ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

যুব কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা

মুহম্মদ র ই শামীম

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ৩১ অক্টোবর ২০২৪

যুব কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা

বাংলাদেশ এখন জনমিতিক সুবিধার সময়কাল

বাংলাদেশ এখন জনমিতিক সুবিধার সময়কাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) পার করছে। ফলে নতুন দেশ গঠনে যুব সমাজের গুরুত্বও সবচেয়ে বেশি। জনমিতিক এই সুবিধা আমাদের কাজে লাগানোর নতুন করে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে চব্বিশের এই গণঅভ্যুত্থানে। প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তিনিও ছাত্রদের অবদানের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন ‘...ছাত্ররাই আমার প্রাথমিক নিয়োগকর্তা।’ এ কথা থেকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যুব সমাজের গুরুত্ব নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়।

সত্যিকার অর্থে দেশ গঠনে যুব সমাজের মধ্যে নতুন ধারার এক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির মূলশক্তিই হলো সবচেয়ে কর্মক্ষম যুব সম্পদ। একটি দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর থাকার চেয়েও অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাষ্ট্রের সুনাগরিক ও দক্ষ যুব সম্পদ। শুধু অর্থনৈতিক নয়, একটি রাষ্ট্রের দুর্দিনে যুব সমাজই জীবন দিয়ে দেশ-জাতিকে রক্ষায় এগিয়ে আসে। এর প্রমাণ চব্বিশেই আমরা দেখেছি। সারাবিশ্বে জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে একটি গণঅভ্যুত্থান প্রথম সংঘটিত হয়েছে, আমাদের দেশেই (উইকিপিডিয়া’২৪)।
আমরা জানি, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যুব। এর মধ্যে বর্তমানে যাদের বয়স ১২-২৭ বছরের মধ্যে, তাদের জেন-জি প্রজন্ম বলা হয়। অর্থাৎ যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রে একটি নির্দিষ্ট প্রজন্মকে জেন-জি বলা হলেও বিশে^র অন্যান্য প্রান্তের একই প্রজন্মকে বোঝাতে বর্তমানে প্রায়ই এই শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা হলো প্রকৃত প্রথম ডিজিটাল নেটিভ জেনারেশন। তাদের অধিকাংশই স্ট্রিমিং কন্টেন্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তার সময় বেড়ে উঠেছে। তাই তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও কর্মকা- ইন্টারনেটনির্ভর।

তাদের শব্দচয়ণ, কথাবলা, আচার-আচরণ, ড্রেস আপ ও ভাষা ব্যবহার আগের প্রজন্ম থেকে ভিন্ন। তারা কথা বলতে ভয় পায় না। প্রতিবাদ করতে জানে। আমাদের চব্বিশের লড়াইয়ে আত্মত্যাগ ও জীবন দিয়ে লড়াই করে তারা অভ্যুত্থান সফল করেছে। আন্দোলনে বিভিন্ন স্লোগান ও পরবর্তীতে আঁকা নানা গ্রাফিতিতেও তারা তাদের স্মৃতিকে ভিন্ন ক্যালিওগ্রাফিক দৃশ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই জেন-জি প্রজন্মের দুইজন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নিজেদের যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছেন। সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় জানা গেছে, বাঁধা-ধরা চাকরির চেয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিভার বিকাশে তাদের আগ্রহ বেশি। সমীক্ষা মতে, শতকরা ৭৬ জনই কারও অধীনে কাজ ও কর্মজীবনে আগ্রহী নয়। 

বেশিরভাগই নিজেই নিজের বস হতে চান। 
আমাদের এখনো বিপুলসংখ্যক তরুণ, যাদের বয়স ১৫-২৪ বছর বয়সী, তারা কোনো প্রশিক্ষণ, শিক্ষা কার্যক্রম ও কর্মসংস্থানের আওতার মধ্যে নেই। এই জনগোষ্ঠীকে সংক্ষেপে এনইইটি (ঘঊঊঞ- ঘড়ঃ রহ ঊফঁপধঃরড়হ ঊসঢ়ষড়ুসবহঃ বা  ধহু ঝড়ৎঃং ড়ভ ঞৎধরহরহম) বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই হার অনেক বেশি অর্থাৎ শতকরা ৩৯.৮৮ শতাংশ এনইইটি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। বাংলাদেশের এই হার বৈশি^ক হারের প্রায় দ্বিগুণ। বিশে^ গড় এনইইটি জনগোষ্ঠী শতকরা ২১.৭ ভাগ। (ওখঙ: ২০২৩) আইএলও এর তথ্য অনুযায়ী, ১৫-২৪ বছর বয়সী শ্রমশক্তির শতকরা ১৫.৭ ভাগ এখনো বেকার, যা বিশে^র গড় বেকারত্ব হারের (১৩.৮%) এর চেয়ে বেশি। এই জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ, শিক্ষা কার্যক্রম ও কর্মসংস্থানের আওতায় আনা এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বেকারত্ব কোন পথে
যুব সমাজের বেকারত্ব দূরীকরণ অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তির সর্বশেষ ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট শ্রমশক্তির সংখ্যা সাত কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার। এই সংখ্যার মধ্যে কাজে আছেন সাত কোটি ৪ লাখ ৭০ হাজার জন। দেশে বাকি কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮০ হাজার। ২০২৩ সালের ৪র্থ কোয়ার্টারের তথ্যানুযায়ী, বেকারের সংখ্যা ২৩ লাখ ৫০ হাজার। তবে বেকারত্বের এই হিসাবের পদ্ধতিগত মত নিয়ে অনেকের দ্বিমত আছে। অন্যদিকে, আইএলওর হিসাব অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি।

