প্রসঙ্গ ইসলাম
একজন মুসলমানের কাছে সূরা ফাতিহা সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় ধারণা থাকা উচিত। সূরা ফাতিহা কুরআনের একটি বিশেষ সূরা। প্রথমত: এ সূরা দ্বারাই পবিত্র কুরআন আরম্ভ হয়েছে এবং এ সূরা দ্বারাই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত নামাজ আরম্ভ হয়। অবতরণের দিক দিয়েও ‘পূর্ণাঙ্গ সূরা’ রূপে এটিই প্রথম নাজিল হয়। সূরা ‘ইকরা’ ‘মুযাম্মিল’ ও সূরা মুদ্দাসিরের ক’টি আয়াত অবশ্য সূরা ফাতিহার পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসেবে এ সূরার অবতরণই সর্বপ্রথম।
শানে নুযুল বা ঐতিহাসিক পটভূমি : আমর বিন শার্জিল থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (স.) হযরত খাদিজাকে (রা.) বললেন: আমি একটি আওয়াজ শুনেছিলাম- যা কিনা ‘ইকরা’ বা পড়ো তোমার প্রভুর নামে-। যখন এ সংবাদ ওয়ারকা বিন নাওফেলকে জানানো হলো, তিনি পবিত্র আওয়াজটি মনোযোগের সঙ্গে শুনতে পরামর্শ দিলেন।
এরপর একদিন জিবরাঈল ফেরেশতা (আ.) এসে বর্ণনা করলেন : বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম, আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন- (পূর্ণ সূরা ফাতিহা)-খাজাঈনুল ইরফান। এভাবেই সূরাটি নাজিল হলো। সূরা ফাতিহা একটি প্রার্থনামূলক সূরাÑ যা বান্দাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এটি কুরআনের সার সংক্ষেপ বিশেষ। এ সূরায় সমগ্র কুরআনের সারমর্ম সংক্ষিপ্ত আকারে বলে দেওয়া হয়েছে। কুরআনের অবশিষ্ট সূরাগুলো প্রকারান্তরে এ সূরারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা।
তাই এ সূরাকে উম্মুল কুরআন, উম্মুল কিতাব, কুরআনে আজিমসহ প্রায় বিশটিরও অধিক নামে অভিহিত করা হয়।- (খাজাইন, কুরতুবী)। হযরত রাসূলে কারিম (স.) ইরশাদ করেছেন: যার হাতে আমার জীবন-মরণ, আমি তার শপথ করে বলছি, সূরা আল ফাতিহার দৃষ্টান্ত তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল প্রভৃতি অন্য কোনো আসমানি কিতাবে তো নেই-ই এমনকি পবিত্র কুরআনেও এর দ্বিতীয় নেই।-(মা’আরিফ ২পৃ:)।
বিষয়বস্তু : আগেই বলেছি, সূরা ফাতিহা একটি পবিত্র প্রার্থনার সমষ্টি, আল কুরআনের বাস্তব উত্তর। আল্লাহর পথে বান্দার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সেতুবন্ধন হলো এ সূরা। বান্দা তার মনিবের শেখানো দোয়ার বদৌলতে মুনাজাত করার সুযোগ পেয়েছে এই সূরার মাধ্যমে। এ যেন সরকারিভাবে দেওয়া দরখাস্তের ফরমে দস্তখাত করার মতোই সুযোগ। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, আমি মহানবীকে (স.) এ কথা বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ বলেছেন : নামাজ আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করা হয়েছে, আর আমার বান্দা আমার কাছে যা চাইল, তা-ই তার জন্য রইল।
যখন বান্দা বলে: ‘আলহামদু লিলাহি রব্বিল আ’লামীন’ তখন আল্লাহ বলেন: ‘হামিদানী আবদী’ অর্থাৎ আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল। যখন বান্দা বলে: র্আরাহমানির রাহিম।’ তখন আল্লাহ বলেন: ‘আছনা আলাইয়া আবদী’- আমার বান্দা আমার গুণ গাইল। যখন বান্দা উচ্চারণ করে: ‘মালিকী ইয়াওমিদ দীন’। তখন আল্লাহ বলেন: ‘মাজ্জাদানী আবদী’- আমার বান্দা আমার গৌরব বর্ণনা করল। আর যখন বান্দা পড়ে ‘ইয়্যাকা-না’বুদু ওইয়্যাকা-নাস্তাঈন।
তখন জবাবে আল্লাহ বলেন : এই বিষয়টা আমার ও আমার বান্দার মাঝেই রইলো, আর আমার বান্দার জন্য তা-ই, যা সে চাইবে। যখন বান্দা পাঠ করে: ‘ইহ্দিনাস সিরাত্বল মুস্তাকিম—-ওয়ালাদ্ দোয়াল্লীন।’ তখন আল্লাহ উত্তর দেন: ‘হাজা লি আবদী ওয়া লিআবদী মা-সা আলা।’Ñ এ আমার ও আমার বান্দার মাঝে সংরক্ষিত আর আমার বান্দার জন্য বরাদ্দ থাকবে যা সে প্রার্থনা করছে।
তাহলে বুঝা গেল এ সুরা তামাম জাহানের মালিকের সঙ্গে দীনহীন বান্দার গোপন আরজ, কথোপকথন। মনমুকুরে ইমানের দীপ্ত শিখা জারি থাকলে মু’মিনের পক্ষে মহামহীম আল্লাহর প্রতিধ্বনি অনুভব হওয়ারই কথা। দুনিয়ার বাদশাহ্র সঙ্গে অসহায় মানুষের কথাবার্তাগুলোতে বাদশাহ্র কথাগুলো গোপনই থাকল। এখানে কোন বাদশাহর সঙ্গে সাধারণ ফরিয়াদীর সত্যিকারের আবেদন-নিবেদনের চিত্র ফুটে উঠেছে। কোন দরখাস্তে শুরুতে থাকে গুণগান, প্রশংসা।
এর পরই খুশি হয়ে বাদশাহ জানতে চাইলেন: কে তুমি? বান্দা সবিনয় আরজ করল, একমাত্র আপনারই দাস, আপনারই সাহায্যপ্রার্থী। এরপর আল্লাহ বলেন: তুমি আমার কাছে কি চাও? বান্দা বলে: ‘সঠিক পথের সন্ধান দিন’। আল্লাহ জানতে চাইলেন: কোন পথটা তুমি ঠিক মনে করো? সে পথ আমি চিনি না, শুধু এতটুকু বলতে পারি ঐ পথে চালাও, যে পথে তোমার নেয়ামত অবারিত; কোন সময় গজবে পড়ার শঙ্কা থাকবে না। তখন আল্লাহ বলেন: যদি সত্যিই তুমি চাও সঠিক পথের সন্ধান, তাহলে এই নাও আল্ কুরআন-। এর শিক্ষা দুনিয়ায় তোমাকে বিপদমুক্ত রাখবে আর আখিরাতে নিয়ামতের ভাগি করবে।
উল্লেখ্য, এ সূরায় ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ বা ‘সহজ সরল পথ’ পাওয়ার জন্য প্রার্থনা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে এ এক বড় নেয়ামত। কায়েমানোবাক্যে আল্লাহর দরবারে তা না চাইলে পাওয়া যায় না। আল্লাহ মানুষকে দুনিয়ার সব প্রয়োজনীয় জিনিস না চাইলেও দিয়ে থাকেন কিন্তু হিদায়াত বা দ্বীনের সহজ পথ কারো ওপর চাপিয়ে দেন না, কোনো অনিচ্ছুক জাতি হিদায়াত পায় না। হিদায়াত শ্রেষ্ঠতম দান, তা অপাত্রে আল্লাহ দান করেন না। এর জন্য খাটি মনে প্রভুর দ্বারে ধরনা দিতে হয়।
সূরা ফাতিহার ফজিলত: তাফসিরের বিভিন্ন গ্রন্থসমূহে সূরা ফাতিহার বহুবিধ ফজিলত ও মর্তবার কথা বলা হয়েছে। মাশাইখগণ লিখেছেন, পূর্ণ বিশ্বাস সহকারে সূরা ফাতিহা পাঠ করলে যে কোনো রোগ হতে মুক্তি পাওয়া যায়। হাদিসে এ সূরাকে শিফা বা নিরাময় বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে।- (কুরতুবী)। সিহাহ সিত্তায় দেখা যায়, সাহাবাগণ শাপ বিচ্ছুর দংশন করা রোগীর ওপর এবং মৃগী ও পাগল রোগীর ওপর সূরা ফাতিহা পড়ে দম করতেন। বর্ণিত আছে, এ সূরার ৭টি আয়াতের বরকতে মুমিনদের জন্য আল্লাহ আপন অনুগ্রহে দোজখের ৭টি দরজা বন্ধ করে দেন। শয়নকালে সূরা ফাতিহা, ইখলাস, ফালাক ও না’স তিন তিনবার করে পড়লে সকল প্রকার বিপদাপদ হতে নিরাপদ থাকা যায়।
ফজরের নামাজের পর প্রত্যহ বিসমিল্লাহ মিলিয়ে এই সূরা ৪১ বার পড়লে স্বাস্থ্য অটুট থাকে, কোন রোগ ব্যাধি আক্রমণ করতে পারে না। কোনো নেক উদ্দেশ্য লাভের জন্য হযরত আলী (রা.) এ সূরা পাঞ্জেগানা নামাজের পর একশতবার পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তা ছাড়া চর্মরোগ, দন্তশূল, নির্যাতনের অবস্থায় কিম্বা অভাব অনটনের সময় এটি পাঠ করলে যথেষ্ট উপকার পাওয়া যায়। বিসমিল্লাহ্র সঙ্গে মিলিয়ে সূরা ফাতিহা পড়ে প্লেগ ও কলেরা রোগীর শরীরে ফুঁক দিলে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা রয়েছে।
আর এ সবের পূর্ব শর্তই হলো পূর্ণ ইমান ও ভক্তি এবং প্রয়োজনে দোয়ার সঙ্গে দাওয়া বা ওষুধের প্রয়োগ। আল্লাহই সবকিছুর সর্বশেষ আশ্রয় স্থল। আমরা ইবাদতে রিয়াজতে এ সূরা পড়ার সময় সর্বোচ্চ খুলুসিয়াত প্রদর্শন করতে পারলেই কেবল আমাদের দোয়া-মুনাজাত কবুল হতে পারে। শুধু নিয়তির দোষ দিয়ে লাভ কি? ক’জনই বা আমাদের মধ্যে বিশুদ্ধ মন ও চিন্তা শক্তির অধিকারী হতে পেরেছেন?
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব