.
জনমিতি পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যার তুলনায় কর্মের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। নিয়োগ প্রাপ্তিতে বয়সসীমা নিয়ে সাম্প্রতিক তরুণদের নানামুখী আন্দোলন সংগ্রামও পরিলক্ষিত। সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত কাজের জোগান না থাকায় বয়স বৃদ্ধির প্রাসঙ্গিকতা অতি যৌক্তিক। ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে চাকরিতে প্রারম্ভিক বয়স ৩২ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। সামগ্রিক বিবেচনায় বিপুল কর্মহীনদের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারসহ দেশীয় পর্যায়ে উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। জুলাই ২৪ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী চেতনা অতিশয় পরিপুষ্ট। এটিকে কার্যকর করার লক্ষ্যে নবতর কর্ম ক্ষেত্রের অনুসন্ধানে শিল্প ও কৃষিভিত্তিক আধুনিকায়ন আবশ্যক। পণ্যসামগ্রীর প্রয়োজনীয়তায় শ্রমঘন শিল্পায়ন ও কৃষি কাজে অনুপ্রাণিত করার প্রবল সুযোগ রয়েছে বলে বিজ্ঞমহলের ধারণা। ইতোমধ্যেই অবৈধভাবে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ উচ্চারিত হলেও এখনো পর্যন্ত সফল কিছু দৃশ্যমান নয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব অর্থলোভী দানবদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থ কর্মসংস্থান জোগানে ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু তৈরি পোশাক শিল্প বা বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ওপর নির্ভরতা সমস্যার সমাধান করবে না। প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রণীত সামাজিক ব্যবসার প্রচার ও প্রসারের ব্যাপকতাও প্রত্যাশিত।
২৯ আগস্ট ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৪ অনুযায়ী দেশে দিন দিন বেড়েছে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা। পতিত সরকারের শাসনামলে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন সময়ে দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২৬ লাখ ৪০ হাজারে। ২০২৩ সালের একই সময়ে যা ছিল ২৫ লাখ। এ হিসেবে এক বছরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার বা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ। তুলনামূলক বিবেচনায় দেশে বেকারের সংখ্যা আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, পুরুষদের মধ্যে ঐ তিন মাসে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশে। যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়েছে যে, ২০২৪ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশে কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৬ কোটি ৯৬ লাখ ৪০ হাজার। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার। ফলে, গত এক বছরে দেশে ১০ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থান কমেছে। এর মধ্যে পুরুষ ও নারীর সংখ্যা যথাক্রমে ৩ লাখ ৩০ হাজার ও ৭ লাখ ৪০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে মোট কাজ হারানোর মধ্যে ৬৯ শতাংশই নারী।
উল্লেখ্য, প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাজের সংস্থান না থাকায় শ্রমবাজারে অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যাও কমেছে প্রায় ৯ লাখ ৩০ হাজার। উক্ত সময়ে কৃষি খাতে ২ লাখ ৩০ হাজার কর্মসংস্থান কমে আসার বিপরীতে শিল্প খাতে বেড়েছে প্রায় ২ লাখ কর্মসংস্থান। তবে এককভাবে সেবা খাতে কর্ম কমেছে প্রায় ১০ লাখ ৪০ হাজার। তাছাড়া ৩ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার মানুষ নিয়োজিত করে এখনো কর্মসংস্থানে শীর্ষে রয়েছে দেশের কৃষি খাত। এ খাতে নিয়োজিত আছে ৪৪ শতাংশ মানুষ। এর বাইরে শিল্প খাতে ১৮ শতাংশ ও সেবা খাতে ৩৮ শতাংশ মানুষ জড়িত আছেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদন আলোকে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে বিশ্বে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর তালিকায় প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সংস্থাটির ২০২২ সালের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সপ্তম স্থানে। উল্লেখ্য যে, আইএলওর সংজ্ঞানুসারে সপ্তাহে মাত্র এক ঘণ্টা কাজ করলেই তাকে কর্মে নিয়োজিত হিসেবে গণ্য করা হয়। আবার কেউ এক মাস কাজ না খুঁজলেই বেকারের তালিকায় না দেখিয়ে তাকে কর্ম বাজারের বাইরে দেখানো হয়। এ ধরনের লোকদের সংযুক্ত করলে দেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বাড়বে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যসূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ কর্মবাজারে যুক্ত হন। তাদের মধ্যে দেশীয় বাজারে কর্মসংস্থান হয় ১২ থেকে ১৩ লাখের এবং ৮ থেকে ৯ লাখ মানুষ যায় প্রবাসে। বাকিদের কাজের কোনো সুযোগ নেই। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বুরে্যার (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালে কাজের প্রত্যাশায় গড়ে প্রতিঘণ্টায় দেড়শ’ বাংলাদেশী দেশ ছেড়েছেন। প্রতিবছর বাংলাদেশীদের জন্য যত কর্মসংস্থান হচ্ছে, তার এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে প্রবাসে। স্বল্প শিক্ষিত তরুণদের প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। দেশে শোভন কাজ না পেয়ে উন্নত জীবনযাপনের প্রত্যাশায় অনেক বাংলাদেশী তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হতে চেষ্টা করছেন। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় বিদেশের কারাগারে বন্দি বাংলাদেশীর সংখ্যাও কয়েক লাখ।
