ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১

সময় অপচয়ের অন্যতম মাধ্যম স্মার্টফোন

মো. হাসনাইন রিজেন

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৯ নভেম্বর ২০২৪

সময় অপচয়ের অন্যতম মাধ্যম স্মার্টফোন

স্মার্টফোন

ডিজিটালাইজেশনের যুগে সময় অপচয় করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে হাতে থাকা স্মার্টফোন। অন্য সব নেশাদ্রব্যের মতোই স্মার্টফোনও এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। স্মার্টফোনের ব্যবহার সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে ষাট বছরের বৃদ্ধ ও এই নেশায় আসক্ত। আপনার চলার পথে আশপাশে যে দিকে তাকাবেন দেখবেন সবাই হাতে থাকা স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত। মানুষ মানুষের সঙ্গে অনুভূতি শেয়ার না করে শেয়ার করে স্মার্ট ফোনের রঙিন দুনিয়ায়।

এতে করেই হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের মাঝ থেকে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। বর্তমানে আমরা অনেকেই মুঠোফোন বা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছি। দেখা যায়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬-২০ ঘণ্টাই এ যন্ত্র নিয়ে পড়ে থাকি। যার কারণে পরিবার-আত্মীয়স্বজন থেকে একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আমাদের একটি নতুন জগত তৈরি হয়ে হচ্ছে, যা আমাদের শরীর-মনকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। 
বিআইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সিরা অন্য বয়সের ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এ বিষয়ে তাদের দক্ষতাও আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। অন্য এক গবেষণা বলছে, একজন মানুষ দিনে অন্তত ২৬৬৪ বার তার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিন স্পর্শ করে। আর এই স্ক্রিন স্পর্শ করার কারণ ফোনের নোটিফিকেশন চেক, কোনো এসএমএস এলো কি না ইত্যাদির দিকে মনোনিবেশ করে। অল্পবয়সিরা দিনে দিনে ঝুঁকে যাচ্ছে ইন্টারনেটের অপব্যবহারে। বর্তমানে যারা দ্রুত ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে তাদের বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছর অর্থাৎ তরুণসমাজ। এদের মধ্যে প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত এবং পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ, যাদের মধ্যে ১০ কোটি ৬৩ লাখ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশাল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতিদিন শুধু পাবজি নামক ভিডিও গেম খেলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এসব ভিডিও গেম খেলার ফলে শিশু-কিশোর বা শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়; এমনকি চোখের দৃষ্টিশক্তির হ্রাসসহ মানসিকভাবে অনেকে বিকারগ্রস্ত হচ্ছে।
চিকিৎসায় দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন, টেলিভিশনে আসক্তি শিশুর দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিচ্ছে চোখের। তারা শিশুদের চোখের সমস্যার তিনটি কারণের কথা বলেছেন। এর মধ্যে প্রথম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে কোনো কোনো শিশু চোখে সমস্যা নিয়েই জন্মায়। দ্বিতীয় ভিটামিন ‘এ’র অভাবে শিশু রাতকানা রোগে ভুগতে পারে, এমনকি অন্ধও হয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত, স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে শিশুরা চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পায় না। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে মাসে গড়ে সাড়ে তিন হাজার শিশু আসে। এর ৭০ শতাংশ দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর তথ্যও অভিন্ন। ডাক্তাররা এই রোগকে বলেন, ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম’। 
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাজার শিশু নতুনভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। কম্পিউটার, টিভি ও মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে জীবনের সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমাদের শিশুরাও যুক্ত হচ্ছে কম্পিউটার, টিভি, মোবাইল ট্যাবের সঙ্গে। কিন্তু অতি আসক্তির কারণে তাদের একটি বড় অংশ সর্বনাশের শিকারও হচ্ছে। শুধু দৃষ্টিশক্তির সমস্যা নয়, নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যারও শিকার হচ্ছে তারা। এ বিপজ্জনক ধারা থেকে শিশুদের রক্ষায় বাবা-মাকে সতর্ক হতে হবে। শিশুরা যাতে কম্পিউটার বা মোবাইল-আসক্তি নামের সর্বনাশের দিকে পা না বাড়াতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরি।
মোবাইল আসক্তি শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই নয় বরং সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে এখন মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ফ্লোরিডা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেছেন, মুঠোফোনে আসক্ত ব্যক্তিদের উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগে আক্রান্তসহ নানাবিধ জটিল রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। শতকরা ৬৩ শতাংশ মানুষ ঘুম থেকে উঠেই স্মার্টফোনে আগে চোখ রাখেন। অবস্থা এতই ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে যে, মুঠোফোনে আসক্তিকে পিসিম্যাগ প্লেগ রোগের সঙ্গে তুলনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মোবাইল আসক্তি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা বলেন, সামান্য কিন্তু কার্যকর পরিবর্তন আনা গেলে একাধারে যেমন মুঠোফোন আসক্তি দূর হবে তেমনি বিষণœতার মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকেও মুক্তি মিলতে পারে।

মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে তাদের গবেষণার কার্যকর কিছু দিক হলো : নোটিফিকেশন নিয়ন্ত্রণ, মোবাইল ব্যবহারের সময় নির্ধারণ, ঘুমের সময় মুঠোফোন দূরে রাখা, আইফোন বা অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে চলা মুঠোফোনে গ্রেস্কেল মোডে সুইচ অন করে রাখা, ই-মেইল, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ অ্যাপ লুকিয়ে রাখা,  মুঠোফোন থেকে দূরত্ব বজায়, কঠিন আনলক পদ্ধতি চালু, মুঠোফোনের কাজ কম্পিউটারে করা ইত্যাদি। 
সর্বাধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মোবাইল ফোন আবিষ্কারে মানুষের জীবনযাত্রার মান যতটা বেড়েছে ঠিক ততটাই অনাচার ও অপরাধ প্রবণতাও বেড়েছে। মোবাইল ফোনের যথাযোগ্য ব্যবহারে যোগাযোগ যতটা সহজ হয়েছে তেমনি নানা অপকর্ম, কুকর্ম ও নেতিবাচক কাজে জনজীবন হয়ে উঠেছে। আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে অপরাধ প্রবণতাও। বিভিন্ন প্রকার নিষিদ্ধ অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে ভিডিও চিত্র ধারণ করে কয়েক মিনিটেই ভয়েস কল, ডাটা কল, সার্কুলেশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে।

ফলে বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ এবং বিনষ্ট হচ্ছে শৃঙ্খলা। ছাত্রছাত্রীদের নকল প্রবণতা, উঠতি বয়সীদের যৌন প্রবণতা সবকিছু উপেক্ষা করেই মোবাইল ফোনের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাসমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়া’র আন্দোলনের মতোই  মোবাইল আসক্তি মুক্ত করার দাবি সকল অভিভাবক, শিক্ষিত ও আত্মসচেতন মানুষসহ সকল মহলের হওয়া উচিত। অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হয়তো ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না।

×