-
তাজমহল রোড, নুরজাহান রোড, শ্যামলী রিং রোড, রায়েরবাজার, হুমায়ন রোড ও বাবর রোডের আশপাশে জেনেভা ক্যাম্প এলাকা, টাউন হল ও আসাদ অ্যাভিনিউয়ের আশপাশ, আজম রোড, ইকবাল রোডে কিশোর গ্যাং জাতীয় অপরাধীদের তৎপরতা বেশি। ছোটবড় মিলিয়ে এই এলাকায় আছে ৩০টি কিশোর গ্যাং। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ঠেলার নাম বাবাজি, ডায়মন্ড গ্রুপ, সালাম পার্টি, আসসালামু আলাইকুম পার্টি, দে ধাক্কা গ্রুপ, ব্রেকফাস্ট পার্টি, টক্কর ল, পাটালি গ্রুপ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, ল ঠেলা গ্রুপ, কোপাইয়া দে, ভাইপার, তুফান, টিকটক, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার, এসকে হৃদয় গ্রুপ, রনি গ্রুপ ও বিচ্ছু বাহিন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ভাষ্য, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র চলে যায় অপরাধীদের হাতে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ভয়াবহ অপরাধ করছে স্থানীয় কিশোর গ্যাংসহ সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। ২৬ অক্টোবর মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আলটিমেটাম দিয়ে থানা ঘেরাও করে স্থানীয়রা। এরই প্রেক্ষিতে মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশ বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে এক সপ্তাহে ১৮০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র। উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন স্থান থেকে লুট হওয়া টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মালামাল।
সম্মানিত পুলিশ মহাপরিদর্শক সন্ত্রাস-ছিনতাই-চাঁদাবাজি-মাদক-কিশোর গ্যাংসহ ট্রাফিক আইনলঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান জোরদার করতে পুলিশের সকল ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছেন। ২৮ অক্টোবর, ২০২৪ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশব্যাপী চলতি ১৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী, গুরুত্বপূর্ণ হত্যা মামলার আসামিসহ অন্যান্য মামলার আসামির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। চলমান অভিযানে অপরাধপ্রবণ এলাকা অর্থাৎ ক্রাইম জোনে কম্বিং অপারেশন (চিরুনি অভিযান) পরিচালিত হচ্ছে। পুলিশের স্থায়ী তল্লাশি চৌকি বা চেকপোস্টের পাশাপাশি অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশি টহল জোরদারের সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে টহল দল ও গোয়েন্দা নজরদারি। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন এলাকায় ১৫০টি স্থায়ী ও অস্থায়ী চেকপোস্ট, ৩০০টি মোটরসাইকেল টিম এবং ২৫০টি টহল টিম কার্যকর রয়েছে। এ ছাড়া দেশব্যাপী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণও অব্যাহত।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সূত্রে জানা যায়, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাশাপাশি সংস্থাটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড রোধ ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে দেশব্যাপী নিরপেক্ষতা-পেশাদারিত্বের সঙ্গে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচলানায় নিয়োজিত। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অপরাধপ্রবণ এলাকায় তাদের যৌথ অভিযান সর্বত্রই প্রশংসিত হয়েছে। অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, কিশোর গ্যাং হোতা গ্রেপ্তারসহ উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, মাদকদ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র। ৪ সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া যৌথ অভিযান সাম্প্রতিক সময়ে আরও জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে অভিযানের পরিধি ও সংখ্যা। যৌথ অভিযানে কিছু কিছু এলাকায় ব্লক রেইড ও কম্বিং অপারেশন (চিরুনি অভিযান) পরিচালনা করা হচ্ছে। অংশগ্রহণও বেড়েছে সশস্ত্র বাহিনী-পুলিশ-বিজিবি-র্যাব-আনসার-কোস্টগার্ডসহ সকল বাহিনীর।
৫ নভেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যৌথ অভিযানে ৩৬৭টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ১৬৭টি। অভিযানে গ্রেপ্তারকারীর সংখ্যা ২১৭ জন। ৩১ অক্টোবরের পর ৪ দিনে আরও শতাধিক অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব হয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি। অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- রিভলবার, পিস্তল, রাইফেল, শর্টগান, পাইপগান, শূটারগান, এলজি, বন্দুক, একে-৪৭ রাইফেল, এসএমজি, গ্যাসগান, এয়ারগান, এসবিবিএল, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার ও থ্রি- কোয়ার্টার ইত্যাদি। এছাড়া পুলিশের লুট হওয়া ৬ হাজার ৭৪৯টি অস্ত্র ও ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি গোলাবারুদের মধ্যে গত ২ নভেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে যথাক্রমে ৪ হাজার ৩১৩টি অস্ত্র ও ৩ লাখ ৮৮ হাজার ১৮২টি গোলাবারুদ। সম্মানিত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার আন্তরিক প্রচেষ্টায় যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি অপরাধীদের কঠোর হস্তে দমনের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ৬ নভেম্বর ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো। তবে আরও উন্নতি কিভাবে করা যায় সে চেষ্টা চলছে। মোহাম্মদপুর মডেলে পুরো শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা হবে। কোনো চাঁদাবাজ বা কোনো অপরাধীর ছাড় নেই, সে যত প্রভাবশালীই হোক না কেন।’
সার্বিক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত হলেও অধিকাংশ অপরাধী এখনো প্রকাশ্যে তাদের অপতৎপরতা চালু রেখেছে। চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য নগর-শহরেও ফ্লাইওভার ও বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের যানবাহন ছিনতাই অহরহ সংঘটিত হচ্ছে। জনশ্রুতি মতে, গ্রামগঞ্জেও চুরি-ডাকাতির ভয়ে জনগণ গভীর আতঙ্কিত। যৎসামান্য ধনসম্পদ রক্ষার্থে তারা যারপরনাই কাতরতায় ভুগছে। এলাকাভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা না গেলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসব দুর্বৃত্তায়ন রোধ করা দুরূহ বিষয়ে বটে। মসজিদ-মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়মিত নীতিনৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের বক্তব্য প্রচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ করে তরুণ-যুবকদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধ দমনের নানা উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের জোরালো দাবিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী