ফিলিস্তিন ইস্যু এক দীর্ঘস্থায়ী মানবিক সংকট, যা প্রায় সাত দশক ধরে চলে আসছে। ফিলিস্তিনের জনগণ প্রতিনিয়ত ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, নির্যাতন, এবং অবৈধ বসতি স্থাপনের শিকার হয়ে বেঁচে আছে। এই সংকট কেবলমাত্র ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা, এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নে এক বিশ্বব্যাপী বিবেকের আহŸান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রশ্ন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে জাতিসংঘ কি প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে যথাযথ ভ‚মিকা পালন করতে পেরেছে, নাকি তা কেবল একটি নীরব দর্শকের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে?
ফিলিস্তিন সংকটের শিকড় গেড়ে বসেছে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে। তখন থেকেই সংঘাতের মূলে রয়েছে ভ‚মির প্রশ্ন এবং জনগণের অধিকার। ফিলিস্তিনিদের জন্য এই বছরের ঘটনাবলী ছিল বিপর্যয়কর, যা তাদের ভ‚মিহীন হতে বাধ্য করেছিল। ১৯৪৮ সালের সেই ঘটনার পর লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়, যা ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসে "নাকবা" বা বিপর্যয় নামে পরিচিত। পরবর্তী কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব এবং বসতি স্থাপন অব্যাহত থাকে, যা ফিলিস্তিনিদের মৌলিক মানবাধিকারের ওপর চরম আঘাত হানে। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। এই দখলদারিত্ব ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন এক দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে, যা আজও চলছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৬৭ সালে ২৪২ নম্বর প্রস্তাবে ইসরায়েলকে দখলকৃত অঞ্চল থেকে সরে যাওয়ার আহŸান জানায়। কিন্তু ইসরায়েল সেই প্রস্তাব উপেক্ষা করে চলেছে এবং বসতি স্থাপনের কার্যক্রম ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলেছে। এই বসতি স্থাপন কার্যক্রম আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হলেও কার্যত কিছুই বন্ধ করা যায়নি।
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য ছিল বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা, এবং মানবাধিকার রক্ষা করা। ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসংঘ বারবার প্রস্তাব পাস করেছে, যা আজও কার্যকর হয়নি। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব করেছিল। এর মাধ্যমে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও একটি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু সে পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। সেই থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসংঘের ভ‚মিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধুই একটি নীতিগত অবস্থান, যা কখনোই কার্যকর রূপ পায়নি। নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কয়েকটি প্রস্তাব থাকলেও সেগুলো প্রায়শই বড় শক্তিগুলোর স্বার্থের কারণে আটকে যায়। ইসরায়েলকে দখলদারিত্ব থেকে সরে আসতে বলা হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশ প্রায়শই ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং প্রস্তাবগুলো ভেটো করে। এর ফলে ফিলিস্তিন সংকট ক্রমাগত আরও জটিল হয়ে উঠছে। বিশ্বের বড় বড় শক্তিগুলোর এই পক্ষপাতমূলক আচরণ জাতিসংঘের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
গাজা উপত্যকা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এবং অবরুদ্ধ অঞ্চলগুলোর একটি। গাজার জনগণকে প্রতিনিয়ত পানির অভাব, বিদ্যুৎ সংকট, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবার অভাবে দিন পার করতে হচ্ছে। স্কুল এবং হাসপাতালগুলো প্রায়শই হামলার শিকার হয়, যা শিশু ও অসহায় জনগণের জন্য এক ভয়াবহ বাস্তবতা তৈরি করেছে। জাতিসংঘের একাধিক রিপোর্টে গাজার মানবিক সংকটের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই অবরোধের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। শিশুরা বেড়ে ওঠছে একটি সহিংস পরিবেশে, যা তাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
জাতিসংঘের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের অন্যান্য শক্তিগুলোরও ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে ভ‚মিকা পালন করার কথা ছিল। তবে বাস্তবে দেখা যায়, বড় শক্তিগুলোর ভ‚রাজনৈতিক স্বার্থ এই সংকট সমাধানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতমূলক নীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৃদু প্রতিক্রিয়া এবং আরব বিশ্বের বিভাজন ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে দুর্বল করে দিয়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়ার পথ আরও সংকুচিত হয়ে গেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরলেও, তা কার্যকর কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন থেকে শুরু করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থা বারবার ইসরায়েলের দখলদারিত্ব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে। এসব প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক স্তরে সমালোচনা ও উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, কোনো কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা আজও অব্যাহত।