দেশে যুব সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশই মনে করেন পড়াশোনা শেষে তারা চাকরি পাবেন না। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাস করা ৬৬ শতাংশই বেকার থাকেন বলে বিআইডিএসের গবেষণায় জানা যায়। গরিব শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মনে করেন, চাকরি পাবেন না তারা। এতে বোঝা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় জরুরি পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উদ্যেগ  
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর দেশের ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ, ঋণ সহায়তা, নেতৃত্ব বিকাশ, যুব উদ্যোক্তা তৈরি ও আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রায় তিন লাখ যুবককে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় এনে থাকে। অন্যান্য প্রকল্পের আওতায় আরও এক-দুই লাখ যুবক বছরে প্রশিক্ষণ পায়। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে  ঊঅজঘ: ঊপড়হড়সরপ অপপবষবৎধঃরড়হ ধহফ জবংরষরবহপব ভড়ৎ ঘঊঊঞ চৎড়লবপঃ নামক নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

প্রকল্পের আওতায় ৯ লাখ এনইইটিভুক্ত যুবনারী ও যুবককে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ এবং ২০ লাখ তরুণকে পরোক্ষভাবে এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী করা হবে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সব সময়ই যুবদের চাহিদা বিবেচনায় কাজ করে থাকে। জেন-জি প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ‘শিক্ষিত কর্মপ্রত্যাশীদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ফ্রিল্যান্সিং পেশায় বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে বিশে^ দ্বিতীয়।

চ্যালেঞ্জসমূহ ও করণীয়
বাংলাদেশে কর্মপ্রত্যাশীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। একদিকে জনমিতিক কারণে যুবদের আধিক্যের সুখবর যেমন আছে, অপরদিকে অর্থনীতির জন্য এই সুযোগ কাজে লাগানোর কঠিন চ্যালেঞ্জও আমাদের সামনে। যদি এই বিপুলসংখ্যক তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না যায়, তবে তা হবে আমাদের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত।

দক্ষতা বৃদ্ধি ও কাজের ক্ষেত্র তৈরি, শিক্ষায় পরিবর্তন, বিদেশী ভাষায় জ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ চাহিদা পূরণের বড় চ্যালেঞ্জ এখন আমাদের সামনে। এখনো যুব সমাজের প্রধান সমস্যাই দক্ষতার অভাব। এই কারণে দেশ ও বিদেশে যুব সমাজের অনেকেই কাজ পায় না। পেলেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়। অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে যারা বিদেশগামী হতে চায়, তারাও অনেক সময় নিজেদের উপযুক্ত দক্ষতা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকেই বিদেশ চলে যায়। ফলে দেশ কাক্সিক্ষত রেমিটেন্স থেকে বঞ্চিত হয়। আমাদের প্রশিক্ষণগুলোকে তাই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

এ ছাড়াও বিদেশী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যুবদের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের বিনিয়োগ। দেশের যুব কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটি। বর্তমানে আমাদের মোট জাতীয় বাজেটের শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ বাজেট যুব ও ক্রীড়া বাজেটের জন্য বরাদ্দ। এক্ষেত্রে যুবদের জন্য বাজেট বৃদ্ধি ও পৃথক যুব বাজেটের দাবি দীর্ঘদিনের। বাজেট প্রণয়নে যুবদের মতামত গ্রহণও আবশ্যক। মানব সম্পদ উন্নয়নের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় অংশই হলো যুব সমাজ।

যুবসম্পদের উন্নয়নে বিনিয়োগ মানেই একটি দেশের ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। যুবসম্পদ খাতে বিনিয়োগই শুধু যুব সমাজের ভবিষ্যৎকে দেশের স্বার্থে গড়ে তুলতে পারে। নামমাত্র, লোকদেখানো যুব কার্যক্রমের মাধ্যমে জনমিতিক সুবিধাকে কাজে লাগানো যাবে না। মনে রাখতে হবে, যুবরাই আমাদের শক্তি। তাই ভবিষ্যৎ দেশ গঠনে যুব সমাজকে উন্নয়নের শক্তিতে রূপান্তরিত করা একান্ত জরুরি।

লেখক  :  উপপরিচালক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর

×