পে-স্কেল, সে যেনো এখন এক দীর্ঘশ্বাস, চারিদিকে হা-হুতাশ কিন্তু দায়িত্বশীল কারো যেনো কোনো মাথাব্যথা নেই। আওয়ামী সরকারের আমলেও বার বার পে-স্কেলের দাবি তোলা হলেও সে দাবির প্রতি তাদের ছিলোনা কোনো ভ্রুক্ষেপ বরং বেসিকের ৫% অতিরিক্ত বোনাস দিয়ে তাদের ভাবখানা এমন ছিলো যে অনেক কিছু উদ্ধার করা ফেলেছিলো।
অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মূল্যস্ফীতি বাড়ার সাথে সাথে বেতন সামাঞ্জস্য হারে বাড়ানো হয়েছে একাধিক বার। স্বাভাবিকভাবে নবম পে-স্কেল দেবার কথা উঠেছে ২০২০/২১ সাল থেকে। অথচ ২০২৪ সাল শেষ হতে চললেও কবে নাগাদ নতুন পে-স্কেল হতে পারে তা কেউ জানে না! দায়িত্বশীলরা কেউ যেনো পে-স্কেল নিয়ে ভাবতেও চান না।
আওয়ামী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্তীকালিন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য বেশ কিছু কমিশন গঠন করলেও নতুন পে কমিশন নিয়েও তাদের আপাতত কোনো ভাবনা চিন্তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
যেটা সরকারি আধা সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্ত সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের হতাশ করছে। বর্তমান যা পরিস্থিতি তাতে ২০১৫ সালের পে-স্কেল এখন বাজারের সাথে কোনোভাবে সামাঞ্জস্যপূর্ন নয়।
২০১৫ সালে সর্বশেষ অষ্টম পে-স্কেল ঘোষনা করা হয়, তবে নয় বছর পার হলেও ৯ম জাতীয় পে-স্কেল এখনো আলোর মুখ দেখেনি। করোনা পরবর্তী অর্থনীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, এমনকি বিগত সরকারের নেয়া মেগা প্রজেক্টের নামে দূর্নীতির, এবং হাজার হাজার কোটি টাকা বাইরে পাচার ফলে দেশে মূল্যস্ফিতী বেড়ে গিয়েছে।
যার ফলে সাধারন মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনী সকল পন্য বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় অধিকাংশ জিনিসপত্রের পাশাপাশি মাছ মাংসের দাম স্বাভাবিকের তুলনায় গত দুবছরে প্রায় ৪০-৫০% বেড়ে গিয়েছে! এছাড়াও ভোজ্যতেলও দীর্ঘদিন ধরে সাধারনের মাথা ব্যাথার কারন। বাজার দর বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুতেই তার প্রভাব পরেছে।
জ্বালানী তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে চলাচলের ক্ষেত্রে বাস, ট্রাক, লঞ্চ এমনকি আলফা, মিশুকের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে ৫০-১০০%। সবকিছু মিলে সাধারন জনগন সত্যিকার অর্থেই সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। বাজারে সবজি, মাছের দাম বেড়ে গেছে কয়েকগুন, ইলিশ মাছের দামতো ধরাছোয়ার বাইরে।
ইলিশ যেনো মধ্যবিত্তের বিলাসিতার সামিল! গরুর মাংস, খাসির মাংস কিংবা ইলিস মাছ এখন নিম্মবিত্ত, মধ্যবিত্তদের জন্য দুরূহ।
একজন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা একদিনে যে বেতন পান তা দিয়ে এক কেজি গরুর মাংস কেনা যায়! পরিস্থিতি সত্যিই কত ভয়াবহ! এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলে ব্যাগ ভর্তী বাজার হয়না।
এরমধ্যে বিগত সসরকারের আমলে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থায় পূর্ন নিয়ন্ত্রন না থাকায় মাঝে মাঝেই কিছু কিছু নিত্য পন্যের দাম উঠে গিয়েছিলো আকাশচুম্বী! সেসব পন্যের দাম এখনো কিন্তু কমেনি! এর বড় উদাহরন হতে পারে ডিম! ফার্মের ডিম এখনো হালি প্রতি ৫৫/- বিক্রি হচ্ছে! অথচ কিছু দিন আগেও তা ৩০-৩৫ টাকা ছিলো!
নিত্যপন্যের দাম কোনোভাবেই এখন সহনীয় পর্যায়ে নেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা এতে লাভবান হলেও পকেট ফাঁকা হচ্ছে সাধারন চাকুরীজীবীদের।
অষ্টম জাতীয় পে স্কেল অনুযায়ী সর্বনিম্ম ২০তম গ্রেডে আট হাজার দুইশত টাকা স্কেলে সর্বসাকুল্যে বার-তের হাজার টাকার মত বেতন আসে। অথচ চাল ডাল তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়ে গিয়েছে তাতে ১২ হাজার টাকায় জীবনব্যয় মেটানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
৮ম পে স্কেল অনুসারে একজন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা ২২০০০ টাকা স্কেলে সর্বসাকুল্যে ৩১/৩২ হাজার টাকার মত বেতন পেয়ে থাকেন। এছাড়াও একজন ১০ম শ্রেনীর কর্মকর্তা সর্বসাকুল্যে ২৩/২৪ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন যা কিনা একজন শ্রমিককের বেতনের চেয়ে খুব বেশি নয়! এমতাবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর বাড়তি দাম পাশাপাশি যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া ও বাড়তি বাসাভাড়া দিতে গিয়ে তাদেরকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে!
বিশেষ করে গত দু'বছর আগের তুলনায় এখন জীবনযাত্রার ব্যয় প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। অথচ বেতন সেই একই থেকে গেছে। এতে করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো হতাশায় দিন পার করছে। ২০১৫ সালে ২৩/২৪ হাজার টাকায় পরিবারের ভরন পোষণ সম্ভব হলেও ২০২৪ সালে এসে জীবনযাত্রার মান ও ব্যয় অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সম পরিমান টাকায় এখন একটি পরিবারের ভরন পোষণ কোনো ভাবেই যেনো সম্ভব না!
এছাড়াও ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরো কমে যাওয়া পূর্বের তুলনায় একই টাকায় কম জিনিস পাওয়া যাচ্ছে, এতে করে চাকুরীতে যারা নতুনভাবে যোগদান করছে তাদের জন্য টিকে থাকা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। যারা ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারী আছেন তাদের কথা বলাই বাহূল্য! তাদের যেনো দুর্দশার শেষ নেই।
১৯৭৩ সালে প্রথম পে-স্কেল দেয়ার পর ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৪২ বছরে মোট আটবার পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পাঁচবছর পরপর পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম পে-স্কেল থেকে ৮ম পে-স্কেল পর্যন্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতি ৫-৬ বছর পরপর মাথাপিছু আয়, বাজার মূল্যের উপর ভিত্তি করে নতুনভাবে পে-স্কেল দেয়া হয়েছে। তবে ২০১৫ সালের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন মোড় নিয়েছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে যেখানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিলো ১৪৬৬ মার্কিন ডলার। সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দাড়িয়েছে ২৮২৪ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ গত আট বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দ্বিগুন হলেও সে অনুযায়ী বেতন স্কেল সমন্বয় করা হয়নি।
অত্যন্ত দুংখজনক হলেও সত্য যে এসময়ে কোনো পে-স্কেল দেয়া হয়নি। এছাড়াও এসময়ে বাংলাদেশ নিন্ম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছে, সে অনুযায়ী চাকরীজীবীদের বেতন সমন্বয় করা সময়ের দাবী। গত ১০ বছরে আমাদের গড় মাথাপিছু আয় দ্বিগুন হয়েছে, দেশের জিডিপি বেড়েছে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে।
তবে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি চাকুরিজীবীরা। কারন পে-স্কেল ঘোষণা না হওয়া তাদের ক্রয় ক্ষমতা খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। তাই সমসাময়িক বাজারের সাথে মানিয়ে নেয়াও তাদের পক্ষে অসম্ভব। এতে করে সামাজিকভাবেও পিছিয়ে পরছে তারা। দেশের জিডিপি, মাথাপিছু আয় বাড়ার সুবিধা থেকে একাংশকে কেনো বঞ্চিত করা হচ্ছে? অন্তত ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ সালের গড় হিসাব করলে ২০১৫ সালের পরে নূন্যতম একটি পে-স্কেল পাওয়াটা একদমই যৌক্তিক ছিলো।
আর তাতে করে বাজারের সাথে বেতন যদি সমন্বয় হত তবে সাধারনের কস্ট অনেকটাই লাঘব হত।
৮ম জাতীয় পে-স্কেল ঘোষণার পর ১১-২০তম গ্রেডের বিভিন্ন বৈষম্য নিয়ে তখন আন্দোলন হয়। যদিও এর পরবর্তীতে তেমন কোনো ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি। সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন যাবত ৯ম জাতীয় পে-স্কেলের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে।
৮ম জাতীয় পে-স্কেলের ২০ টি গ্রেডকে কমিয়ে ১০ টি গ্রেডে নিয়ে আসা, বিভিন্ন গ্রেডের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনা ও ৪০% মহার্ঘ ভাতার দাবি গুলো উঠে আসছে তাদের আন্দোলনে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মাথাপিছু আয় ও মূল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয় করে ৯ম জাতীয় পে-স্কেলের দাবি একান্তই যৌক্তিক।
এছাড়াও যতদিন পর্যন্ত ৯ম জাতীয় পে-স্কেল বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত মহার্ঘভাতার ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। এমতাবস্থায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির ফলে নতুন পে কমিশন গঠনের মাধ্যমে ৯ম পে স্কেল ঘোষণাসহ অন্যান্য বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
ড. ইউনুসের নেতৃতাধীন নতুন সরকারের উপর মানুষের প্রত্যাশার শেষ নেই। এই মুহূর্তে অর্থনীতির সংকট মোকাবেলা থেকে শুরু করে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রন সবকিছুই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ভুলে গেলে চলবেনা ছাত্র জনতা ৫ আগস্ট যে বিজয় অর্জন করেছে তার ভিত্তি ছিলো বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন।
একশ্রেনীর মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, সে জন্য সরকারি চাকুরিজীবীরা পে-স্কেলের মত ন্যায্য অধিকার থেকে থেকে বঞ্চিত হবে সেটা কখনোই কাম্য নয়। বাজারের সাথে মিল রেখে পে-স্কেল ঘোষণার জন্য অবশ্যই নতুন সরকারের একটি কমিটি গঠন করা উচিত যারা সবকিছু পর্যাবেক্ষণ করে একটি গ্রহনযোগ্য পে-স্কেল দিতে সক্ষম হবে। এভাবে আর চলতে পারেনা।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা