পেছনে ফিরে যতদূর তুমি তাকাবে, সামনের দিকেও ঠিক ততদূরই তুমি দেখতে পাবে। অনাগত দিনের পথচলায় পেছনে ফিরে তাকানোর বিকল্প নেই। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের এই দিনে প্রিয় পাঠক, আসুন একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক।
১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম কয়েকটি দিন বাংলাদেশের স্বার্বভৌমত্বের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষ করে ৭ নভেম্বর। এ দিনেই সিপাহী জনতার দুর্বার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা হয়, যা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে এ দেশের ইতিহাসে প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে। সিপাহী ও সর্বস্তরের জনতার সচেতনতা ও দেশপ্রেম সেদিন দেশকে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করে। ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস।
১৯৭৫ সালের এই দিনে আধিপত্যবাদী চক্রের সব ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয় বুকে নিয়ে সিপাহী-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল। তাদের ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমেই রক্ষা পায় সদ্য অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। কয়েকদিনের দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে সিপাহী-জনতা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশা থেকে মহান স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে মুক্ত করে দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব তুলে দেয় তার হাতে। তাই ৭ নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের এক অনন্য ঐতিহাসিক তাৎপর্যমন্ডিত দিন। সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে আধিপত্যবাদ, একনায়কতস্ত্র, একদলীয় শাসন, জনজীবনের বিশৃঙ্খলাসহ তৎকালীন বিরাজমান নৈরাজ্যের অবসান ঘটে। অস্থিতিশীলতা উজিয়ে দেশে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরে আসে।
১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল। হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর একটি উচ্চাভিলাষী দল সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে বন্দি করে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় দেশের সাধারণ জনগণ ও সিপাহীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সর্বমহলে, বিশেষত সিপাহীদের কাছে ছিলেন খুবই প্রিয়। ফলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ ও জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ঘটে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ এক বিপ্লব, যা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে মর্যাদার আসন লাভ করেছে।
দেশবাসী সেদিন জিয়াউর রহমানের হাতেই তুলে দিয়েছিল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব। ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতা স্বকীয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চক্রান্তকারীদের খপ্পর থেকে দেশকে উদ্ধার করে ২৫ বছরের গোলামী চুক্তিকে নিকুচি করে সত্যিকার স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে স্থান করে নেয়। ওই সময় বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ (গুটিকয় বৈদেশিক অনুচর ছাড়া) এবং সশস্ত্রবাহিনীর পূর্ণ সমর্থন ও আস্থা নিয়ে দেশকে উন্নতি, অগ্রগতি ও শান্তির পথে নিয়ে যায়। সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে নস্যাৎ হয়ে যায় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী, দেশীবিরোধী সকল ষড়যন্ত্র। আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ।
৭ নভেম্বরের বিপ্লব সম্পর্কে তদানীন্তন দৈনিক বাংলার রিপোর্টে বলা হয়, সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চারদিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন বিপ্লবী সিপাহীরা। সেই ৭ নভেম্বর ছিল শুক্রবার। সেদিন ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি।’ জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। ওইদিন রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে। আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাঙ্কের নলে পরিয়ে দেন ফুলের মালা। বারুদের গন্ধ ছাপিয়ে ভেসে আসে ফুলের সুবাস। এই আনন্দের ঢেউ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। তবে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট অন্যান্য অভ্যুত্থানের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। পেরিয়েছে নানা চড়াই-উতরাই। এই সময়ে নেতাকর্মীদের কেউ কেউ হারিয়েছেন প্রাণ। কেউবা হয়েছেন পঙ্গু। কারো পরিবার সব হারিয়েছে। বন্দি দলের হাজারো নেতাকর্মী। অনেকেই সাজা ও পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ফেরারি জীবনযাপন করেন। এক-এগারোসহ পরবর্তী সময়ের মামলার ভারে কাবু বিএনপি। দলটির দাবি, গত ১৫ বছরে প্রায় দেড় লাখ মামলায় আসামি হয়েছেন তাদের ৫০ লাখেরও বেশি নেতাকর্মী। মামলার বাইরেও দলটির ১ হাজার ৫৭৪ জন নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন হাসিনা সরকারের হাতে।
গত ১৭ বছরে আধিপত্যবাদী শক্তির তাঁবেদার একদলীয় সরকার গণতন্ত্রকে পাঠিয়েছিল নির্বাসনে। নির্যাতনে-নিপীড়নে যারপরনাই নিষ্পেষিত ছিল আমজনতা। কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ভোটের অধিকার। সরকারি দল ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড একরকম নিষিদ্ধই ছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক কার্যালয়। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনের নামে চলে প্রহসন যা জনমানুষের মনে চপেটাঘাত হানে। সবকিছু বুঝতে পেরেও বিদেশি শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হওয়া শিখণ্ডি সরকার রাষ্ট্রক্ষমতাকে জোর করে আঁকড়ে ধরে রাখে। সরকারের নতজানু নীতির কারণে দেশের সার্বভৌমত্ব দিন-দিন দুর্বল হয়ে পড়ে। ঘনিয়ে আসে দুর্দিন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হাঁসফাস করতে থাকে সাধারণ মানুষ। পুলিশ, প্রশাসন, বিচার, আইন, অর্থসহ প্রতিটি খাতকে যাচ্ছেতাইভাবে কব্জা করে নেয় হাসিনার সরকার। দুর্নীতি, অনিয়মের পাশাপাশি চলে লুটপাট। চলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থপাচার। মৌলিক অধিকার হরণের পাশাপাশি লাগামছাড়া দ্রব্যমূল্যে দুর্বিষহ হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন।
ফলে দেশকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে ছাত্র-জনতা। সৃষ্টি হয় রক্তে রঞ্জিত নতুন ইতিহাসÑ ৫ আগস্ট। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাঁক বদলের তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থানেই দৃশ্যত লাভবান হয়েছে বিএনপি। ১৯৭৫ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেও দলটির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাঈদ ইফতেখার বলছেন, দুটো গণঅভ্যুত্থানের পরে রাজনৈতিক শূন্যতার সুবিধা পেয়েছে বিএনপি। প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে সুযোগ বিএনপি পেয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, জন-বিদ্রোহ বা জনরোষের ফলে যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, সেটার রাজনৈতিক ফসল বিএনপি ঘরে তুলেছে।
বিপ্লব বিস্তীর্ণ রাজপথ কাঁপিয়ে দমকা বাতাসের মত পুরানো বিধি-ব্যবস্থা, ধ্যান- ধারনা ওলট-পালট করার আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। পুরনো জরাজীর্ণ অচলায়তন ভেঙ্গে-চুড়ে শাসক ও শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে নবরুপে উত্থান হয় বিপ্লবী সরকার। তবে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্র বিপ্লবের সূচনাপর্বে বস্তুগত উপাদানের বিরুদ্ধে অর্থাৎ বিরাজমান অনিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের লক্ষন দেখা দেয় এবং ক্রমান্বয়ে বিদ্রোহ সমূহ সামগ্রিক লড়াইয়ে পরিনত হয়ে শাসকগোষ্ঠীর পতন ঘটে এবং বিপ্লবী সরকার গঠন হয়। পরবর্তীতে বিপ্লবের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিষয়গত উপাদান তথা নতুন শাসনতন্ত্র প্রনয়ন করে পুরানো অচলায়তন ওলট-পালট করে বিপ্লবী কর্মসূচির বাস্তবায়ন পর্ব শুরু হয়।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে নানাভাবে চিত্রায়িত করা হয়। মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক, স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রভৃতি বিশেষণে তাকে ভূষিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের এই অধিনায়ক ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। স্থান করে নেন দেশের ইতিহাসেও। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
মার্কিন বিপ্লবী ফ্রেডেরিক অ্যালেন হাম্পটন সিনিয়র বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পথিকৃত হিসেবে বিশ^জুড়ে স্বীকৃত। তিনি বলতেন, তুমি একজন বিপ্লবীকে মেরে ফেলতে পারো, কিন্তু বিপ্লবকে মেরে ফেলতে পারবে না। সত্যিই তাই। বিপ্লব চিরঞ্জীব। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ইতিহাসও তাই অমোচনীয়, অনস্বীকার্য।
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস
ইতিহাস ও বাস্তবতায় জিয়াউর রহমান
শীর্ষ সংবাদ: