উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতের বারি বেগুন-১২ সবজি
বারি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতের বারি বেগুন-১২ সবজি জগতে একটি নতুন সংযোজন। নতুন এই জাতের বেগুন প্রচলিত অন্যান্য বেগুনের জাতের চেয়ে ওজনে অনেক বেশি হয়। তাই একে কেজি বেগুনও বলা হয়। বড় অবস্থায় দেখতে লাউয়ের মতো দেখতে বিধায় একে অনেকে লাউ বেগুনও বলে। তবে এটি বারি বেগুন-১২ নামেই সর্বত্র পরিচিতি পাক, সেটিই কাম্য। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এটি উদ্ভাবন করেছে বিধায় এটির নাম ‘বারি বেগুন-১২’।
বারি এ যাবৎ ১৩৫টি সবজি জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। তার মধ্যে খোদ বেগুনের জাত রয়েছে ২০টি। সবজি বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান ড.একেএম কামরুজ্জামান বলেন, বারি বেগুন একটি উচ্চফলনশীল অর্থকরী ফসল। এটি ব্যাক্টেরিয়া জনিত ঢলে পরা রোগ সহনশীল। ফলের রং হাল্কা সবুজ ও লম্বাটে আকারের গাছ। প্রতিটি বেগুনের গড় ওজন ৭০০-৮০০ গ্রাম, ফলন ৫৫-৬০ টন/হেক্টর (শীতকালে)। সমগ্র বাংলাদেশ তথা দক্ষিণবঙ্গে এর ভালো ফলন হয়।
তবে ওজন বেশি হতে দিলে গাছ প্রতি বেগুনের সংখ্যা কমে যায়। তাতে মোট ফলন কম হয়। তাই তিনি মনে করেন, প্রতিটি বেগুনের ওজন গড়ে ৭০০-৮০০ গ্রামের মধ্যে রেখে সংগ্রহ করা ভালো। এ বেগুন খেতে বেশ সুস্বাদু ও মাংসল। ভাজি ও ভর্তা হিসেবে খেতে এটির জুড়ি মেলা ভার। বীজ প্রাপ্তি সহজ করার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে বীজ সরবরাহ করে থাকে। তাছাড়া বারির সরেজমিন গবেষণা বিভাগ মাঠপর্যায়ে এ জাতের বেগুন জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রকম উৎপাদন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।
বীজ প্রাপ্তি সহজীকরণ ও উৎপাদন কলাকৌশল, কৃষক পর্যায়ে এ জাতের বেগুনের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে পারলে এ জাতের বেগুন দ্রুত মাঠপর্যায়ে ব্যাপক বিস্তার লাভ করবে। তাতে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হবে। নতুন জাত হিসেবে এটির চাহিদা বৃদ্ধির জন্য আরও ব্যাপক প্রচার দরকার।
সবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। এটি দেশের জন্য গৌরবের বিষয়। কৃষি বিজ্ঞানীদের নব নব উদ্ভাবন, সরকারের নীতি-সহায়তা, কৃষি বিভাগের কর্মপ্রচেষ্টা ও কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই এ সফলতা এসেছে। দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন রকম সবজির মধ্যে বেগুন বেশ জনপ্রিয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হরেকরকম বেগুন চাষ করতে দেখা যায়। তারমধ্যে বারি বেগুন-১২ নতুন উচ্চ ফলনশীল জাত হিসাবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ জাতের বেগুন চাষ করে কৃষকরা লাভের মুখ দেখছেন।
গত বছর এ সময়ে সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, কুমিল্লা এর সহায়তায় কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জে, চান্দিনার ছৈয়দপুর ও বড় গোবিন্দিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এবং চাঁদপুর জেলার কচুয়ায় এ বেগুন চাষ করে কৃষকরা বেশ লাভবান হয়েছে। বারি বেগুনের সঙ্গে আন্তঃফসল হিসাবে লালশাক, পালংশাক, ধনিয়া চাষ করেও অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব।
