যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে ২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) গঠিত হলেও শিক্ষক নিয়োগ হতো ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে। ২০১৫ সালে ম্যানেজিং কমিটির শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ করে এনটিআরসিএ’র সব শর্তে উত্তীর্ণদের নিয়োগের উদ্দ্যোগ নেওয়া হয়।
হাইকোর্টের নির্দেশে উত্তীর্ণ ১-১২তম, বিশেষ ১০তম এবং ১৩তমদের নিয়ে জাতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। ১-১২তমদের (এন্ট্রিলেভেল মার্ক-৪০ পেলেই নিয়োগ যোগ্য বিবেচিত হওয়ায়) অতিরিক্ত মার্কের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। হাইকোর্টের নির্দেশে পরবর্তীতে তালিকা আপডেটের নামে পর্যায়ক্রমে ১-১৭টি ব্যাচের সকলকে এড করা হয়।
কিন্ত সুপারিশ প্রাপ্ত ইনডেক্সধারীদের তালিকা বর্হিভ‚ত করা হয় না। এদিকে সুপারিশ প্রক্রিয়া এনটিআরসিএ’র হাতে আসায় ১৩তম, ১৪তম, ১৫তম, ১৬তম ১৭তমরা প্রতিযোগিতা করে বেশি নাম্বারসহ উত্তীর্ণ হয়ে সুপারিশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগায় এবং প্রায় সকলেরই নিয়োগ হয়ে যায়।
পিক এন্ড চুস পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক নিয়োগ সুপারিশ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় প্রার্থী হাজার হাজার আবেদনের বিপরীতে কেউ কেউ ৪০ মার্কেও চাকরি পেয়েছে, আবার কেউ কেউ ৮০ মার্ক পেয়েও হয়েছে নিয়োগ বঞ্চিত। শিক্ষকদের নিয়োগে হাজার-হাজার আবেদনের পরও প্রতিবারই দুই-তৃতীয়াংশ পদ শুন্য থাকে এবং নিয়োগ প্রার্থীরা বারবার বঞ্চিত হয়।
শিক্ষক নিবন্ধন সনদ, শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনো কাজে আসবে না। এছাড়াও এন্ট্রিলেভেল শিক্ষকদের সাথে ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ইনডেক্সধারী কর্তৃক অধিকাংশ পদ পূরণ হয়, এন্ট্রিলেভেল শিক্ষক বঞ্চিত হয় এবং কৃত্রিম শিক্ষক সংকট তৈরি হয়।
এনটিআরসিএ’র এ কৌশলগত চরম রসিকতার বিরুদ্ধে নিবন্ধিত শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে শিক্ষক নিয়োগের অনুসরণীয় প্রদ্ধতির ৭ নং পয়েন্ট (ইনডেক্সধালীদের আবেদনের সুযোগ) স্থগিতের মাধ্যমে এন্ট্রিলেভেলের শিক্ষক দ্বারা সকল পদ পূরণের লক্ষ্যে নিয়োগ আবেদনেরও পরিবর্তন আনে এনটিআরসিএ।
একজন প্রার্থী স্কুল-কলেজ এই দুই লেভেলের জন্য দুইটি আবেদন করতে পারবেন এবং প্রত্যেক আবেদনের বিপরীতে চল্লিশটি প্রতিষ্ঠান চয়েস থাকবে। কেউ কলেজ নিবন্ধনের বিপরীতে নির্বাচিত না হলে স্কুল নিবন্ধনের বিপরীতে বিবেচনা করা হবে। এই দুইটি প্রক্রিয়ায়ও যদি নির্বাচিত না হয় তবে, শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে সারা বাংলাদেশের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে ইচ্ছুক হলেও থাকবে ‘‘ইয়েস অপশন’’।
কিন্ত চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির প্রাথমিক সুপারিশে দেখা গেল, ৬৮ হাজার শুন্য পদে সুপারিশ পেল মাত্র ২৭ হাজার, চূড়ান্ত নিয়োগ পেল আরও কম। আবারও পদ ফাঁকা থাকল ৪০ হাজারের উপরে। ধরা যাক- ‘ক’ নামক ব্যক্তি স্কুল ও কলেজ উভয় নিবন্ধনের বিপরীতে আবেদন করেছে। ‘ক’-এর আবেদনকৃত কলেজ শাখার ৯টি প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল শাখার ১১ টি প্রতিষ্ঠানে পদ ফাঁকা থাকে।
৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতেও শিক্ষক চাহিদার আবেদন নেওয়া হচ্ছে ঐ ফাঁকা পদগুলোর জন্য। এক আবেদনের ৪০টি চয়েজ এর মধ্যেই যদি পদ ফাঁকা থাকে তাহলে ‘‘ইয়েস অপশন’’ রাখার যৌক্তিকতা কী? এছাড়াও একাধিক ব্যক্তির এবং একাধিক ব্যাচের একই বিষয়ের একই রোল রয়েছে। রোল একই হওয়ায় প্রকৃত পক্ষে উচ্চমার্কের ( বৈধ বা অবৈধ সনদে একই) ব্যক্তি বারবার সুপারিশ প্রাপ্ত হন এবং একই রোলের বাকিরা প্রতিবারই নিয়োগ সুপারিশ বঞ্চিত হয়। এ রকম গল্প শুধু ‘ক’-এর একার নয়।
নিবন্ধন পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণদের সনদ প্রদান করে সনদ প্রদানকে ব্যবসায়ে রূপান্তর করেছে এনটিআরসিএ।
বর্তমানে এমপিও নীতিমালা অনুসারে ৩৫ ঊর্র্ধ্বদের শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। যোগ্যতার সব শর্তে উত্তীর্ণদের এন্ট্রিলেভেল বয়স বিবেচ্য হচ্ছে না, ১২ জুন ২০১৮ তারিখের আগে যারা নিবন্ধন সনদ পেয়েছেন. তাদের ক্ষেত্রে বয়স শিথীলযোগ্য সেটাও মানা হচ্ছে না।
যথেষ্ট শূন্যপদ থাকার পরও শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও আর্থিক লেনদেনের উদ্দেশ্যে সিষ্টেম-দুর্নীতির মাধ্যমে এনটিআরসিএ’র নিবন্ধিত শিক্ষকদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। পদ ফাঁকা থাকুক বা রাখা হোক, আবেদন করেও যারা সিস্টেম-দুর্নীতির কারণে নিয়োগ বঞ্চিত তাদের তাদের বয়স কী থেমে থাকবে? তাছাড়া নিবন্ধিতদের এন্ট্রিলেভেন বয়স কেন বিবেচ্য নয়, সেটা বড়ই রহস্যজনক।
ইতোমধ্যে নিবন্ধন সনদ অর্জন করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও স্বেচ্ছাচারিতায় বারবার নিয়োগ বঞ্চিত তাদের নিয়োগের সুব্যবস্থা না করে, নতুন করে পরীক্ষা নিয়ে প্রার্থী খুঁজে তাদের দ্বারা পূর্ববর্তী শূন্য পদগুলো পূরণ করতে পাশের হার বৃদ্ধি করা বা কাটমার্ক কমানো শুধু অমানুবিকই নয়, উদ্দেশ্য প্রণোদিতও বটে।
শিক্ষক সংকট দূর করতে এনটিআরসিএ’র হাতে পর্যাপ্ত শিক্ষকও আছে। বছরের পর বছর চাহিদা দিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক পাচ্ছে না। অপরদিকে এনটিআরসিএ’র ৬০ হাজার সনদ-ই জাল। জাল সনদে চাকরিরতদের চাকরিচ্যুত এবং প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সঠিক শূন্যপদের চাহিদা নিলে শুন্যপদ প্রায় দেড় লাখের উপরে হবে।
বর্তমানে আগামী তিন বছরের শূন্যপদের চাহিদা নেওয়া হচ্ছে। এতে শূন্যপদ দুই লক্ষ ছাড়িয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
সুতরাং এনটিআরসিএ’র কৌশলে বারবার নিয়োগ বঞ্চিত এক ঝাঁক স্নাতক-স্নাতকোত্তর করা বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধিত প্রকৃত মেধাবীদের এন্ট্রিলেভেল বয়স বিবেচনা করে অথবা বিতর্কিত রায়গুলো বাতিল বা পুন:বিবেচনা করে বিগত ১৬ বছরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকার (১ম থেকে ৫ম) গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকৃত নিয়োগ বঞ্চিত ১-১২তমদের নিয়োগের সুযোগ প্রদান করে বৈষম্য মুক্ত শিক্ষা ও জাতির মেরুদন্ড শিক্ষাব্যবস্থা কলংঙ্কমুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।
নয়াবাজার, ঢাকা থেকে