ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

ব্রিকস সম্মেলন মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশ

ড. শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ০০:১৫, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

ব্রিকস সম্মেলন মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশ

ড. শামীম আহমেদ

রাশিয়ার কাজারনে অনুষ্ঠিত ব্রিকস (ইজওঈঝ) সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাশিয়াপন্থী রাষ্ট্রসমূহ বিশ্ববাজারে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং পশ্চিমা অর্থনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করেছে। সম্মেলনের মূল আলোচনার বিষয় ছিল অর্থনৈতিক সহযোগিতা, মার্কিন ডলার থেকে বাণিজ্য স্বাধীনতা অর্জন এবং পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিকল্পের প্রয়োজনীয়তা।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর নেতারা, বিশেষ করে ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং রাশিয়ার প্রতিনিধি পশ্চিমের অর্থনৈতিক আধিপত্য এবং রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধে বর্তমান আর্থিক কাঠামোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ওপর নিজেদের হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এবারের সম্মেলন সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইরানের মতো নতুন সদস্যের উপস্থিতি ব্রিকসের বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে প্রভাব বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছে।

সম্মেলন  ব্রিকসের সম্প্রসারণকেও সুদৃঢ় করেছে, যেখানে তুরস্ক, মিসর এবং ইথিওপিয়াসহ দুই ডজনের বেশি দেশের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এটি বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যের প্রবণতাকে প্রতিফলিত করেছে। নেতারা মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে একটি  ব্রিকসভিত্তিক বাণিজ্য মুদ্রার সম্ভাবনা আলোচনা করেন, যদিও বাস্তবিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিতে পারেননি। পরিবর্তে, তারা নিজেদের জাতীয় মুদ্রা ব্যবহার করে বাণিজ্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০৯ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীন নিয়ে গঠিত ব্রিকস প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই উদীয়মান অর্থনীতির স্বার্থ রক্ষা ও পশ্চিমা প্রভাবের ভারসাম্য তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার যোগদানের মাধ্যমে আফ্রিকার দিকে ব্রিকসের বিস্তার ঘটে। প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় গুরুত্ব দিলেও, বর্তমানে এর কার্যকারিতা রাজনৈতিক বিষয় যেমনÑ সার্বভৌমত্ব, মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা এবং হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দিকে প্রসারিত হচ্ছে।

ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও ব্রিকস সদস্যরা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন এবং আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও বিকল্প তৈরি করার লক্ষ্যে একত্রিত হয়েছে। কাজারন সম্মেলনে নতুন আবেদনকারী দেশগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ব্রিকসের জন্য গ্লোবাল সাউথের দিকে বিস্তৃত প্রতিনিধিত্বের একটি কৌশলগত পরিবর্তন নির্দেশ করে। এই সম্প্রসারিত প্রতিনিধিত্ব ব্রিকসের উচ্চাকাক্সক্ষাকে নির্দেশ করে, যা পশ্চিমের প্রভাবের বাইরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আলোচনা করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম হওয়ার পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয়। 
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং বাণিজ্য মুদ্রা নিয়ে আলোচনা অনেক আগে থেকে ব্রিকসের সদস্যদের মধ্যে গুরুত্ব পাচ্ছিল। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ২০২৩ এ প্রস্তাব দেওয়ার পর থেকেই ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি বিকল্প বাণিজ্যিক মুদ্রা তৈরির ধারণাটি বারবার আলোচনায় এসেছে। যদিও প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তবু ব্রিকস সদস্যরা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে জাতীয় মুদ্রার ব্যবহার নিয়ে একমত হয়েছে, যা পশ্চিমা আর্থিক সরঞ্জাম থেকে স্বায়ত্তশাসনের সন্ধানে একটি কার্যকর পদক্ষেপ।

এটি আমরা অবশ্য আগেও দেখেছি। রাশিয়ার তেল রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে এই খাতে ডলারের ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বিকল্প হিসেবে ভারত, চীনের মতো রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মুদ্রা বিনিময় করে রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি শুরু করে। এখন এই তালিকায় চীন ও ভারতের বাইরেও অনেক দেশ সম্পৃক্ত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব যখন কার্যত রাশিয়াকে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টায় লিপ্ত, সেখানে এই সম্মেলনের রাজনৈতিক তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর।

