়েছে।
অধ্যাপক পল ডেভিস, আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির তাত্ত্বিক পদার্থবিদ এবং জ্যোতি পদার্থবিদ্যা ও মহাবিশ্ব বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, পদার্থবিদ্যার বিধিমালাগুলোর সৌন্দর্য এবং ক্রমবিন্যাস এই নির্দেশনাই প্রকাশ করে যে, এগুলোর পেছনে নিশ্চয় কেউ একজন আছেন, যিনি মহাবিশ্বকে এত সূক্ষ্ম গাণিতিক সুসমতা, সৌন্দর্য ও সুবিন্যস্ততার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করে যাচ্ছেন। ঠিক এমনিভাবে ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী পকিং হর্ন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স-এর অধ্যাপক ডি ব্যারো বিশ্বাস করেন, মহাবিশ্বের অবিশ্বাস্য ধরনের অতি সূক্ষ্মতা ও গাণিতিক সুসমতার পেছনে নিশ্চয়ই প্রচ- বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মহাশক্তির হাত রয়েছে।
কোনো কোনো বিজ্ঞানী একাধিক মহাবিশ্বের অস্তিত্বতত্ত্বে বিশ্বাসী। তাদের মতে, আমাদের এই বিশ্ব একাধিক মহাবিশ্বের মধ্যে একটিÑ যা দৈব চয়নে জীবনধারণের সহায়ক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই তত্ত্বের সমস্যা হলো, অন্য মহাবিশ্বগুলো দেখা যায় না বা এগুলোর অস্তিত্ব প্রমাণ করাও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই তত্ত্ব মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকেই যায় যে, আমাদের মহাবিশ্ব কিভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবন ধারণের জন্য এত নিখুঁত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠলো; যেখানে একটু অসাবধানতাই জীবনধারণের পরিবেশ সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে ফেলতে পারতো! জ্যোতির্বিজ্ঞানের ‘নৃতাত্ত্বিক তত্ত্ব’ মতেও মহাবিশ্ব এমনভাবে নকশাকৃত, যাতে করে তা জীবন তথা মনুষ্য বসবাসের উপযোগ্য হয়ে ওঠে এবং যার পেছনে মহাশক্তিধর কেউ একজন আছেন।
শুধু বিশ্ব^ব্রহ্মা- আর বিশ্ব সৃষ্টির মধ্যেই নয়, অধুনা জীববিজ্ঞান ও কমপিউটার বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের আরও এক বিস্ময় ‘ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড, সংক্ষপে ডিএনএ’-এর দিকে মানুষের দৃষ্টি প্রসারিত হয়েছে। ‘ডিএনএ’ একটি রাসায়নিক, যা বংশপরম্পরায় জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণের জিনগত নির্দেশ ধারণ  করে। ইদানীং জীববিজ্ঞানীরা আধুনিক কমপিউটারের ‘কোডিং’-এর সঙ্গে ‘ডিএনএ’- এর গাঠনিক জটিলতা এবং তথ্য সম্ভারের বিশালতা তুলনা করে বিস্মিত হয়ে পড়েন। কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই সঠিক র্কাযক্রম পরিচালনের জন্য ‘কোডিং’-এর প্রয়োজন হয় এবং ‘ডিএনএ’-এর জৈবিক প্রোগ্রামিং অনেকাংশেই কমপিউটারকে পরিচালনের জন্য ব্যবহৃত ‘কোডিং’-এর অনুরূপ। ‘ডিএনএ’-তে থাকে ’নিউক্লিয়টাইডের অণুক্রম (সিকোয়েন্স)’, আর কমপিউটারে থাকে ‘বাইনারি কোড’। তার মানে দাঁড়ায়, জীবন এবং কমপিউটারের মতো জটিল বিষয় পরিচালনের জন্য ‘কোডিং’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।   
কমপিউটারের ‘কোডিং’ কমপিউটারটিকে ত্রুটিহীনভাবে যেমন পরিচালনা করে থাকে, তেমনি জীব জগতের জটিল এবং উচ্চ পর্যায়ের শৃঙ্খলাবদ্ধ ‘ডিএনএ’গুলোও সুনির্দিষ্টভাবে জীবনচক্রের সব কার্যক্রম নিখুঁতভাবে পরিচালনা করে থাকে। কমপিউটারের ‘কোডিং’ যেখানে একজন দক্ষ প্রোগ্রামার কর্তৃক প্রণীত হয়, সেখানে জীব তথা মানুষের জন্ম-মৃত্যু, শারীরিক গঠন ও সুস্থতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এসব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয় যে ‘ডিএনএ’-এর ‘কোড’ দ্বারা, সেগুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যও নিশ্চয় আরও অনেক বেশি বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো সুদক্ষ কারিগরের নির্দেশনা রয়েছে।
বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তিবিদ বিল গেটস্ একবার মন্তব্য করেন এই বলে যে, ‘ডিএনএ’ এমন এক ধরনের কমপিউটার প্রোগ্রামিং, যা যেকোনো কমপিউটার সফটওয়ারের চেয়ে অনেকগুণ বেশি উন্নত এবং পরিণত। তার তুলনায় উঠে আসে যে, মানুষ কর্তৃক প্রণীত সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তিগত প্রোগ্রামিং-এর চেয়েও অধিক উন্নত ডিএনএর সূক্ষ্মতা এবং নির্ভুল কার্যক্ষমতা। আর ‘ডিএনএ’গুলোর প্রোগ্রামিং এতটাই পরিমার্জিত ও পরিশীলিত যে, তা দৈবচয়নের কোনো ব্যাপার হতে পারে না। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি সত্ত্বেও বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বা অস্তিত্বহীনতা কোনোটাই প্রমাণ করতে পারেনি। এমনকি মহাবিশ্বের উৎস, জীবনের উৎস এবং মনুষ্য বিবেকের মূল উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদানেও বিজ্ঞান প্রায় ব্যর্থ। তাই অনেক বিজ্ঞানীই মহান সৃষ্টিকর্তার অসীম ক্ষমতার মধ্যেই এর সমাধান দেখতে পাচ্ছেন।
লেখক : পরমাণু বিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

×