১৫ অক্টোবর ২০২৪ প্রকাশ পাওয়া বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ অক্টোবর সংখ্যায় বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কর্মসংস্থান তৈরি করা। তবে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় একদিকে দেশের বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান কমেছে, অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কর্মসংস্থানে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার প্রায় ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিবছর উৎপাদন খাতে গড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ করে। বিপরীতে এ খাতে প্রতিবছর কর্মসংস্থান ৯ দশমিক ৬ শতাংশ হারে কমেছে। প্রায় সাড়ে ৪৫ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়েছে কৃষি খাতে। এ খাতে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থানই হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক ও নি¤œ মজুরির। তাছাড়া দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই এসএমই খাতের। তারা নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয় বিধায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিও হয় কম। তাছাড়া খাতভিত্তিক দক্ষ মানবসম্পদেরও অভাব রয়েছে। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ ও রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের জন্য ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের বাইরে কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র তৈরির দিকে মনোযোগী হওয়া।
প্রাসঙ্গিকতায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির তথ্য এলেও তা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে খুব একটা ভূমিকা রাখেনি। প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। বিশেষ করে শিক্ষিত যুবক ও নারীদের অনেকেই তাদের কাক্সিক্ষত চাকরি খুঁজে পান না। আর সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের শিল্প ও সেবা খাতের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালোর দিকে। তবে বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দৃঢ়তার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভালো ইতিহাস রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আশা করছি, সরকার দেশের আর্থিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও ব্যবসায়ের পরিবেশ উন্নত করতে জরুরি ও সাহসী সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করবে। এর মাধ্যমে দেশ লাখ লাখ যুবকের কর্মসংস্থান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথে ফিরে আসতে পারবে।’
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম-সভা-সেমিনারে দেওয়া বক্তব্যে দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা বলেন, প্রথমেই দেখতে হবে প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে কি না। একমাত্র কর্মসংস্থানই পারে সাফল্যের সঙ্গে দারিদ্র্য কমাতে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হার বাংলাদেশে গত দেড় দশকে হয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে দারিদ্র্য বিমোচনের হার সেভাবে বাড়েনি। সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন জটিলতা, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে আসাসহ বিভিন্ন সংকটের কারণে কর্মসংস্থান কমছে।
বর্তমান সময়ের বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে শ্রমশক্তির তুলনায় কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি কম। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের একটি বড় অংশই এখন বেকার। তরুণদের জন্য যথাযথ ও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। পড়াশোনা শেষ করে বছরের পর বছর চাকরির জন্য অপেক্ষা করছে তারা। এটা ঠিক যে দেশের অনেক তরুণ এখন অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত। অথচ বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অতিক্রম করছে। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। তাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটাই এখন বেশি প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিলে দেশ এগিয়ে যাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে মেধা। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম মেধাবী। এই মেধাবীদের উপযুক্ত করে তৈরি করতে হলে এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
দেশের সার্বিক উন্নয়নে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নতুন কর্মপরিবেশের উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরিও আবশ্যক। দেশে প্রতিবছর নতুন নতুন যে জনশক্তি যুক্ত হচ্ছে, তাদের যথাযথভাবে কর্মদক্ষ করে কাজে লাগাতে পারলে ভবিষ্যৎ নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নবতর অধ্যায় রচিত হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে যুব সম্প্রদায়ের ভাগ্যোন্নয়ন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জরূপে প্রতিভাত। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ অন্যান্য খাত সংস্কারের মতো এই ক্ষেত্রেও যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া না হলে কর্মসংস্থান সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে। চলমান পরিবেশকে যথার্থ কাজে লাগিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও যথোপযুক্ত কর্মসংস্থান জোগানের বিষয়টি সর্বাধিক প্রাধান্য পাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী