মুসলিম বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তা হলো বিভেদ। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো আজ রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে একে অপরের থেকে আলাদা এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই বিভেদ শুধু মুসলিম বিশ্বের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে না বরং এটি এক ধরণের ক্যান্সারের মতো যা ধীরে ধীরে মুসলিম জাতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। মুসলিম জাতি ঐতিহাসিকভাবে একক, শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী ছিলো। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে একতা বজায় রেখে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু আজ এই ঐক্য বিভাজিত হয়ে পড়েছে। বিভেদের এই ক্যান্সার মুসলিম বিশ্বের ভিতর থেকে তাকে ক্ষয় করছে যা পুরো জাতির অগ্রগতি ও শক্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যার বড় উদাহরণ হলো গাজায় নৃশংস গণহত্যা চললেও তা বন্ধে মুসলিম বিশ্ব সম্মিলিতভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে পারে নাই। রাজনৈতিক প্রয়োজনে পশ্চিমা বিশ্ব আজকে মুসলিম বিশ্বের মাঝে বিভক্তি নামক ক্যান্সারের বিষবাস্প ছড়িয়ে দিয়েছে। যার চরম পরিণতি গাজাবাসী কে ভোগ করতে হচ্ছে।
মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিভেদের কারণ হলো ধর্মীয় ও স¤প্রদায়ভিত্তক মতপার্থক্য। মুসলিম সমাজে শিয়া ও সুন্নি মতাবলম্বীদের মধ্যে যে বিভেদ বিদ্যমান তা কোনো নতুন ঘটনা নয়। এই মতপার্থক্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের কারণে বহু মানুষ মারা গেছেন এবং দেশগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এই বিভেদের ফলে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং বিশ্বমঞ্চে নিজেদের অবস্থান হারাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আজ অনেকটা অবর্ণনীয়। প্রায় প্রতিটি দেশেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ক্ষমতার জন্য লড়াই চলছে। এই বিভাজন শুধু দেশগুলোর অভ্যন্তরে নয় বরং মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কেও পরিলক্ষিত হয়। রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং ক্ষমতার দ্ব›েদ্বর কারণে অনেক মুসলিম দেশ একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
অর্থনৈতিকভাবে মুসলিম বিশ্বের কিছু দেশ অত্যন্ত সমৃদ্ধ, যেমনÑ সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু একই সঙ্গে অনেক দেশ দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল যেমন ইয়েমেন, সোমালিয়া, সুদান। এই বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক বিভাজন মুসলিম বিশ্বের মধ্যে একটা ফাটল সৃষ্টি করছে। ধনী মুসলিম দেশগুলো প্রায়শই দরিদ্র দেশগুলোর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায় না এবং এর ফলে তারা পশ্চিমাদের ঋণের ফাঁদে পা দিয়ে রাজনৈতিক ও ক‚টনৈতিকভাবে পরাধীনতাকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে বিভেদ আরও গভীর হচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক বিভাজন। বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য অনুসরণ করে যা অনেক সময় একতাকে ক্ষুণ্ণ করে। মুসলিম বিশ্বের পশ্চিমা অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্কও অনেক ক্ষেত্রে নাজুক। তাছাড়া পশ্চিমা অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশও মুসলমানদের মাঝে সাংস্কৃতিক বিভাজন সৃষ্টি করেছে। আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্কও দুর্বল।
মুসলিম বিশ্বের বিভেদ শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয়েই সীমাবদ্ধ নয় এটি বহির্বিশ্বের কাছেও মুসলিম দেশগুলোকে দুর্বল করে তুলেছে। গৌরবগাথা মুসলিম শাসনের ঐতিহ্য বিলীনের পথে। আজ বিশ্ব রাজনীতিতে মুসলিম দেশগুলোর ভ‚মিকা অনেকটা কমে এসেছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধি সংখ্যা অনেক হলেও তাদের মধ্যে ঐক্যহীনতা রয়েছে। ফলে তারা গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের এই বিভেদ আরও বড় সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে। বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রসমূহের মধ্যেও মতপার্থক্য থাকে কিন্তু তারা নিজেদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা না করলে তারা ক্রমাগতভাবে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব হারাবে এবং তাদের নিজস্ব জনগণের কল্যাণেও অবদান রাখতে পারবে না।
বিভেদ একটি ধ্বংসাত্মক শক্তি যা মুসলিম বিশ্বের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। তবে এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এজন্য ধর্মীয় বিভেদ কমাতে আন্তঃধর্মীয় আলোচনা এবং সহনশীলতার শিক্ষা জোরদার করা প্রয়োজন। শিয়া ও সুন্নি উভয় স¤প্রদায়কেই একে অপরের প্রতি সহানুভ‚তিশীল এবং সহনশীল হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। রাজনৈতিক বিভাজন কমানোর জন্য একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক সংস্থা গঠন করা জরুরি বা যেগুলো আছে সেগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) বা এ ধরনের সংস্থাগুলোকে আরও কার্যকর ভ‚মিকা পালন করতে হবে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি এবং শিক্ষা খাতেও এ ধরনের সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে ধনী মুসলিম দেশগুলোকে দরিদ্র দেশগুলোর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এমন একটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে যা সকল মুসলিম দেশের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করবে এবং বৈষম্য দূর করবে। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো একতা এবং ভ্রাতৃত্ব। মুসলিম উম্মাহর উন্নয়নের জন্য সেই একতা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিভাজন শুধুমাত্র মুসলিম বিশ্বকেই দুর্বল করবে। বিশ্বের অন্যান্য শক্তিশালী জাতিগোষ্ঠীর মতো মুসলিম বিশ্বও যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তবে তারা আবারও বিশ্বমঞ্চে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।
পরিশেষে, বিভেদকে মুসলিম বিশ্বের ক্যান্সার বলা হলে তা একেবারে অত্যুক্তি করা হয় না। এই বিভেদ আজ মুসলিমদের জাতীয় উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা গেলে এই বিভেদ থেকে উত্তরণ সম্ভব। মুসলিম বিশ্বকে তাদের নিজস্ব স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এবং বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে অবদান রাখার জন্য একতাবদ্ধ হতে হবে। ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে বিভেদ নামক এই ক্যান্সারকে নির্মূল করে মুসলিম বিশ্ব আবারও নিজের গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারে।