.
পশ্চিমা আধিপত্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্রিকস একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট। এবারের ১৬তম শীর্ষ ব্রিকস সম্মেলন ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত হয়। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর রাশিয়ায় এই প্রথম এত বৃহৎ কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইউক্রেনে আক্রমণের জেরে পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাকি বিশ্ব থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চেয়েছিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ব্রিকস সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে সেই প্রচেষ্টা কতটা ব্যর্থ হয়েছে তা দেখাতে চেয়েছেন পশ্চিমাদের। এই জোট নিয়ে শুরু থেকেই পশ্চিমারা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। আর রাশিয়া পশ্চিমাদের সমুচিত শিক্ষা দিতে এই জোটকে শক্তিশালী করতে চায়। তারই ধারবাহিকতায় পুতিনের ডাকে চীন, ভারত, তুরস্ক, ইরানসহ বিশ্বের প্রায় ২০ নেতা এবারের ব্রিকস সম্মেলনে মিলিত হয়েছেন। এবারের সম্মেলনে আলোচনার মূল বিষয় হয়ে উঠেছে ব্রিকসের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত নিরসন। মস্কোভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক কনস্ট্যান্টি কালচেভ বলেছেন, কাজানে ব্রিকস সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের একত্রিত করার মাধ্যমে ক্রেমলিনের লক্ষ্য এটা বোঝানো যে, রাশিয়া বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাদেরও মিত্র বা অংশীদার রয়েছে। সম্মেলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল সুইফটকে (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ব্রিকস নেতৃত্বাধীন পেমেন্ট সিস্টেমের ক্ষেত্রে পুতিনের ধারণা; যা ২০২২ সালে রাশিয়ার ব্যাংকগুলো থেকে বাতিল করা হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান সংঘাতের বিষয়েও পশ্চিমাবিরোধী এই জোটের নেতারা আলোচনা করেছেন। ব্রিকস সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও অংশ নিয়েছিলেন। দুই বছরের মধ্যে এটাই তার প্রথম রাশিয়া সফর। পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় ইউক্রেন সংঘাত গুরুত্ব পেয়েছে। যদিও কিয়েভ জাতিসংঘ প্রধানের এই সফরের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সম্মেলনের পর ব্রিকস নেতৃবৃন্দ জাতিসংঘের সংস্কার থেকে চলমান বৈশ্বিক সংঘাতের বিস্তৃত বিষয়গুলোকে নিয়ে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেছেন। এতে মোট ১৩৪টি প্রবিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে; যার মধ্যে একটি জাতিসংঘের সংস্কারসংক্রান্ত। এতে বলা হয়েছে, আমরা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদসহ এর ব্যাপক সংস্কারের বিষয়ে আমাদের সমর্থনকে আবারও নিশ্চিত করছি, যাতে এটিকে আরও গণতান্ত্রিক, প্রতিনিধিত্বমূলক, কার্যকর ও দক্ষ করে তোলা যায়। এর সঙ্গে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও ভালোভাবে সাড়া দিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব সম্প্রসারণের প্রশ্ন জড়িত। নেতৃবৃন্দ সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং দ্রুত জাতিসংঘের মধ্যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ওপর ব্যাপক কনভেনশন গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
ঘোষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা বৃদ্ধি এবং অব্যাহত সশস্ত্র সংঘাতের বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। নেতারা কূটনীতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বিরোধ মীমাংসায় তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। ব্রিকস নেতারা গাজা উপত্যকায় চলমান উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সমস্ত শত্রুতা বন্ধের আহ্বান জানান। ১৯৬৭ সালের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানার মধ্যে একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব উল্লেখ করেন এবং জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। সদস্য রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনের সংকট বিষয়ে জাতীয় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে কূটনীতির মাধ্যমে সংঘাতের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ‘প্রশংসার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবগুলো করেছে’। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অবৈধ একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাবের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেন যে, এটি নেতিবাচকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এবং দারিদ্র্য বাড়িয়ে তোলে। ব্রিকস সদস্যরা মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে মহাকাশ নিরাপত্তা নিশ্চিতে একটি দলিল তৈরির আহ্বান জানান। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভূমিকা জোরদার করতে এবং সকলের জন্য ন্যায়সংগত অবস্থা নিশ্চিত করতে পরিকল্পিত বিভিন্ন অর্থনৈতিক উদ্যোগ প্রবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ব্রিকস নেতারা বিশ্ব অর্থনীতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবদান বাড়াতে ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের আহ্বান জানান। একটি নতুন বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ; যা ব্রিকস দেশ এবং গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে বিনিয়োগের প্রবাহ বৃদ্ধি করতে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ব্যবহার করবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রিকস সম্মেলনে একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা তৈরির কথা বলেন। তিনি বলেন, একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এটি একটি গতিশীল এবং অপরিবর্তনীয় প্রতিক্রিয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা এ প্রসঙ্গে বলেন, বহুমুখী ব্যবস্থা গঠনে ব্রিকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আরও ন্যায়সংগত বিশ্ব গড়ার সুযোগ এসেছে বলে তিনি মনে করেন। রাশিয়ার পক্ষ থেকে ব্রিকসকে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট জি-৭-এর বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। পুতিন আরও বলেন, ব্রিকস আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার কর্তৃত্ব জোরদার করছে। তীব্র আঞ্চলিক সংঘাতসহ বৈশ্বিক এজেন্ডায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কিভাবে সমাধান করা যায়; তা নিয়ে তিনি ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে কাজ করার আহ্বান জানান।
বিগত ১৮ বছরে ব্রিকস সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘ ও আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সংস্কারের পক্ষে এবং গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বর আরও বলিষ্ঠ করতে দেশটির ভূমিকা প্রশংসনীয়। চীন ডিজিটাল অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং সমৃদ্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতার অধিকারী। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ব্রিকস দেশগুলোকে গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোর মধ্যে সংহতি ও সহযোগিতা জোরদারের জন্য এবং বৈশ্বিক শাসন সংস্কারের অগ্রগতির একটি প্রাথমিক চ্যানেল হিসেবে ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিশ্ব যখন অশান্তি ও পরিবর্তনের নতুন যুগে প্রবেশ করছে, তখন আমরা এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হচ্ছি; যা আমাদের ভবিষ্যৎ রূপরেখা ঠিক করে দেবে। শান্তি, উদ্ভাবন, সবুজ উন্নয়ন, বৈশ্বিক ন্যায়বিচার এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদানে নেতৃত্ব দেয়, এমন একটি সংস্থা হিসেবে ব্রিকসকে গড়ে তোলার জন্য পাঁচটি মূল বিষয়ের প্রস্তাব করেন তিনি। জাতিসংঘের সংস্কার, আঞ্চলিক উত্তেজনা, আর্থিক নিরাপত্তা, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ উদীয়মান প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ব্রিকস নেতারা যেদিন সম্মিলিত হয়েছিলেন, সেদিনই চীনের প্রেসিডেন্ট প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন। তার প্রস্তাবগুলো গ্লোবাল সাউথ সহযোগিতার জন্য একটি রোডম্যাপ। একইসঙ্গে যেসব দেশ আধুনিকীকরণের আকাক্সক্ষা পোষণ করে, তাদের জন্য নতুন এক অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এশিয়া প্যাসিফিক রিচার্স সেন্টারের প্রেসিডেন্ট সের্গেই সানাকোয়েভ বলেন, শির প্রস্তাবিত উদ্যোগগুলো গ্লোবাল সাউথের সহযোগিতাকে আরও সমন্বিত ও জোরদার করবে। তার মতে, ডিজিটাল অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের মতো ক্ষেত্রগুলোয় ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বর্ধিত সহযোগিতা, গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোর জন্য তাদের সমর্থন আরও দৃঢ়ভাবে রূপান্তর প্রক্রিয়াকে সহজতর করবে। শির বক্তব্য, ব্রিকস রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্যকে শক্তিশালী করতে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া ও বিশ্বাস বাড়াতে সহযোগিতা করবে। এটি ব্রিকস সহযোগিতার দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করবে এবং উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
চীনের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, ইতোমধ্যে একটি চীন-ব্রিকস কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়ন ও সহযোগিতা কেন্দ্র চালু করেছে চীন। একটি ব্রিকস গভীর সমুদ্র সম্পদ আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র এবং ব্রিকস রাষ্ট্রগুলোতে বিশেষ অর্থনৈতিক আঞ্চলের উন্নয়নের জন্য একটি ‘চায়না সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করবে। এ ছাড়া একটি চায়না সেন্টার ফর ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পিটেন্সি এবং একটি ব্রিকস ডিজিটাল ইকোসিস্টেম কোঅপারেশন নেটওয়ার্কও গড়ে তোলা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বক্তব্যে তিনি ধারাবাহিক যে উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেছেন, তা ব্রিকস সহযোগিতা প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক বিষয়ে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে এবং শক্তিশালী ব্রিকস গঠনে নির্দেশনা প্রদান করবে।
তার প্রস্তাবিত উদ্যোগগুলো বিশেষ করে ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে একটি গভীর সমুদ্র সম্পদ আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা উদ্ভাবনী সহযোগিতার উন্নয়নে একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ইউক্রেন ছাড়াও রাশিয়ার অর্থ লেনদেন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পুতিন আলোচনা করেন। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকতে চান বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমরা এ সংঘাত নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। আমরা বিশ্বাস করি, শান্তিপূর্ণভাবে যেকোনো বিরোধ সমাধান করা উচিত। আমরা দ্রুত শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করি। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের জন্য পুতিনের পক্ষ থেকে শি জিনপিং ও নরেন্দ্র মোদির মতো নেতাদের প্রশংসা করা হয়। বর্তমান বিশৃঙ্খল বিশ্বে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের গভীর বন্ধুত্বের প্রশংসা করেন চীনের প্রেসিডেন্ট। পুতিন বলেন, তিনি বেইজিং ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ককে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি হিসেবে দেখছেন।