পুতিন সম্মেলনটি আয়োজন করার মাধ্যমে ব্রিকসকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং এ২০ এ তার বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কাজে লাগালেন। ইউক্রেন সংকটে রাশিয়ার অবস্থান এবং অন্যান্য ব্রিকস দেশের সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক কূটনীতিক মোড়কে নির্দেশ করে, যেখানে ব্রিকস সম্ভবত পশ্চিমা নীতির বিরুদ্ধে একটি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট হিসেবে সামনে আরও আগ্রাসীভাবে এগোতে পারে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিকস একটি ‘ধীরে চলো নীতি’র অর্থনৈতিক ব্লক থেকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক জোটে পরিণত হচ্ছে। সম্মেলনের কার্যক্রম রাজনৈতিক এবং কৌশলগত বিষয়ে বিশেষ করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতা নিয়ে নতুন একটি মোড় নিয়ে আসছে। বিশ্লেষকরা ইঙ্গিত করছেন যে, যদি ব্রিকস এই গতিপথ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়, তবে এটি বৈশ্বিক বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে এবং বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে নতুনভাবে রূপায়িত করতে পারে। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, ব্রিকসের সম্প্রসারণ এবং তার সদস্যদের মার্কিন আধিপত্যমূলক প্রতিবন্ধকতামূলক নীতিগুলোকে পাশ কাটানোর সংকল্প নিয়ে একটি বিকল্প বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের বিকাশের দিকে এগোতে পারে।

এটি ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং একটি বহুমুখী বিশ্বের দিক উন্মোচন করবে, যেখানে আঞ্চলিক এবং অর্থনৈতিক জোটগুলো মার্কিন প্রভাবের বিরুদ্ধে ভারসাম্য তৈরি করবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি তৈরি ও  গতিশীলতার জন্য ব্রিকসের সম্প্রসারণের প্রভাব ব্যাপক। ব্রিকসের গতিপথ একটি বৈশ্বিক শক্তির পুনর্বিন্যাসের দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে উদীয়মান অর্থনীতিগুলো তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে এক জায়গায় নিয়ে আসছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এই জোট একটি বহুমুখী বিশ্বের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। বিকল্প অর্থপ্রদানের ব্যবস্থা এবং মুদ্রা নিয়ে আলোচনাগুলো পশ্চিমা নীতির বিপরীতে নতুন অর্থনৈতিক পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতার সম্ভাবনা তৈরি করছে, যা আরও নতুন নতুন দেশকে আকর্ষণ করতে পারে, যারা ডলারভিত্তিক ব্যবস্থার বাইরে স্থিতিশীলতার সন্ধান করছে।
ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্রিকস ইউক্রেন সংকট ও অন্যান্য আঞ্চলিক সংঘাতের মতো বিষয়গুলোতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। যদিও এটি পশ্চিমা সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই নাও করতে পারে, তবে ব্রিকস অর্থনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে, যা বৈশ্বিক শক্তির গতিশীলতাকে কার্যকরভাবে রূপান্তরিত করবে। উদাহরণস্বরূপ, এটি পশ্চিমাবিরোধী বা বিচ্ছিন্ন দেশগুলোকে অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করতে পারে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যে ভারসাম্য পরিবর্তন করতে সহায়তা করবে।

সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ব্রিকসের অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই জোটের দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীনÑ প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব ভূরাজনৈতিক প্রভাব ও জাতীয় অবস্থানকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেসও তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকটে ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর অবস্থান কোনো একক বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা তাদের নিজ নিজ কূটনৈতিক প্রয়োজন ও অভ্যন্তরীণ নীতি দ্বারা প্রভাবিত।

এর মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার, যারা দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার ইস্যুতে নীতিগত অবস্থান নিয়েছে এবং ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলে আসছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা এই ইস্যুতে ফিলিস্তিনের অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান এবং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকসের অন্যান্য সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে, যাতে তারা মানবাধিকারের পক্ষে এই সংকটে নিরপেক্ষ না থাকে।
ব্রাজিল সম্প্রতি তাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা পরিবর্তন আনলেও, সাধারণত ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে থাকে এবং জাতিসংঘের শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানায়। অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীন এই বিষয়ে কিছুটা সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেছে, যা তাদের আন্তর্জাতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার কৌশলগত উদ্যোগকে প্রতিফলিত করে। রাশিয়া তার ঐতিহ্যগত প্রভাব খাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তৃতীয় শক্তির ভূমিকা রাখতে চায়, যা জাতিসংঘে তাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভারত কিছুটা নিরপেক্ষতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে উভয় পক্ষকে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে, যদিও তাদের ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান সকল পক্ষের কাছেই পরিষ্কার।

