ড. শামীম আহমদে
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ, যে দেশটির জন্য ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলো। তবু আজও যখন আমরা চারদিকে তাকাই, তখন দেখি জাতির সেই প্রত্যাশিত ঐক্য এখনো সুদূরপরাহত। কেন এমন হলো? কেন স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা রাজনৈতিক বিভাজনের কাঁটাতারে বন্দি? এই প্রশ্নগুলো আমাদের জাতীয় পরিচয়ের গভীরে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের জন্ম আমাদের গর্বের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা এক অপ্রতিরোধ্য জাতি হিসেবে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, তোমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ তোমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু আমাদের সেই ঐক্য কতটা টিকেছে? স্বাধীনতার পরে রাজনৈতিক বিভাজন, ক্ষমতার লড়াই এবং মতবিরোধের ফলে জাতি ক্রমাগত বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জাতীয় স্বার্থ যে আমাদের কাছে কতটা গৌণ হয়ে পড়েছে, তা বোঝা যায় যখন আমরা রাজনীতির নামে একে অপরকে আক্রমণ করি এবং দেশকে টেনে নিয়ে যাই ধ্বংসের পথে। শুধু আমাদের দেশই নয়, রাজনৈতিক বিভেদ ও মতভিন্নতা পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ, তার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিভাজনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছে যে, ঐক্য ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়।
নির্বাচনের সময়কালীন প্রচার এবং পরবর্তী বিভাজনের প্রভাব দেশটিতে এমন এক সামাজিক অবস্থা সৃষ্টি করেছে, যা তাদের ঐক্য ও স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ওয়াশিংটনও বলেছিলেন, দলাদলি ও দলবাজি আমাদের মূল জাতীয় স্বার্থকে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। একইভাবে, ভারতের প্রধান নেতা মহাত্মা গান্ধী বলতেন, ঐক্যই আমাদের শক্তি, বিভাজনই আমাদের দুর্বলতা। তবু, আজকের ভারতেও জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজন সমাজের বিভিন্ন স্তরে গভীর প্রভাব ফেলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য এবং বিভাজন সমাজকে ঠেলে দিয়েছে এক অস্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে।
প্রশ্ন হলো, এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ কী? আমরা যদি রুয়ান্ডার ইতিহাস গভীরভাবে দেখি, সেখানে ১৯৯৪ সালের গণহত্যা ছিল মানবজাতির বিবেককে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো একটি ঘটনা। সেই সময়, জাতিগত সংঘর্ষে হুতু ও তুতসি সম্প্রদায়ের মধ্যে যে নিষ্ঠুর নির্মমতার প্রকাশ ঘটে, তাতে প্রায় ৮ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এমন ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির পরে মনে হয়েছিল, দেশটি হয়তো আর কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু রুয়ান্ডা দেখিয়েছে, সংকট যত গভীরই হোক না কেন, ঐক্য ও সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে পুনর্গঠন সম্ভব। পল কাগামে যখন দেশটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন তিনি জাতিগত সংহতি এবং সমাজে পুনর্মিলন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন।
স্থানীয় স্তরে গ্যাকাকা আদালত ব্যবস্থা চালু করা হয়, যেখানে অপরাধী ও ভুক্তভোগীরা মুখোমুখি হয়ে অপরাধের স্বীকৃতি ও ক্ষমা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেন। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশটির জনগণের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী স্মৃতি ছিল, তা ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে। সেই পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রুয়ান্ডা আজ আফ্রিকার দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে। আমরা যদি দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে তাকাই তাহলে বুঝব বর্ণবাদ কত গভীর বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে! সেখানকার ‘অঢ়বৎঃযবরফ’ (আপারথাইড) বা জাতিগত বৈষম্যভিত্তিক শাসনব্যবস্থার অধীনে দেশের কালো জনগোষ্ঠী বছরের পর বছর ধরে অত্যাচারিত হয়েছে।
কিন্তু যখন নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং দেশের নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন, তখন একটি নতুন দিনের আলোর সূচনা হয়। ম্যান্ডেলা জানতেন, শাস্তি বা প্রতিশোধ নয়, বরং সত্যের মুখোমুখি হয়ে এবং ক্ষমার মাধ্যমে দেশটিকে একত্র করতে হবে। তিনি ‘ঞৎঁঃয ধহফ জবপড়হপরষরধঃরড়হ ঈড়সসরংংরড়হ’ গঠন করেন, যেখানে মানুষ নিজের অপরাধ স্বীকার করলে তাকে ক্ষমা করা হতো। এই উদ্যোগ শুধু জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনেনি, বরং দেশের সামাজিক কাঠামোতেও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের জার্মানিকে মনে করলে এক ধ্বংসস্তূপের চিত্র ভেসে ওঠে। দেশটি শুধু বিধ্বস্তই হয়নি, বরং নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও বিভক্ত ছিল। নাৎসি শাসনের পাপ এবং অপরাধের বোঝা জার্মান জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল অপরাধবোধ আর লজ্জার ভার। কিন্তু যুদ্ধ শেষে জার্মানি এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। পশ্চিম জার্মানি গণতন্ত্র, শিক্ষার উন্নয়ন এবং নতুন প্রজন্মের জন্য নৈতিক শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের পুনর্গঠন করেছে।
