.
বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশ। পুরনো সংস্কার আর অপসংস্কারে আবর্তিত হরেক সমস্যা সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে। যে কোনো সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি সময়ের চাহিদা আর যুগের আবেদনে পরিবর্তনশীল এক নব দিগন্তের পালাক্রম। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন পুরনো সমাজের জরাজীর্ণ পালাক্রম আর নতুন সময়ের আধুনিক সংস্কারের নবযাত্রায় সভ্যতা এগিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিকভাবেই দীপ্যমান। সেটা অতি আদিম কৌম ব্যবস্থার বন্যদশা থেকে আধুনিক শিল্পোন্নত প্রযুক্তির বলয়কে সময়ের অনুগামী করেছে। নতুন সমাজের প্রাসঙ্গিক উপাদান তৈরি হয় পুরনো ব্যবস্থার মূল শিকড়ে। তারপর শুরু হয় ভাঙা-গড়ার নিত্য নৈমিত্তিক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আবহ।
নতুন করে সমাজের গতি ফেরাতে কত সমস্যা আর ক্ষতচিহ্ন সামনে এসে যায় তাও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এক অবধারিত গতি প্রবাহ। বাংলাদেশ অতিক্রম করছে আগামীর রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় এক ক্রান্তিকাল। দেশকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে ও গড়ে তুলতে উদীয়মান সচেতন প্রজন্ম অগণিত শিক্ষার্থী আন্দোলনে রাস্তায় নেমে আসে।
সময়ের নতুন আবহে চাহিদা যেমন বাড়ছে পাশাপাশি নানামাত্রিক অপকৌশল দৃশ্যমান হতে দেরি লাগছে না। প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক দাবি-দাওয়ার স্রোতে দেশ এখন নাকাল। তবে সাত কলেজকে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করে তার অধিভুক্ত করার দাবিতে শিক্ষার্থীদের যে লাগাতার কর্মসূচি তাতে বিপাকে পড়েছে রাজধানী। এমনিতে যানজটে তীব্র অস্বস্তিতে বেসামাল ঢাকা। সেখানে বাড়তি আন্দোলনের চাপে নগরবাসীর যে নাভিশ্বাস তা সত্যিই দুর্ভোগ-দুর্গতির অসহনীয় চিত্র। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া যৌক্তিক, প্রাসঙ্গিক হলেও উত্তরণ অত সহজসাধ্য নয়। অতি অবশ্যই তা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কলেজগুলো ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মযোগ অব্যাহত রাখাও শিক্ষা কার্যক্রমকে যথা নিয়মে ও সময়ে এগিয়ে নেওয়া। এমনিতে আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষার্থী সমাজের যে ক্ষতিসাধন হয়েছে তা পোষাতে যে কত সময় লাগবে তা ধারণা করাও মুশকিল। তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেশন জটে আক্রান্ত। সঙ্গত কারণে নতুনভাবে এই সময়ক্ষেপণ শিক্ষা ব্যবস্থায় নানামাত্রিক বিপন্নতা তৈরি করবে। সে কারণে অগণিত শিক্ষার্থীকে বিদ্যমান নিয়মনীতিতে পাঠক্রম চালিয়ে যাওয়াও প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা। এর অন্যথায় শুধু সেশন জটই নয়, শিক্ষাক্রমেও বাড়তি চাপ তৈরি হবে।
সেখানে সামান্য অস্বস্তি কিংবা বিচ্যুতি শিরদাঁড়া উঁচু করতে বিঘ্ন তৈরি হতে পারে। তাই শিক্ষা কর্মযোগে অনাবশ্যক কিংবা অনাকাক্সিক্ষত কোনো চাপই জাতি গড়ার আধুনিক স্থপতিদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। ২০১৭ সালে তৎকালীন সরকার ঢাকার সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে দেয় সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক সম্মতি ছাড়াই কেবলমাত্র সরকারি আদেশ বলে। গত ৭ বছর ধরে এমন নিয়মানুগ প্রথার অনুবর্তী হয়ে কলেজগুলো তাদের শিক্ষা পাঠ থেকে পরীক্ষা কার্যক্রম সবই চালাতে থাকে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত থাকা অবস্থায় পাঠক্রম, পরীক্ষা পদ্ধতি যা ছিল তার কোনো ব্যতিক্রম করা হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার পরও। তবে সাত কলেজের বাড়তি চাপ অতি অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত এই স্বনামখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠই নয় বরং শিক্ষার্থী সংখ্যায়ও অনেকখানি এগিয়ে। তবে সাত কলেজের দায়িত্ব গ্রহণে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠটি যথার্থ পারদর্শিতা দেখিয়েছে। সেখানে বিভিন্ন সময় দায়িত্বভারে চাপে থাকার বিষয়টিও সামনে এসে যায়। তৎকালীন সরকার কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি না নিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নেয় তা তথ্য উপাত্তে জানা যায়। যা নাকি শুধু অপরিকল্পিতই নয়, বরং অপরিণামদর্শিতাও বটে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারণী বিষয়ে তেমন কোনো তারতম্য দৃশ্যমান হয়নি বলে ওজর আপত্তিও ওঠেনি।
তবে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা দেশের অন্য কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং সাত কলেজের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে রাজপথে নামে। তীব্র যানজটের রাজধানী যে মাত্রায় বেহাল দশায় পড়ে সেটাও আর এক নাজেহাল হওয়ার দুরবস্থা। তবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে থেকেও তাদের লেখাপড়ার মান সেভাবে বাড়েনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়হীনতা আর যথাযথ সংযোগের অভাবে অনুকূল পরিস্থিতির প্রভাব সেখাবে দৃশ্যমান না হওয়াও উচ্চ শিক্ষায় যথার্থ পারদর্শী হতে কিছুটা পিছু হটতে হয়। ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা মেধা ও মননের যোগ্যতম সোপানে অবস্থান করে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় টানাপোড়েনে অসঙ্গতি ছাড়াও পাঠক্রমেও ঘাটতি হয়েছে, যা পরবর্তী ফলাফলকে বিঘ্নিত এবং শিক্ষার্থীদের নিরাশ করেছে। নিয়ম-নীতির ব্যত্যয় হয়নি বলেও তথ্য উপাত্তে দৃশ্যমান। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাফিলতি, উদাসীনতায় কলেজগুলোও নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যেতে বারবার পিছু হটেছে। দ্বৈত শিক্ষা কার্যক্রমে যথার্থ পাঠদান, পরীক্ষণ সবই বিঘ্নতার আবর্তে পড়েছে। সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বিভাগভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষকের ঘাটতি মূল পাঠক্রমকে শিক্ষার্থীদের কাছে যথার্থভাবে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। সঙ্গত কারণে ঢাকা শহরের স্বনামখ্যাত কলেজগুলো নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক মানটাও ধরে রাখতে বিভিন্ন সময় পিছু হটে।
তার ওপর উচ্চ শিক্ষার আর এক বৃহত্তর সোপান তথ্য উপাত্ত সমন্বয়ে গবেষণা কর্ম চালু রাখা। সুযোগের অপ্রতুলতাকেও দায়ী করছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা। শ্রেণিকক্ষের সংকটও মাথা চাড়া দেওয়ার মতোই। নির্দিষ্ট শ্রেণি পাঠের সময় বিঘিœত হওয়ার আর এক বিরূপ প্রতিবেশ। পর্যাপ্ত গবেষণাগারের ঘাটতি ও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কারণ হয়েছে। হল, হোস্টেলসহ আবাসন সংকট ও শিক্ষার্থীদের অস্বস্তির কারণ হয়েছে। পরিবহন সমস্যা সব সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক চরম দুর্ভোগ। যা কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাঙ্গনেই বরং সবার বেলায় এমন সত্যই প্রচলিত, প্রকাশিতও। ফলাফল প্রকাশেরও যথেষ্ট বিলম্ব হয় বলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের চরম ওজর আপত্তি। এ ছাড়া সিলেবাস একটা নিয়মিত পাঠ্যক্রমের নিয়ামক, অনুষঙ্গ। সেখানেও শিক্ষার্থীরা অস্বস্তিতে পড়ার দৃশ্য সহনীয় অবস্থায় থাকে না। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নও নাকি প্রশ্নবিদ্ধ। সঠিকভাবে মান যাচাইয়ে ঘাটতি থেকেই যায়। পরীক্ষার ফল নিম্নমানের হলে পুনরায় হলে বসে পরীক্ষা দেওয়া প্রচলিত বিধি। সঙ্গে থাকে আবারও ফি দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক রীতি। সেখানেও অনিয়ম করে বেশি টাকা নেওয়ার তথ্য উঠে আসাও অনাকাক্সিক্ষত বিষয়। তাই সাত কলেজের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জরুরিই নয় বরং অনিবার্য। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা এক সঙ্গে আওয়াজ তুলছেন বিভিন্নভাবে তারাও বৈষম্যের শিকার। সঙ্গত কারণে জাতীয় কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং বিধিবদ্ধ উপায়ে সাত কলেজেরই নিজের আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় থাকা বাঞ্ছনীয় শিক্ষার্থী আর প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে।
এমন যৌক্তিক আন্দোলন থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সরে দাঁড়াবে না। এটা তাদের ন্যায্য এবং যৌক্তিক প্রত্যয়। শিক্ষা ব্যবস্থা কিংবা পাঠক্রম নিয়ে কোনো অবহেলা, উদাসীনতা একেবারে নয়, বরং জাতির মেরুদ-কে শিরদাঁড়া উঁচু করতে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়াকে মান্যতা দেওয়াও সময়ের দাবি। সেটা একমাত্র সম্ভব সাত কলেজের জন্য আলাদা একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তাদের আগামীর ভবিষ্যৎ সফল করা যা বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশের জন্য এক অভাবনীয় কর্মদ্যোতনা। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন দাবিকে সমর্থন করেছে। শুধু আমলে নিয়ে নয়, বরং উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টিও জানানো হয়েছে। তবে একদিনে তা সম্ভব নয়। সময় সাপেক্ষ কার্যক্রমের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যাতে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াও এক অপরিহার্য বিধি। তবে দাবি বিবেচনায় রেখে শিক্ষার্থীদের ধৈর্য সহকারে শ্রেণি কক্ষে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানান শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। তবে শিক্ষার্থীরাও জানান দেয়, তারা যথার্থ দাবি পূরণ ছাড়া অন্য কিছুতে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াবে না।
একই দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আলটিমেটাম দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সেই সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের প্রাসঙ্গিক দাবি। বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেবার হুমকিও আসে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, সাত কলেজের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আলাদা ব্যবস্থা করা হবে। আলাদা প্রশাসনিক ভবনে রেজিস্ট্রারসহ সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা কর্মচারীও যুক্ত হবেন। কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত থেকে অবিচ্ছিন্ন থাকবে। তবে শেষ অবধি সব আলোচনা, পর্যালোচনাকে প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিতে অনড় থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করে সাত কলেজের জন্য ন্যায্য দাবি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ঐকমত্য পোষণ করেছেন। দাবি আদায় না হওয়া অবধি আন্দোলন প্রত্যাহার করা হবে না বলেও হুশিঁয়ারি আসে।
লেখক : সাংবাদিক