জাতিসংঘের সামগ্রিক প্রচেষ্টা ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে যথেষ্ট না হওয়ায় এটি এক বড় আন্তর্জাতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়। যদিও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ফিলিস্তিনে ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা প্রদান করে চলেছে, তবে বাস্তব সমাধান আনতে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য জরুরি। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ না করলে এবং পক্ষপাতমূলক আচরণ বন্ধ না হলে এই সংকটের সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়বে। ইসরায়েলি দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখার পেছনে এই ধরনের বৈশ্বিক পক্ষপাতিত্ব ভ‚মিকা রেখেছে। জাতিসংঘের কার্যকর ভ‚মিকা না থাকায় সমালোচকরা প্রায়শই সংগঠনটির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা মনে করেন, জাতিসংঘ একটি নীতিহীন এবং অকার্যকর সংস্থা হয়ে উঠেছে, যা বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে জাতিসংঘের অপারগতা এই সমালোচনার একটি বড় উদাহরণ। যদিও জাতিসংঘের লক্ষ্য ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার রক্ষা করা, তবে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সেই লক্ষ্য প্রায়শই অপূর্ণ থেকেছে।
ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে রাজনৈতিক সমঝোতা এখনো সবচেয়ে কার্যকর পথ হিসেবে বিবেচিত। দুই রাষ্ট্র, যেখানে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সহাবস্থান করবে, দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তবে এই সমাধান বাস্তবায়ন করতে হলে উভয় পক্ষকেই বড় ধরনের ছাড় দিতে হবে এবং আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি সমঝোতা তৈরির জন্য কার্যকর ভ‚মিকা পালন করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধান আনতে হলে জাতিসংঘ এবং বিশ্বের অন্যান্য শক্তিগুলোকে নিরপেক্ষ এবং সক্রিয় ভ‚মিকা রাখতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা এবং অন্যান্য মানবিক সংস্থাগুলোকে আরো কার্যকরভাবে কাজ করতে হবে। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মতবিরোধ কমিয়ে ঐক্যমত্য তৈরি করা ছাড়া এই সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একটি সুষ্ঠু এবং স্থায়ী সমাধানের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোকেও ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকারের প্রশ্নে কেবল নিন্দা বা উদ্বেগ প্রকাশ নয়, বরং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অবিচারের অবসান ঘটানো প্রয়োজন। বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিতে কার্যকর প্রতিক্রিয়া এবং পদক্ষেপ নিয়ে জাতিসংঘের চাপ সৃষ্টি করতে হবে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে মানবিক সাহায্য এবং রাজনৈতিক সমর্থন উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয় হওয়া জরুরি।
ফিলিস্তিন সংকট এক দীর্ঘ এবং জটিল সমস্যা হলেও এটি কোনোভাবে অমীমাংসিত থাকতে পারে না। এই সংকটের একটি মানবিক সমাধান খুঁজে বের করা আজকের পৃথিবীর অন্যতম বড় নৈতিক দায়িত্ব। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে নিজেদের ভ‚মিকাকে নতুন করে পর্যালোচনা করতে হবে। আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে অবশ্যই একত্রিত হয়ে একটি মানবিক ও স্থায়ী সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। যত দিন পর্যন্ত ফিলিস্তিন ইস্যু অমীমাংসিত থাকে, তত দিন বিশ্বে মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নে এক বড় সংকট বহাল থাকবে। এটি কেবল ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য এক বৃহৎ চ্যালেঞ্জ। মানবিক সংকটের সমাধান করতে হলে ক্ষমতার রাজনীতি নয়, বরং মানবতার প্রশ্নে সবাইকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। শুধু তখনই ফিলিস্তিন ইস্যুতে একটি সুবিচারমূলক সমাধান সম্ভব হবে, যেখানে সবাই শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারবে। একটি ন্যায়ভিত্তিক, স্থায়ী এবং সম্মানজনক সমাধান ছাড়া বিশ্বের শান্তি ও মানবিক মূল্যবোধ কখনোই পূর্ণতা পাবে না। ফিলিস্তিনের জনগণ অপেক্ষা করছে সেই দিনের জন্য, যেদিন তারা স্বাধীনতার স্বাদ পাবে এবং বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। এই মানবিক সংকটের সমাধান নিয়ে জাতিসংঘ ও বিশ্ব স¤প্রদায়ের দায়িত্ব এখনো অমীমাংসিত। আমাদের সকলেরই উচিত সেই সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া, কারণ মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারই সভ্যতার প্রধান স্তম্ভ।
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