ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

ই-কমার্স এবং ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:০২, ৪ নভেম্বর ২০২৪

ই-কমার্স এবং ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স

.

ই-কমার্সের সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। ই-কমার্স বা ইলেকট্রনিক কমার্স হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যবসা বা ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম। এটি বিভিন্ন প্রকারের পণ্য বা সেবার ক্রয়, বিক্রয়, অর্থ লেনদেন ও ডাটা আদান-প্রদান ও পরিবহনসহ অন্যান্য কার্যক্রম অন্তভুক্ত করে। ই-মেইল, ফ্যাক্স, অনলাইন ক্যাটালগ, ইলেক্ট্রনিক ডাটা ইন্টারচেঞ্জ (ইডিআই), ওয়েব বা অনলাইন সার্ভিসেস ইত্যাদির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।

সাধারণত ই-কমার্স সুসম্পন্ন হয় এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আরেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের (বি টু বি) মধ্যে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তার (বি টু সি) মধ্যে, ভোক্তা ও ভোক্তার (সি টু সি) মধ্যে। এক কথায়, প্রায় স্বয়ংক্রিয় আদান-প্রদানের এই বিপণন প্রক্রিয়ার নাম হচ্ছে ই-কমার্স। বিশ শতকের শেষ ভাগে উন্নত দেশগুলোতে ডিজিটাল বিপ্লব শুরু হলেও একুশ শতকে এসে তা উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তির বিস্ময়কর এই সম্প্রসারণ বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আধুনিকতা ও নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে,  যা ই-কমার্স নামে সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তির সুবিধা শহর ও গ্রাম পর্যন্ত ধীরে ধীরে বিস্তৃত হতে থাকে এবং ই-কমার্স সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি হয়। বর্তমানে তৃণমূলের মানুষও এতে সম্পৃক্ত হতে শুরু করেছে। তারা এখন বোঝে ই-কমার্স মানে অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাকাটা, ঘরে বসে সরকারি সেবা পাওয়া, নগদ ও বিকাশে টাকা লেনদেন করা এবং কোভিডকালে কিভাবে জীবনযাত্রা সচল ছিল ইত্যাদি। ই-কমার্সের সুবিধা হলো, এখানে পুঁজি লাগে কম, ইচ্ছাশক্তি, সৃজনশীলতা ও পরিশ্রমই ই-কমার্স ব্যবসার সবচেয়ে বড় পুঁজি। তবে ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা, সেবাদাতা, ব্যাংক, নীতি নির্ধারক, থার্ড পেমেন্ট প্রসেসর এবং সর্বোপরি ক্রেতা বা ভোক্তা-সকলকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে আর্থিক লেনদেন কার্যক্রম পরিচালনাই হচ্ছে ই-কমার্স।
অন্যদিকে, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে ই-কমার্সের প্রসার কোনো নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। দেশের অভ্যন্তর থেকে শুরু করে বহির্বিশ্বেও পণ্যের লেনদেন এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। একইভাবে চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক পণ্যও দেশে এনে গ্রাহককে সরবরাহ করাও হচ্ছে সাধারণ ব্যবসার মতোই। একইভাবে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে  অনলাইনে পণ্য বেচাকেনা  হলেই তাকে ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স বলা হয়ে থাকে।

