ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১

অস্থিতিশীল কাঁচাবাজার দুর্ভোগে জনসাধারণ

প্রশান্ত কুমার বর্মণ

প্রকাশিত: ০০:১৩, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

অস্থিতিশীল কাঁচাবাজার দুর্ভোগে জনসাধারণ

অস্থিতিশীল কাঁচাবাজার দুর্ভোগে জনসাধারণ

বর্তমানে দেশের নিত্যপণ্যের বাজারের বেহাল দশা। চক্রবৃদ্ধির গতিতে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রব্যের দাম। আর এই দাম যেন কোনো ক্রমেই থামছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন আমাদের নিকট নতুন কোনো সংবাদ নয়। গত তিন বছর থেকে বর্তমান অবধি দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন দাম ব্যবস্থার কারণে জনসাধারণ অতিষ্ঠ। প্রতিটা পণ্যই যেন দাম বাড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে যার জন্য দায়ী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।

অন্যান্য দেশে যেখানে দ্রব্যমূল্যের দাম কমানোর প্রতিযোগিতা হয় আমাদের দেশ সেখানে পুরোপুরি ব্যতিক্রম। দ্রব্যমূল্যের এই বৃদ্ধি আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে কাঁচাবাজারের পণ্যের দাম আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে। মুটেমজুর ও খেটে-খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে সকল পেশাজীবী নাকানিচুবানি খাচ্ছে বাজারে গিয়ে। অকস্মাৎ বন্যায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলা পানিবন্দি হওয়ায় ফসলের অনেকটা ক্ষতি হয়েছে। ফলে কাঁচাবাজারের এমন দাম বেড়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। বিরূপ আবহাওয়া সবজির বাজারে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করলেও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দাম বৃদ্ধির মূল কারণ। 
আলু, পটোল, কাকরোল, মূলা, লাউ, ঢেঁড়স, বরবটি, চিচিঙ্গা, করলা, বেগুন প্রভৃতি সবজির দাম এখন ৬০-১০০ এর ঘরে এবং কাঁচা মরিচের কেজি বর্তমানে  ৩২০-৩৫০ টাকা। তেল, বিভিন্ন ডাল এবং মসলার বাজারও একই অবস্থা। ব্রয়লার মুরগির ডিমের হালি ৩৬ টাকা থেকে বেড়ে এক লাফে ৬০ টাকায় চলে গিয়েছে এবং দেশী মুরগির ডিম ও হাঁসের ডিমের দাম ৮০-৯০ টাকা হালি চলছে।

তবে এগুলোর দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। দেশে স্থান ভেদেও দাম কম-বেশি দেখা যায়। এছাড়াও শীতকালীন বাহারি রকমের সবজি বাজারে এলেও সেগুলোর দামেও ক্রেতারা সন্তুষ্ট নয়। এগুলো ছাড়াও অন্যান্য নিত্যপণ্য যেমন- সিলিন্ডার, পেট্রোলিয়ামজাত তেল, গ্যাসবিল, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন জ্বালানি দ্রব্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছেই এবং এগুলো সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষজন অনেক বিপাকে। বর্তমানে মাংসের কথা না বললেই নয়- প্রাণীজ আমিষের মধ্যে সহজলভ্য ছিল ব্রয়লার মুরগি ও মুরগির ডিম কিন্তু এর বর্তমান বাজার দাম মানুষের মাঝে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

ব্রয়লার মুরগির দাম ১৩০-১৪০ টাকা কেজি থেকে এক লাফে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে  ১৯০-২০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সাধারণের নাগালের বাইরে গরু ও খাসির মাংসের দামও। গরু ও খাসির মাংসের বিকল্প হিসেবে ব্রয়লার মুরগিই ছিল গরিব ও শ্রমজীবী মানুষদের একমাত্র সম্বল কিন্তু লাগামহীন বাজার ব্যবস্থা তাদের আমিষের চাহিদা মেটানোর একমাত্র অবলম্বন ব্রয়লার মুরগির বাজারও এখন বেশ অস্থিতিশীল।

গরুর মাংসের বর্তমান দাম কেজিতে ৭০০-৮০০ টাকা ও খাসির মাংসের দাম কেজিতে ৯৫০-১০০০ টাকা যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাহিরে এবং তা কিনতে মধ্যবিত্ত মানুষেরাও পর্যন্ত হিমশিম খাচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের একজন সাধারণ মানুষ যেখানে  প্রতি বছরে গড়ে মাংস খায় ২১ কেজি সেখানে বাংলাদেশের মানুষ খায় গড়ে ৪ কেজি মাত্র। 
সম্প্রতি সিলেটের চা শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করা যাক- যাদের  দৈনিক ১২০ টাকা  মজুরি  সেই মজুরি দিয়ে কিনা তাদের ২৫০ গ্রাম তৈল, ২৫০ গ্রাম ডাল এবং ১ কেজি চাল কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাদের বেতন ৫০ টাকা বাড়িয়ে বর্তমানে ১৭০ টাকা করা হয়েছে। অনেক মানুষই আছে- দ্রব্যের দাম বেশি হওয়ায় যাদের দৈনিক মজুরির টাকায় পরিবারের ভরণপোষণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং এর ফলশ্রুতিতে তারা অনাহারেও দিনাতিপাত করে। এমন অনেক উদাহরণ আছে আমাদের চারপাশে। কারণ আমাদের দেশটা এখনো পুরোপুরি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেনি। কাজেই কৃষিপ্রধান এই দেশে আকাশচুম্বী দাম ব্যবস্থা অনেকেরই কপাল ভাঁজের কারণ। 
বেশি লাভের আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ভেজাল ও  বিভিন্ন ক্ষতিকর রং মেশাচ্ছে যা আমাদের  দৃষ্টির বাইরে ও অগোচরে এবং যা আমাদের শরীরের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন রকমারি পণ্যের দাম যেমন : খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, ফার্নিচার, কসমেটিকস, আসবাবপত্র ও  ইলেকট্রনিকস জিনিস ইত্যাদির দাম নিয়মিত হারে বাড়াচ্ছে যা ক্রেতাদের মধ্যে এক বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করছে। চাহিদার তুলনায় দ্রব্য কম থাকায় দাম বাড়ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

দ্রব্যমূল্যের এই বৃদ্ধিতে দেশের অর্থনীতিবিদগণও অনেক শঙ্কিত। একজন ব্যক্তির জীবিকা নির্ভর করতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন সুষম এবং ভেজালমুক্ত খাদ্য কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটার চিত্র যেন পুরোপুরি বিপরীত। এর যথোপযুক্ত কারণটা হলো কিছু ব্যবসায়ীদের কূটবুদ্ধি ও নীতিবিরুদ্ধ কাজ। তারাই দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ায় এবং বাজার থেকে কম দামে দ্রব্য কিনে নিয়ে পরবর্তীতে আবার সেগুলো অধিক লাভের আশায় বেশি দামে বাজারে বিক্রি তাদের সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। 
নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পিছনে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সঙ্গে অন্য সিন্ডিকেটের অবৈধ হাত থাকাতে দীর্ঘসূত্রতা হিসেবে ভোগান্তি হচ্ছে আমাদের মতো নিরীহ মানুষদের। অনেক ব্যবসায়ী এই সুযোগে কাঁচামাল যেমন : আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, তেল, বিভিন্ন মসলাসহ প্রভৃতি নিত্যপণ্য কিনে গুদামজাত করে, পরে তা মাত্রাতিরিক্ত দামে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান আমাদের মৌলিক অধিকার হওয়ায় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের এবং ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের।

নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে ভোক্তা অধিদপ্তর, ভ্রাম্যমাণ আদালত ও প্রশাসনের নিয়মিত বাজার মনিটরিং জরুরি এবং এই সকল  ব্যবসায়ীদের জরিমানা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় এনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা হোক। বাজার ব্যবস্থার এমন সিন্ডিকেট এবং চড়া দাম ব্যবস্থা কমাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিশেষ অনুরোধ।

×