দক্ষিণ আফ্রিকা, যাদের মানবাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস শক্তিশালী এবং আপোসহীন, এই ইস্যুতে জাতিসংঘকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট রামাফোসা বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকট একপাক্ষিক নয় এবং মানবাধিকারের মূল্যকে অগ্রাহ্য করা উচিত নয়।’ তাদের এই মনোভাব ব্রিকসের অন্যান্য সদস্যদের ওপরও চাপ তৈরি করছে, যাতে তারা কৌশলগত গুরুত্ব ছাড়াও নৈতিকতার পক্ষে অবস্থান নেয়। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এই সংকটকে ‘মানবিক সংকট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং তাঁর বক্তব্যে উভয় পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি এই অবস্থাকে আরও খারাপের দিকে না নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি ও সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। গুতেরেসের মতে, ‘শান্তির জন্য সংলাপ ও পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য।’ জাতিসংঘের মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানানো তাঁর বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, যা এক প্রকারে ব্রিকসের মতো জোটগুলোকেও প্রভাবিত করছে।
ব্রিকসের দেশগুলো, যারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্যায্য ক্ষমতাকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়, এই ইস্যুতে কিছুটা দ্বিধান্বিত অবস্থানে আছে। একদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলো মানবাধিকার সংরক্ষণের পক্ষে কথা বলছে; অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীন নিজেদের কৌশলগত গুরুত্বকে বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কিছুটা সংযত। এই দ্বৈত সংবেদনশীলতা ব্রিকসের ভেতরেই একটি অস্পষ্টতা তৈরি করছে, যেখানে একদিকে তারা ন্যায়বিচারের আহ্বান জানায়, অন্যদিকে তারা ভূরাজনৈতিক কৌশলও ব্যবহার করছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এই পরিস্থিতি ব্রিকসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যেহেতু তাদের জন্য এটি মানবিক মূল্যবোধ ও কৌশলগত অবস্থানের মধ্যকার একটি ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করছে। যদি ব্রিকস এই সংকটে একটি সমন্বিত ও সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়, তাহলে তারা কেবল তাদের আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেই নয়, একটি নৈতিক শক্তি হিসেবেও বিশ্বমঞ্চে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।

জাতিসংঘ প্রধানের ব্রিকস সম্মেলনে উপস্থিতি এবং শান্তির পক্ষে আহ্বান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্বে মানবাধিকারের পক্ষে যে জোরালো সমর্থন প্রকাশিত হয়েছে, তা এই সংকটের মধ্যে ব্রিকসের ভবিষ্যৎ ভূমিকা নির্ধারণে প্রভাব ফেলবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই জোটের জন্য একটি শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি, যা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারে।
ব্রিকস নানা কারণে বাংলাদেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ জোট। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ  ব্রিকসের সঙ্গে সমন্বয় করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশ ব্রিকসকে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমানো এবং উন্নয়ন অর্থায়নে প্রবেশের একটি পথ হিসেবে দেখতে পেয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি শেখ হাসিনার বিস্তৃত অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে মিলে যায়, যা বাংলাদেশের মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত, যারা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক কাঠামোর বিকল্প খুঁজছে।

তবে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং শেখ হাসিনার সরকারের ক্ষমতা হারানো ব্রিকসের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে নতুনভাবে বিন্যস্ত করতে পারে। নতুন প্রশাসন ব্রিকসের সঙ্গে সংযুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করতে পারে, বিশেষ করে যদি তারা পশ্চিমপন্থী নীতির দিকে ঝুঁকতে চায়। তবু,  ব্রিকস অংশীদারিত্বের কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক সুবিধাÑ যেমন বিকল্প অর্থায়নে প্রবেশ ও পশ্চিমা রাজনৈতিক চাপ থেকে সুরক্ষাÑ এখনো বাংলাদেশের নেতৃত্বের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে, যদি  ব্রিকস তার সদস্যদের জন্য সুনির্দিষ্ট সুবিধা প্রদান করতে থাকে।

আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের  ব্রিকসের সঙ্গে সম্পৃক্ততা সম্ভবত এই ব্লকের স্থিতিশীলতা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর নির্ভর করবে। যদি  ব্রিকস বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, তবে বাংলাদেশ এদিকে ঝুঁকতে পারে, তা শাসক সরকারের অবস্থান যেদিকেই হোক না কেন! 

২৮ অক্টোবর ২০২৪

kindlejitu@gmailcom

×