ডোনাল্ড ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোনো নারীকে দেখতে চান না এমন একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে পুনরায় প্রমাণ হয়েছে সেটি। ৫৩৮টির মধ্যে ২৯২টি ইলেকটোরাল কলেজের ম্যাজিক ফিগার অতিক্রম করেছেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। এর আগে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এই নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বয়সে নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
জো বাইডেন এর আগে ৭৭ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এবারের নির্বাচনে তিনি ৬০ বছর বয়সী কমলা হ্যারিসকে হারিয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ২২৪ ইলেকটোরাল ভোট। আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। ১৮৪৫ সাল থেকে এমন নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া, আইনি ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক প্রস্তুতির জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও শপথ গ্রহণের মাঝে কিছুটা সময়ের ব্যবধান রাখা হয়, যা নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এর আগে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারী ক্লিনটনকে হারিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবার প্রেসিডেন্টে নির্বাচিত হন। গত ৮ বছরে ৩বার নির্বাচনে অংশ নিয়ে ট্রাম্প জয়ী হলেন ২ বার। ২০২০ সালের নির্বাচনে তিনি ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী জো বাইডেনের নিকট হেরে যান। গত নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর এবারসহ দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে এমনটা খুব দেখা যায়নি। লাগাতার ৩টি নির্বাচনে লড়াই করে প্রথম এবং তৃতীয় দফায় জয়লাভ করা ২য় ব্যক্তি হলেন ট্রাম্প। এর আগে ১৮৯২ সালে এমন কীর্তি শেষ এবং একবারই হয়েছিল।
২০১৬ সালে হাতির পিঠে চড়ে প্রেসিডেন্ট হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে এবারও হোয়াইট হাউসের চাবি উঠেছে। সেবার তাঁর স্লোগান ছিল- ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি দ-িত হয়েছেন ফৌজদারি অপরাধে। বিগত চার বছর নানা ঘটনা বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাত নিয়ে তদন্ত, একাধিক যৌন হয়রানির অভিযোগ ও মামলা, ট্যাক্স রিটার্ন মামলা, এমনকি তাঁকে হত্যাচেষ্টার ঘটনা-সবকিছু মিলিয়ে অনেকেই ধারণা করেছিল ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারই হয়তো শেষ হতে চলেছে।
কিন্তু এমন ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে ভোটের মঞ্চে আবারও বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তন ঘটেছে ট্রাম্পের। এবারের নির্বাচনে ‘আমেরিকাকে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট’ পরানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে তাঁর। ট্রাম্প ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে সমর্থকদের উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তব্যে বলেন, আমেরিকার জনগণের জন্য এটি চমৎকার জয়। এটা আমাদের আমেরিকাকে আবারও মহান করার সুযোগ দেবে। তিনি আরও বলেন, ‘ঈশ^র একটি কারণে আমার জীবন রক্ষা করেছেন।’ আর ওই কারণ হলো, আমাদের দেশকে রক্ষা ও যুক্তরাষ্ট্রের মহিমা পুনরুদ্ধার করা। এখন আমরা একত্রে ওই লক্ষ্য পূরণ করতে চলেছি। এই বক্তব্যের মাধ্যমে ট্রাম্প মূলত এবারের নির্বাচনে প্রচার চলাকালে দুই দফা হত্যাচেষ্টা থেকে তাঁর বেঁচে যাওয়ার ঘটনাকে ইঙ্গিত করেছেন।
এটি আমেরিকার ‘স্বর্ণযুগ’ হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি এ বিজয়কে ‘রাজনৈতিক বিজয়’ বলে অভিহিত করেন। ট্রাম্প আরও বলেন, আমাদের সামনে যে কাজ রয়েছে, তা সম্পাদন করা সহজ হবে না। কিন্তু, আপনারা যে দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করেছেন, তা পালন করতে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা চালাব। সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রতিটি দিন আমি আপনাদের জন্য লড়াই করে যাব। এ সময় তাঁর সঙ্গে স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প এবং রানিংমেট জে ডি ভান্স উপস্থিত ছিলেন।
বিশ^নেতারা এরই মধ্যে ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানাতে শুরু করেছেন। তাঁদের মধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিশ^নেতারা রয়েছেন। অভিনন্দন বার্তায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, সম্মান এবং উচ্চাকাক্সক্ষার সঙ্গে আরও শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আমরা চার বছর একসঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ‘ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রত্যাবর্তন’ বলে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এক্সে প্রদত্ত পোস্টে তিনি বলেন, ‘প্রিয় ডোনাল্ড এবং মেলানিয়া ট্রাম্প, ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রত্যাবর্তনের জন্য অভিনন্দন! হোয়াইট হাউসে আপনাদের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন আমেরিকার জন্য একটি নতুন সূচনা এবং ইসরাইল ও আমেরিকার জোটের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি বার্তা।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পকে বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি এক্সে লেখেন, ‘ঐতিহাসিক নির্বাচনে জয়ের জন্য বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন। সে সঙ্গে তিনি আগের বারের মতোই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার কথাও বলেন। ‘আসুন একসঙ্গে, আমাদের জনগণের উন্নতির জন্য এবং বিশ^ শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির জন্য কাজ করি’।
গাজা-ইউক্রেনসহ বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার গুরুত্বকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। তবে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এবং ন্যাটোসহ জোটে প্রধান ভূমিকার জন্য বিশ^মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখনো গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিজস্ব পথে চললেও স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা তাদের নিজ নিজ মিত্র তৈরি করে নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জন্য এমন একটি বিশ^ অপেক্ষা করছে, যেখানে শান্তির চেয়ে সংঘাত বেশি। যুদ্ধ মোকাবিলা করেই নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে উচ্চমূল্যস্ফীতি। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো খরচ কমানো। ওয়শিংটনে বক্তব্য প্রদানের সময় ট্রাম্প জিজ্ঞাসা করেন, ‘চার বছর আগের তুলনায় আপনি কি এখন ভালো অবস্থায় আছেন?’ তিনি তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পুনরাবৃত্তি করে বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি কমানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় ছিল- অর্থনীতি, গর্ভপাত ও অভিবাসন।
তবে ভোটারদের নিকট প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল দেশটির অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচন অভিবাসীদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল। ট্রাম্প অভিবাসনবিরোধী কড়া বক্তব্য দিয়েছিলেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পর প্রথম দিন থেকেই অভিবাসী বিতারণে কাজ শুরু করবেন এবং ‘অভিবাসী আক্রমণের’ ধারা উল্টে দেবেন বলে তিনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সিইও কমফোর্ট ইরো বলেন, শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক শক্তি।
তবে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাধানে সহায়তা করার শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের হ্রাস পেয়েছে। প্রাণঘাতী সব সংঘাত আরও জটিল হয়ে উঠছে, বড় শক্তির দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং মধ্যম শক্তির দেশগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র তার নৈতিকতার উঁচু স্থান হারিয়েছে। ট্রাম্প যদি ক্ষমতায় আসেন তবে গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান বহুমুখী যুদ্ধে ইসরাইলকে প্রশ্রয় দিতে পারেন। যদিও তিনি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমনকি, কিয়েভকে টপকে গিয়ে মস্কোর সঙ্গে চুক্তির প্রচেষ্টাও তিনি করতে পারেন। ট্রাম্প বলেন, কমলা ও জো বাইডেন বিশ^জুড়ে ও আমেরিকায় হিন্দুদের উপেক্ষা করে আসছে।
ইসরাইল থেকে ইউক্রেন এবং সেখান থেকে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত পর্যন্ত এলাকার জন্য তাঁরা একটি বিপর্যয় ডেকে এনেছেন। সেখানে আমরা আবার আমেরিকাকে শক্তিশালী করব এবং সেই শক্তি দিয়ে আবার শান্তি ফিরিয়ে আনব। ট্রাম্প কর ও বিধিনিষেধ কমিয়ে এবং আমেরিকার শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে বড় সমর্থন দিয়েছেন মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক।
বিশে^র অনেক শক্তিশালী দেশ ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন নির্বাচনে জয়লাভ করেন সেটি চেয়েছিল। ট্রাম্পপন্থি শিবিরে ছিল আর্জেন্টিনা, ইসরাইল, রাশিয়া, ভারত, হাঙ্গেরি ও সৌদি আরব। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারেন, এই ভেবে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদের ঘুম হারাম হওয়ার অবস্থা ছিল। তারা এই ভেবে ভীত ছিল যে, ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় এলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথাগত বৈদেশিক নীতিতে বড় পরিবর্তন আসবে। সবচেয়ে লাভ হবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের। এই দুজনের চলমান সখ্য রাতারাতি কৌশলগত অংশীদারিত্বে পরিণত হতে পারে।
এর ফলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ন্যাটোভিত্তিক যে আন্তঃআটলান্টিক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা হয় ভেঙে যাবে, নয়তো দুর্বল হবে। ইউরোপের যে সকল রাজনীতিক নিজ দেশে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ট্রাম্প জিতলে তাঁরা সবচেয়ে উৎসাহী হবেন। ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলগুলো তাঁর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবেন। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানো ইউক্রেনের মোটেও উচিত হয়নি এমন মন্তব্যও করেছিলেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ক্ষমতা গ্রহণের একদিনের মধ্যে এই যুদ্ধের সমাধান করবেন। ট্রাম্পের প্রথম দফায় আন্তর্জাতিক আইনকে তোয়াক্কা না করে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করা হয়েছিল। তাঁর সময়ে ওয়াশিংটনে পিএলও দপ্তর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিন ত্রাণ সংস্থার চাঁদাও আটকে দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প প্রথম দফায় বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তথাকথিত ‘মুসলিম ব্যান’। সন্ত্রাসী অভিযোগে সাতটি মুসলিম দেশের জনগণের যুক্তরাষ্ট্র আগমন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তবে এবারে এশিয়ায় বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতির বড় কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। কারণ ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতির একটি প্রধান স্তম্ভই হলো চীনের বিরোধিতা। তিনি নির্বাচিত হলে সেটি আরও জোরদার হবে। ট্রাম্প বলেন, অন্যান্য ন্যাটো রাষ্ট্রকেও তাদের ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে তিনি বাধ্য করবেন।
জাতিসংঘের মানবিক ও জরুরি ত্রাণ সমন্বয় বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল গ্রিফিথস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশে^ অতুলনীয় প্রভাব বিস্তার করে কেবল অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির মাধ্যমেই নয়, বরং বিশ^মঞ্চে নৈতিক কর্তৃত্বের সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে একতরফাবাদ এবং একলা চল নীতি নেওয়া ট্রাম্প যদি ফিরে আসেন তাহলে বিশ^ব্যাপী অস্থিতিশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে গ্রিফিথস মনে করেন।
বৈশি^ক সংঘাত ও অনিশ্চিয়তার এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র দায়িত্বশীল ও নীতিবাদ নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ নিয়ে উঠে দাঁড়াক, সেটিই বিশ^বাসী কামনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীরতর রাজনৈতিক বিভাজন ও প্রশাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত অসন্তোষের সম্মুখীন। এটি উল্লেখযোগ্যভাবে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবসহ একটি অস্থির নির্বাচনী প্রতিযোগিতার চিত্রকেই উপস্থাপন করে। ইউক্রেনে বিদ্যমান যুদ্ধ, ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের যুদ্ধ, আফগানিস্তান থেকে ২০২১ সালে সৈন্য প্রত্যাহার এবং চীনের সঙ্গে বৃহৎ শক্তির উত্তেজনা বৃদ্ধির মতো প্রধান বিদেশনীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলো ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল।
এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক মঞ্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিপথের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। বাইডেন প্রশাসন কঠোর সীমান্ত নীতি ছাড়াই ইউক্রেনকে সহায়তা, ইসরাইল-গাজা দ্বন্দ্বের প্রতিবাদ এবং অভিবাসন নীতি সংস্কারে রিপাবলিকান দলের বাধাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যও নিবিড়ভাবে নজর রেখেছিল। গাজা যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সমালোচকদের সন্দেহ, ইচ্ছাকৃতভাবেই এই যুদ্ধকে মার্কিন নির্বাচনের পর পর্যন্ত টেনে নিতে চায় নেতানিয়াহু। এখন ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে নীতির পরিবর্তন ঘটান কিনা, সেটাও দেখার বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল বাংলাদেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় ভারতের প্রভাব বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়গুলো হচ্ছেÑ ব্যবসা-বাণিজ্য, কৌশলগত, ভূরাজনৈতিক। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগ্রহ বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় নিজেদের বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে মনে করে।
যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং লেখক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলের ওপর ভিত্তি করে দু’দেশের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে। তিনি বলেন, ট্রাম্প বর্তমান সম্পর্কের কাঠামোকে হয়তো সমর্থন করবেন, যেখানে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে উন্নয়ন, সংস্কার ও অন্যান্য সহায়তা বা সমর্থন করছে। ট্রাম্প ও তার প্রশাসন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা প্রদানের ওপর জোর দেওয়ার মতো সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী হবে না।
সম্প্রতি ট্রাম্পের সংখ্যালঘু নির্যাতন সংক্রান্ত একটি টুইট আলোচনা সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশে। তবে অনেক বিশ্লেষক এটিকে ভবিষ্যৎ নীতির চেয়ে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের হিন্দু ভোটার টানার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ^বিদ্যালয়ের এ অ্যান্ড এম বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহনাজ মোমেন মনে করেন, সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট পরিবর্তিত হলেও বৈদেশিক নীতিতে খুব বড় একটা পরিবর্তন হয় না। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা বা কাঠামোগুলোর একটা শক্তিশালী ভূমিকা থাকে।
কিন্তু ট্রাম্পকে আমরা দেখেছি কিছু ইনস্টিটিউশনকে বদলে দেওয়ার কথা বলেছেন। সেটা হলে একটা বড় পরিবর্তন আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে ভারতের চোখে দেখার এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে। ট্রাম্প যেহেতু ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পর্কে বিশ^াসী, তাতে করে পুতিনের মতো মোদিকেও তিনি সমর্থন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়