অন্যভাবে বলা যায়, ক্রেতা বা বিক্রেতা যদি ভিন্ন ভিন্ন দেশের হয়ে থাকেন, সেটিই ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স হিসেবে বিবেচিত। এই ব্যবস্থার ফলে বিশ্বব্যাপী সরাসরি গ্রাহকের কাছে নিজেদের পণ্য বিক্রি, নিজের ব্র্যান্ড বিশ্বদরবারে তুলে ধরার সুযোগ, বিদেশে চাহিদাসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের সুযোগ, বিশেষ ঋতুর ওপর নির্ভরশীল না থেকে সারাবছর পণ্য বিক্রির সুযোগ ইত্যাদি তৈরি হয়। কিন্তু ডিজিটাল ডিভাইস ও ইন্টারনেটের অবাধ সুযোগে বাংলাদেশের ই-কমার্স উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসা করছেন একটা দেশীয় গ-ির মধ্যেই।  বিশ্ববাজারে আমাদের রেডিমেড গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, মাছ, চিংড়ি, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, ওষুধ, প্লাস্টিক ও পাটজাত পণ্য, শিপিং, সিরামিক, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক পণ্য, কাগজ ও কাগজজাত পণ্য, স্টিল ও স্টিলজাত পণ্য, রাসায়নিক পণ্য, খেলনা ইত্যাদির ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার কারণে আমাদের দেশীয় উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য বিশ্ব বাজারে উপস্থাপন করতে পারছেন না। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশুগুলোর মধ্যে অনেকেই তাদের দেশীয় পণ্য বিদেশে বিক্রি করে জাতীয়ভাবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
সাধারণ ই-কমার্সের মতোই ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সে আছে অনেক সুবিধা ও অসুবিধা। সুবিধাগুলো হলো- ১. প্রসারিত বাজারের নাগাল- ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স ব্যবসাগুলোকে সম্ভাব্য গ্রাহকদের বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর অনুমতি দেয়। ২. বর্ধিত বিক্রয়- ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স ব্যবসাগুলোকে তাদের বিক্রয় বাড়াতে এবং তাদের ব্যবসা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে। ৩. ব্র্যান্ড সচেতনতা- ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স ব্যবসাগুলোকে নতুন বাজারে ব্র্যান্ড সচেতনতা এবং স্বীকৃতি তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। ৪. প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা: ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স ব্যবসাগুলোকে তাদের দেশীয় প্রতিযোগীদের তুলনায় একটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দিতে পারে, ইত্যাদি। অসুবিধাগুলো হলো- ১. জটিলতা- ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স জটিল হতে পারে। কারণ এতে বিভিন্ন মুদ্রা, প্রবিধান এবং শিপিং প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কাজ করা জড়িত। ২. প্রতিযোগিতা- ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স বাজার ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে, যেহেতু আরও বেশি ব্যবসা বাজারে প্রবেশ করছে। ৩. শিপিং খরচ- আন্তঃসীমান্ত ই-কমার্স ব্যবসার জন্য শিপিং খরচ বেশি হতে পারে, বিশেষ করে এমন ব্যবসার জন্য যেগুলো ছোট বা ভারী আইটেম পাঠায়।
তবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হলো, এখনো এ সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি।  জরুরী ভিত্তিতে যেসব নীতিমালা উপনয়ন করা দরকার তা হলো- ১. ক্রসবর্ডার লজিস্টিক নীতিমালা- যাতে খুব সহজে পণ্য টেস্টিং, লাইসেন্সিং ও শিপিংয়ের সহায়তা পাওয়া যায়। ২. পেমেন্ট রিসিভ করার পদ্ধতি সহজীকরণ- বৈশ্বিক পেমেন্ট সিস্টেম তৈরি বা এ্যাডাপ্ট করার মাধ্যমে ছোট বড় সকল প্রকার বৈদেশিক পেমেন্ট রিসিভের সুবিধা প্রদান করা।  ৩.ডিজিটাল মার্কেটিং পেমেন্ট সহজীকরণ- কাস্টোমারকে রিচ করতে প্রয়োজনীয় ডিজিটাল মার্কেটিং ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈদেশিক পেমেন্টে বিশেষ সুবিধা দেওয়া।  ৪ .সহায়তা ও প্রণোদনা- বিক্রীত পণ্যের ওপর বিভিন্ন প্রকার ইনসেন্টিভ প্রদান করা ইত্যাদি।
ব্যবসায়িক সফল বিশ্বের কয়েকটি ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হলো-  ১. অ্যামাজন- অ্যামাজন বিশ্বের বৃহত্তম ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে একটি এবং এটি ২০০টির বেশি দেশ এবং অঞ্চলগুলোতে ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সে (আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য) অফার করে।  ২. ইবে (eBay)- ইবে আরেকটি জনপ্রিয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, যা ক্রস-বর্ডার শিপিং অফার করে। ইবে বিক্রেতারা সারাবিশ্বে ক্রেতাদের কাছে বিক্রির জন্য তাদের আইটেম তালিকাভুক্ত করতে পারে। ৩. শপিফাই (Shopify)- এটি এমন একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, যা ব্যবসাগুলোকে তাদের নিজস্ব অনলাইন স্টোর তৈরি করতে দেয়। শপিফাই অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য অফার করে, যা পণ্য এবং পরিষেবাগুলোকে আন্তঃসীমান্ত বিক্রি করা সহজ করে তোলে। যেমন- বহুভাষিক এবং বহুমুদ্রা সমর্থন। ৪. আলিবাবা একটি বহুজাতিক ক্রস বর্ডার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম  (পাইকারি, ইন্টারনেট, প্রযুক্তি বিক্রয়কারী কোম্পানি) যেটি ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ক্রেতা-ক্রেতা,ব্যবসায়ী-ক্রেতা,ব্যবসায়ী-ব্যবসায়ী পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে থাকে। ৫. দারাজ- দারাজ হলো দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সক্রিয় একটি ক্রস বর্ডার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম।  দারাজ ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তানে।

রকেট ইন্টারনেটের উদ্যোগে মুনীব ময়ূর (প্রতিষ্ঠাতা), ফারেস শাহ্ (সহ-প্রতিষ্ঠাতা) একে অনলাইন ই-কমার্স ফ্যাশন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও নেপালে তারা পরিষেবা প্রদান করে থাকে। রকেট ইন্টারনেট ২০১৮ সালে চীনের আলিবাবা গ্রুপের কাছে ই-কমার্স কোম্পানি দারাজ গ্রুপকে বিক্রি করে দেয়।
বর্তমান বিশ্বের দ্রুততম উন্নয়ন হিসাবে, সর্বশ্রেষ্ঠ  বিনিয়োগ, সম্ভাবনা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের নতুন এক শক্তিশালী  মাধ্যম হলো ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স । বিশেষ করে জটিল এবং অস্থির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিবেশে ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স একটি উচ্চ প্রবৃদ্ধির  নিরাপদ নিশ্চয়তাসহ বিশ্ব অর্থনীতিকে  গতিশীল ও চাঙ্গা রাখার এক দুর্দান্ত মাইলফলক হিসেবে দেখা দিয়েছে। পরিসংখ্যান মতে, ই-কমার্স এবং ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সে বিশ্বের অর্ধেকের মতো দখল করে আছে চীন। ২০২১ সালে যেটির মূল্যমান ছিল প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার। অন্যদিকে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ই-কমার্সের শতকরা ৪০ ভাগ ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স। ২০২২ সালের মধ্যে শুধু থাইল্যান্ডের ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের আকার হবে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এক কথায় বলা যায়, এটি একটি দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প, যার বিশ্বব্যাপী বিক্রয় ২০২৭ সালের মধ্যে বহু ট্রিলিয়নে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের কাক্সিক্ষত প্ল্যাটফর্ম এখন সময়ের দাবি।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

×