.
আমার সোনার বাংলা যেন সবুজের স্বর্গ, যার মালী হচ্ছে কৃষক। কৃষক রোদ , বৃষ্টি বা ঝড়েও যেন অদম্য। আমরা কৃষকের কষ্টের ফলানো ফসল ভোগ করি আনন্দে। অন্যদিকে, কৃষক ভোগে অমর্যাদা ও অসচ্ছলতায়। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। তবে সমাজের বাস্তব চিত্র যদি আমরা দেখি, তাহলে সবচেয়ে বেশি যেটা দেখতে পাব তা হচ্ছে অব্যবস্থাপনা ও নৈতিকতার অধঃপতন যেন সর্বস্তরে। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বা পরাজয়ের গল্পটি মনে হয় বাংলাদেশের কৃষক ও বাজার ব্যবস্থা নিয়েই রচিত হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম যেমন বেড়েছে লাগামহীনভাবে, তেমনি কৃষকদের হতাশা বেড়েছে ন্যায্য মূল্যে ফসল বিক্রি করতে না পারায়।
প্রতিটি জায়গায় সিন্ডিকেট বেড়ে যাওয়ায় নানামুখী সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় নিম্ন আয়ের মানুষদের। বাংলার মানুষ দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে চায়। বাংলাদেশে আনুমানিক এক কোটি ৬৫ লাখ থেকে দুই কোটি কৃষক পরিবার তাদের সামাজিক মর্যাদা চায়। চায় রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে।
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু বাঙালি কৃষকের অসহায় ও দরিদ্র জীবনের তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। বাংলার কৃষক আজও শিক্ষাহীন, বস্ত্রহীন, চিকিৎসাহীন জীবন-যাপন করছে। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। কমেছে কৃষি জমির পরিমাণ। এ ছাড়াও অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ- কোনো কিছুই মোকাবিলা করার কৌশল ও সামর্থ্য কৃষকের প্রায় নেই। তাই কৃষকের শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তন হয় না। তবু কৃষকরা বহুকাল ধরে অবহেলিত। বিশেষ করে তাদের সামাজিক মর্যাদা এখনো নিম্নমানের।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় কৃষকদের জীবনযাপন অনিশ্চিত ও স্থবির হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময়ের পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকদের এখন পথে বসার উপক্রম। কৃষকের মধ্যে অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন ঋণের জালে।
কেউবা জমি বর্গা নিয়ে জমি চাষ করেছেন। ফসল বিক্রি করে ঋণের কিস্তি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন ঋণ শোধ তো দূরের কথা, সংসার চালানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। প্রাচীনকালে এ দেশে জনসংখ্যা ছিল কম, জমি ছিল বেশি। উর্বরা জমিতে প্রচুর ফসল হতো। তখন শতকরা ৮৫ জনই ছিল কৃষক। তাদের গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা থাকত মাছে। তাদের জীবন ছিল সুখী ও সমৃদ্ধ। তারপর এলো বর্গির অত্যাচার, ফিরিঙ্গি-পর্তুগিজ জলদস্যুদের নির্যাতন, ইংরেজদের খাজনা আদায়ের সূর্যাস্ত আইন, শোষণ ও নিপীড়ন। এলো মন্বন্তর, মহামারি। গ্রাম-বাংলা উজাড় হলো। কৃষক নিঃস্ব হয়ে গেল। সম্পদশালী কৃষক পরিণত হলো ভূমিহীন চাষিতে। দারিদ্র্য তাকে কোণঠাসা করল। কৃষকের জীবন হয়ে উঠল বেদনাদায়ক।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান হওয়ায় কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ দেশ ভরে ওঠে ফসলের সমারোহে। কৃষকের উৎপাদিত ফসল বিদেশে রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। বলতে গেলে, কৃষকই আমাদের জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি। আমাদের জাতির প্রাণ। কবির ভাষায়, সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।
গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরুর যে ঐতিহাসিক মিথ কোনো কালপর্বেই তার নজির খুব একটা পাওয়া যায় না। বরং চর্যাপদের ‘হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী’ কিংবা অন্নদামঙ্গলের ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’- এ আকুতিই শোনা যায় শতাব্দীর পর শতাব্দীতে। কিন্তু কৃষকের উৎপাদিত ফসলের উদ্বৃত্ত নিয়েই পাল, সেন, খিলজি, মোগলদের শানশওকত বেড়ে উঠেছিল। কৃষকের এ দুর্দশা স্থায়ী রূপ পেয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাতে চালু হওয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। এর ফলে, ব্রিটিশ শাসক ও বাংলার কৃষকদের মাঝে কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রভু, জমিদার, জোতদার, নায়েব, বরকন্দাজ সবার ‘খাই’ মেটাতে উৎপাদক শ্রেণি কৃষক হয়ে পড়েছিল নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সবখানেই যেন কৃষকরা অবহেলিত থেকে গেছেন। জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধি নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর কৃষকদের জন্য আলাদা সংগঠন থাকলেও তাতে কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে, কৃষকের কণ্ঠস্বর কোথাও শোনা যায় না। তরুণ কৃষক সিরাজুলের কাছে তার প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, লাভসহ নিজের উৎপাদিত ফসলের মূল্য চান (সহায়ক দাম)। প্রয়োজনের সময় কৃষি ব্যাংক থেকে চান ঋণ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (ইইঝ) কৃষি শুমারি অনুযায়ী, বেশিরভাগ কৃষকের নিজস্ব জমি নেই, তারা অন্যের জমিতে কাজ করেন। সাম্প্রতিক কৃষি শুমারিতে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশের বেশি কৃষক প্রান্তিক কৃষক বা ভূমিহীন। গ্রামীণ কৃষক পরিবারের আয় তুলনামূলকভাবে কম। তারা প্রায়ই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। দারিদ্র্যের হার কৃষকদের মাঝে বেশি, বিশেষ করে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে। বেশিরভাগ কৃষক পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। মৌসুমের ওপর নির্ভরশীলতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা প্রায়ই খাদ্যের ঘাটতির সম্মুখীন হন।
কথার সারাংশ হলো, কৃষকদের আর্থ-সামাজিক মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যেন কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের নায্য মূল্য পায়। একই সঙ্গে বাজার ব্যবস্থায় বিদ্যমান সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য করতে হবে সহজলভ্য। এই দায়িত্ব সরকার সংশ্লিষ্ট সকলকেই নিতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করতে হবে। সর্বস্তরের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।