এই জাতের বেগুনের চাষ নিয়ে আশাবাদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপ-পরিচালক পলাশ সরকার। তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক চাষে ভালো ফল পাওয়া গেছে। এ অঞ্চলে এ বেগুন খুবই উপযোগী হবে। এখানকার জনপ্রিয় খাবারের একটি কালাইয়ের রুটির সঙ্গে বেগুন ভর্তা। বিঘাপ্রতি ফলন কমপক্ষে সাত মেট্রিক টন। একেকটি বেগুন এক কেজির ওপরে হলেও এর স্বাদ ঠিক থাকে। সামনের বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে দুই বিঘা করে জমিতে এ বেগুন চাষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
গোদাগাড়ীর বসন্তপুর গ্রামের মাসাউল ইসলাম দুই বছর ধরে এ বেগুনের চাষ করছেন। তিনি বলেন, ‘একেকটি বেগুন এক থেকে দেড় কেজি হয়েছে। এক বেগুনের ভর্তা দিয়েই চার-পাঁচজন কালাইয়ের রুটি খেতে পেরেছি। এ বেগুন দ্রুত বড় হয়। ফলনও ভালো। আমাদের দেখাদেখি আশপাশের চাষিরাও এই বেগুন আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।’ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চাষিদের মধ্যেও এই জাতের বেগুন চাষে আগ্রহ বাড়ছে বলে বারির সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বরেন্দ্র কেন্দ্র, রাজশাহীর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জগদীশ চন্দ্র বর্মণ জাতীয় এক দৈনিকে মন্তব্য করেন বর্তমান বাজার মূল্যে হিসাব করলে এ বেগুন চাষে বিঘাপ্রতি লক্ষাধিক টাকার ওপরে আয় হবে কৃষকের।
বেগুনের রয়েছে হরেক রকম পুষ্টিগুণ। ভিটামিন এ, সি, ই, আর আয়রনের সমাহার বেগুনে। এটি শক্তিশালী একটি এন্টিঅক্সিডেন্টও বটে। প্রচুর পরিমাণ আয়রন থাকায় এটি রক্তশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে। ভিটামিন এ থাকায় চোখের পুষ্টি জোগায়, চোখের যাবতীয় রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে। বেগুনে থাকে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম যা দাঁত, হাড়ের জন্য বেশ উপকারী। যারা নিয়মিত বেগুন খায়, তাদের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের তুলনায় কম বলে পুষ্টিবিদগণ বলে থাকেন।
পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করার এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে বেগুনের। মুখ ও ঠোঁটের কোণে কিংবা জিবে ঘা দূরীকরণে এটি রিবোফ্ল্যাবিনের কাজ করে। বেগুনে আছে প্রচুর পরিমাণ ডায়াটারি ফাইবার, যা খাবার হজমে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। যাদের রক্তে খারাপ ধরনের কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি তাদের জন্য বেগুন সবজি হিসেবে ভালো। তবে যাদের গেঁটে বাত আছে, কিংবা অ্যাজমা ও অ্যালার্জি থাকে, তাদের বেলায় বেগুনে খানিকটা বিধিনিষেধ আছে।
দেশে সবজির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে এ জাতের বেগুনের আবাদ চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ জাতের বেগুনের আবাদ বৃদ্ধি জরুরি। সবজির আবাদ এলাকা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থান দখল করে আছে। এটি আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক বটে। সামগ্রিক উৎপাদন বাড়লে বাজারে এ বেগুনের সরবরাহ বেড়ে যাবে। তাতে ভোক্তারাও সহনীয় দামে এ বেগুন কিনতে পারবেন। যদিও বর্তমানে বাজারে সব সবজির দাম বেশ ঊর্ধ্বমুখী। বাজার মনিটরিং বাড়ানো ও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারলে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়েই লাভবান হবেন।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, কুমিল্লা