সমাজে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলা এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম চালু করা হয়। এই প্রক্রিয়া জার্মান জাতিকে একত্র করে এবং ধীরে ধীরে দেশটি ইউরোপের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠে। তাদের পুনর্মিলনী এবং একীকরণের জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলো আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সামাজিক পুনর্গঠনের উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রুয়ান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জার্মানির গল্পগুলো আমাদের দেখায় যে, রাজনৈতিক বিভেদ, মতভিন্নতা ও সংঘাত থেকে উঠে এসে কিভাবে একটি জাতি তাদের জন্য নির্ধারিত চ্যালেঞ্জগুলোকে অতিক্রম করতে পারে।
তাদের পুনর্গঠনের গল্প শুধু তাদের দেশের নয়, বরং বিশ্বের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। ঐক্য, ক্ষমা এবং সংহতির শক্তি সমাজকে কিভাবে নতুন জীবন দিতে পারে তা এই দেশগুলোর ইতিহাস থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এই উদাহরণগুলো আমাদের শেখায় যে, রাজনৈতিক বিভাজন যত গভীরই হোক না কেন, মানবিকতা, সহিষ্ণুতা এবং একতার শক্তি তার চেয়েও বড়। অন্যদিকে যখন আমরা সিরিয়ার কথা ভাবি, তখন মনে পড়ে ২০১১ সালের সেসব দিনের কথা, যখন দেশটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য উত্তাল হয়ে উঠেছিল। সে সময় সিরিয়া ছিল মধ্যপ্রাচ্যের একটি সম্ভাবনাময় দেশ। প্রাকৃতিক সম্পদ, শিক্ষিত জনগণ এবং একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল, যা দেশের উন্নতির জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই আন্দোলনটি দ্রুত গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়, যেখানে সরকারবিরোধী এবং বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বে থাকা সরকার এবং বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে এই লড়াই মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি এবং দেশটির অবকাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সিরিয়ার ধর্মীয় গোষ্ঠী, যেমনÑ সুন্নি, শিয়া এবং কুর্দির মধ্যে সংঘাত এবং বহিঃশক্তির প্রভাব দেশটিকে এমন এক সংকটে ফেলেছে, যা আজও শেষ হয়নি। আজ সিরিয়া একটি ধ্বংসস্তূপ, যেখানে মানুষের মানবাধিকারের লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে।
ইয়েমেনের কথা ভাবুন, একটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ কিভাবে ধ্বংসের পথে চলেছে। ইয়েমেনের ইতিহাসে অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে হুথি বিদ্রোহের পর থেকে দেশটি এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের শিকার। সৌদি আরবের সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে যুদ্ধের জটিলতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। শিয়া এবং সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সংঘাত দেশটির সমাজকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। বহু বছর ধরে চলা এই সংঘাতের ফলে ইয়েমেনের অর্থনীতি এবং অবকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন দেশটির জনগণ অনাহার, রোগ এবং সহিংসতার শিকার।
ইয়েমেনের ইতিহাসের এই ভয়াবহ অধ্যায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কিভাবে রাজনৈতিক বিভেদ ও মতভিন্নতা এবং সংঘাত দেশের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে। আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারও একটি দুঃখজনক উদাহরণ। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন এবং জাতিগত নিধন মিয়ানমারের সম্ভাবনাকে মুছে ফেলছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা এবং তাদের দেশ থেকে বিতাড়ন আন্তর্জাতিক মহলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত। দেশের সামরিক শাসনের পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও, রোহিঙ্গা সংকট দেশটির সামাজিক শান্তি এবং ঐক্যকে নষ্ট করে দিয়েছে।
জনগণের মধ্যে বিদ্যমান অসহিষ্ণুতা এবং বৈষম্যের কারণেই মিয়ানমার আজ আন্তর্জাতিক মহলে একটি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। এই তিনটি দেশের উদাহরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কিভাবে রাজনৈতিক বিভেদ ও মতভিন্নতা এবং রাজনৈতিক লড়াই একটি দেশকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তারা সহিষ্ণুতার অভাব এবং সামাজিক অস্থিরতার শিকার হয়ে পড়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং দেশগুলোর ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে।
আবার ফিরে তাকানো যাক আমাদের নিজের দেশের দিকে। বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির দেশ, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন জাতি, ধর্ম এবং ভাষার লোকজন একসঙ্গে বসবাস করে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের উন্নয়নে আমাদের যে লক্ষ্য ছিল, সেই লক্ষ্য অর্জনে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। রাজনৈতিক বিভেদ ও মতভিন্নতা সেই বাধাগুলোর অন্যতম। স্বাধীনতা অর্জনের পর ৫৩ বছর অতিক্রম করার পরও আমরা দেখতে পাই রাজনৈতিক বিভাজন, জাতিগত সংঘাত এবং সামাজিক অস্থিরতা কিভাবে দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং তাদের অনুসারীদের মধ্যে ধারাবাহিক সংঘাত বিদ্যমান ছিল ও আছে। বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব গড়ে উঠেছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাজনৈতিক বিভাজন কেবলমাত্র ভোটের রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি জাতীয় ঐক্যের অভাব এবং জনগণের মধ্যে আস্থার সংকটে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি দলের একটি নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক আছে, যা তারা বিভিন্নভাবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এর ফলে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলো নিজেদের পক্ষে জনমত তৈরি করতে ধর্মীয় ও জাতিগত অনুভূতিকে ব্যবহার করছে, যা দেশের মধ্যে বিভাজন এবং অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। আমরা ২০০১ নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সহিংসতার কথা ভুলে যাইনি, যেখানে সংখ্যালঘু ও বিরোধী দলের ওপর অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন চলেছে। এটিও মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভেদ ও মতভিন্নতা শুধু রাজনৈতিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। সামাজিক অস্থিরতা এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাত এর বড় উদাহরণ। একাধিকবার দেখা গেছে, একটি বিশেষ জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হামলা হয়েছে, যার ফলে দেশে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।
এই ধরনের ঘটনা দেশের সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে বিঘিœত করে। আমরা ২০১২ সালে রাঙামাটির ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারি, যেখানে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের মধ্যে সহিংসতা ঘটে। এই সহিংসতার ফলে বহু মানুষের জীবন বিপন্ন হয় এবং সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হয়, যা দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে রাখা অশান্তির ফল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং জাতিগত সংঘাত আমাদের সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, যা মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের সাধারণ জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। এর ফলস্বরূপ, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাসের অভাব তৈরি হয়, যা একটি সমাজে অস্থিরতা ও বিভেদ বাড়িয়ে দেয়। এই বিভেদ কখনই কমেনি, বরং ক্রমশ বাড়ছে।
দেশের উন্নয়নের জন্য জরুরি হচ্ছে ঐক্য, সংহতি এবং মানবিক মূল্যবোধ। আমাদের উচিত রাজনৈতিক বিভেদ ও মতভিন্নতাকে অতিক্রম করে একসঙ্গে কাজ করা, যাতে বাংলাদেশ একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সময় এসেছে জাতি হিসেবে নিজেদের একত্রিত করা এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সমাজে সচেতন নাগরিক এবং তরুণদের উদ্যোগে ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মতো আমাদের প্রতিদিনের কাজে, কথায় এবং উদ্যোগে এমন চেতনা থাকা উচিত, যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম। আজকের তরুণরা দেশের ভবিষ্যৎ।
তাদের দেশপ্রেম, সদিচ্ছা এবং কর্মঠ মানসিকতা আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে। তরুণরা যদি সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে রাজনীতির বাইরে এসে নিজেদের ঐক্যের পথে নিয়ে আসে, তবে একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। জাতীয় ঐক্য কেবল কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করতে হয়। দেশের প্রতিটি মানুষকে রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে একে অপরের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। কেবল আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, বিজয়, ’৭২-এর সংবিধান, অসম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ভাবদর্শন-এই বিষয়গুলোতে একতা ধরে রেখে অন্য যেকোনো মতভেদ দূর করার ইচ্ছা থাকতে হবে। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট যেমন বলেছিলেন, ঐক্য শুধু তৈরি করলেই হয় না, তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।
নভেম্বর ৩, ২০২৪