ক্রেমলিন বলেছে, তারা বৈশ্বিক বিষয়গুলোকে আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমেই মোকাবিলা করতে চায়, একক কোনো রাষ্ট্র বা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী নয়। ক্রেমলিনের সহযোগী ইউরি উশাকভ বলেছেন, আমরা বিশ্বাস করি যে ব্রিকস হলো বহুমুখী একটি কাঠামো, যা দক্ষিণ ও পূর্ব গোলার্ধের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সার্বভৌমত্ব এবং পরস্পর শ্রদ্ধার নীতিতে বিশ্বাসী। তিনি আরও বলেন, ব্রিকস মুক্ত গাঁথুনির মাধ্যমে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক ধারায় সম্পর্কের সেতুবন্ধন নিশ্চিত করে বিশ্ব নেতৃত্ব গড়ে তুলছে। পশ্চিমারা বিশ্বাস করে যে, রাশিয়া তাদের প্রভাব বিস্তার করতে এবং ইউক্রেন সংঘাত সম্পর্কে নিজস্ব চিন্তাধারা প্রকাশ করতেই এই ব্রিকসের জন্ম দিয়েছে।
তারা ব্রিকসের কর্মকা-কে সন্দেহের চোখে দেখে। সম্প্রসারিত ব্রিকস জোট বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রভাবশলী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে এই জোটটি জি-৭ কে পেছনে ফেলেছে। এই জোটে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৬ শতাংশ আছে। বিপরীতে জি-৭ এ মাত্র ৮.৮ শতাংশ রয়েছে। ব্রিকস অর্থনৈতিকভাবেও জি-৭ কে পেছনে ফেলেছে। বিশ্বের মোট জিডিপির ৩৫ শতাংশ ব্রিকসের অধীনে, আর জি-৭ এ রয়েছে ৩০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্রিকসভুক্ত অর্থনীতিগুলোর ভবিষ্যতের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রধান উৎস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া তেল উৎপাদক দেশ ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত অপর দুই তেল উৎপাদক দেশ ব্রাজিল ও রাশিয়ার সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর ব্রিকস সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর এখন বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল উৎপাদনও রপ্তানি করে থাকে। পশ্চিমাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে পুতিন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ও ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ছিল। তবে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্ক আরও বেশি সম্পর্ক উন্নয়ন করতে ইচ্ছুক।
পশ্চিমা বিশ্ব নানাভাবে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসলেও বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিশ্বের উন্নয়নশীল ও শিল্পোন্নত দেশের জোট ব্রিকস নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, রাশিয়া কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও চীন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে প্রস্তুত হচ্ছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থায় ডলারকে পেছনে ফেলে ব্রিকসের প্রভাব থাকতে পারে। বিশ্বনেতাদের এ সম্মেলন থেকে পশ্চিমাদের মস্কোকে বিচ্ছিন্ন করার যে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, পুতিন তা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন বলে আশা করছেন। কারণ, পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর আদেশ দেওয়ার পর থেকে পশ্চিমাদের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক নিন্দার মুখে রাশিয়ার এটাই সবচেয়ে বড় সম্মেলন। বর্তমান বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন অর্থনীতিবিদ রিচার্ড ওলফ মনে করেন, কল্পনায় নয়, বাস্তবেই ব্রিকস বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল, অনুন্নত দেশগুলো যা আছে তাই নিয়ে পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। তারা জীবনমান উন্নয়নের স্বাধীনতা চায়, পশ্চিমারা তাদের বঞ্চিত করছে। জি-৭ এ যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। অন্যদিকে, ব্রিকসে চীন হচ্ছে শক্তিশালী দেশ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়া কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রতিযোগী হতে পারবে না।
তবে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক প্রতিযোগী হয়ে উঠছে চীন। এভাবেই হয়তো একসময় মার্কিন অর্থনীতির আধিপত্যের সমাপ্তি ঘটবে। রিচার্ড ওলফ বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশ্বে আধিপত্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে গেছে। মার্র্কিন সাম্রাজ্য ডুবছে। যুক্তরাষ্ট্র আর বিশেষ অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না।
দেশের উত্থান-পতন হয় নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। সামরিকভাবে বিশ্বে আমাদের আশপাশে কেউ না থাকলেও এগুলো চিরস্থায়ী নয়।’ দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানি মনে করেন, ব্রিকসকে এখন পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সংস্থাটিকে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে চলার একটি বিকল্প উপায় হিসেবেও কেউ কেউ মনে করছেন। ব্রিকস যে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, তা প্রমাণিতও হয়েছে। ব্রিকসকে একসময় কয়েকটি সম্পদশালী দেশের একটি সম্পদভিত্তিক গোষ্ঠী হিসেবে মনে করা হলেও এখন সেটি একটি বৃহত্তর প্রতিনিধিত্বমূলক বৈশ্বিক ব্যবস্থার আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়