ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কৃষকের সংগ্রাম

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কৃষকের সংগ্রাম

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

নৈসর্গিক বিচিত্র লীলাক্ষেত্র আবহমান বঙ্গভূমি। নদ-নদী বিধৌত, সমুদ্র পরিবেষ্টিত চিরায়ত বাংলা নানা মাত্রিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবিলা করে টিকে থাকে। যা কিনা যুগ যুগান্তরের পরম নির্মাল্য। উপকূলীয় অঞ্চল আর জনগোষ্ঠীর জীবন, সম্পদ নৈসর্গিক ঝড়ে বেহাল দশায় পড়াও নতুন কিছু নয়। নির্দিষ্ট অঞ্চলবাসী প্রত্যক্ষ সমর সামাল দিয়ে জীবনের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার বিভিন্ন ঝড়-ঝাপটায় সর্বস্বান্ত হতেও সময় লাগে না। শুধু কি প্রাকৃতিক নির্মমতা? সঙ্গে বসতবাড়ি, ভিটে, মাটি, ফসলি খেত পানিতে ডুবে যাওয়া পরিস্থিতির আর এক নির্মমতা তো বটেই। নদী ও সমুদ্রস্নাত মানুষের জীবন চক্র আবর্তিত হয় ভাঙ্গা-গড়ার অবিমিশ্র কাঠখড় পুড়িয়ে।

সংগত কারণে স্বপ্নের বঙ্গভূমি আশাভঙ্গের বেদনায় সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলেও দেয়। সেটাও যেন নিত্যজীবন সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ আমাদের শ্যামল বাংলা। ষড়ঋতুর বিচিত্র খেলায় উন্মত্ত বাংলা যখন সংহারের রুদ্রমূর্তি ধারণ করে তাও অঞ্চলবাসীর নিরন্তর যাতনা। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যের খরতাপে পরবর্তী ঋতুতেও আমরা নাকাল অবস্থায় পড়ি। আর আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষণধারাও ভাদ্র-আশ্বিনে শস্য খেতসহ বসতভিটা ভাসিয়ে নেয় যা দুর্ভোগ তো বটেই। এখন আমরা কার্তিক মাসে হেমন্তের শিশির ভেজা সকালের পরিবর্তে বৃষ্টি, প্লাবন আর ঘূর্ণিঝড়কে সামাল দিতে ব্যস্ত। জলসিঞ্চিত আবহে বাংলার উর্বর পলিমাটির যে নিরন্তর রূপশৌর্য তা সত্যিই উপভোগ্য।

কিন্তু বিপরীত উত্তাপে যখন ভাঙনের খেলায় মেতে ওঠে তার দামও গুনতে হচ্ছে আমাদের। হেমন্তের শিশির ভেজা স্নিগ্ধ আবহে আমরা মেঘঢাকা বর্ষণের আলামতে সত্যিই বিব্রত, উদ্বিগ্ন। আর ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রবল প্রতাপ উপকূলবাসীকে যে মাত্রায় নাজেহাল করার বিপন্নতা তৈরি করেছে তা কাক্সিক্ষত না হলেও তেমন প্রতিবেশে এখন অভ্যস্ত, সহনীয়ও বটে। বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের উড়িষ্যা উপকূলে হানা দেওয়ার চিত্র দৃশ্যমান হচ্ছে। ‘দানা’র প্রভাবে বৃষ্টির পানির বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় ফসলি খেত তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের মাথায় হাত। নতুন করে ভাসমান আবাদি জমিতে বীজ বুনা, কীটনাশক ছড়ানো সবই আবার শুরু করাও দরিদ্র কৃষকদের জন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো বটে।

পাশাপাশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও বিপন্ন পরিস্থিতির এক অনাবশ্যক আঁচড়। শুধু কি চাষাবাদে যুক্ত কৃষি শ্রমিক? সঙ্গে অতিসাধারণ ভোক্তা শ্রেণিও স্বস্তিতে থাকে না। অজুহাত আর অনাকাক্সিক্ষত ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে নিত্যপণ্যের যে অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি তাও গুনতে হয় ভোক্তা শ্রেণিকে। খাদ্যপণ্য নাগালের বাইরে চলে যাওয়া দুর্যোগের চাইতেও চরম দুর্বিপাক। যা ইতোমধ্যে নাড়া দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। ভারতের উড়িষ্যার উপকূলজুড়ে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশালে তার প্রবল হাওয়ার আঁচড় বসায়।

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরও মাত্রাতিরিক্ত ঝড়ো হাওয়া ও ঝাপটা থেকে মুক্ত থাকেনি। উপকূলীয় অঞ্চলসমূহের ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র ঝড়ো বাতাস ও বিপর্যয় মোকাবিলার সংবাদ স্বস্তিদায়ক। অর্থাৎ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো সবেগে অতিক্রম করলেও ক্ষয়ক্ষতির আঁচড় সেভাবে লাগেনি বলে সংবাদে প্রকাশ। ২ দিনের প্রচ- বৃষ্টিপাতসহ হাওয়ার দাপট উপকূলীয় অঞ্চলবাসীকে চরম দুর্ভোগে না পড়ার দৃশ্য সত্যিই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সংশ্লিষ্ট জনগণ। তবে ধেয়ে আসা এক ঘূর্ণিঝড় অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করতেও পিছপা হয়নি। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় সময় কাটানো মানুষগুলোর জীবন মান তেমন বিপণœ না হলেও কিছু আঁচড় তো বসিয়েছেই।

গাছপালা উপড়ে যাওয়া, ফসলি খেত পানিতে নিমজ্জিত হওয়া ছাড়াও বেড়িবাঁধ ভাঙার দৃশ্যও উঠে এসেছে। প্রচ- বাতাসে ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে রোপিত ধানের ক্ষতিও কম দুর্ভোগ নয়। ফসলি খেতের ওপর ‘দানা’র প্রভাবে শস্যভা-ারে যে অবর্ণনীয় চাপ তা সামলানোই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। ঝালকাঠির কয়েক উপজেলায় আঘাত হানা ‘দানা’ বসতবাড়ি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি গাছপালার বিধ্বস্ত হওয়ার অপদৃশ্য ভাবিয়ে তোলার মতো। বিভিন্ন গোয়ালঘরে বৃষ্টি আর বজ্রপাতে পোষা গরু মরার চিত্রও সংশ্লিষ্ট গৃহস্থের নাজেহাল হওয়ার করুণ দৃশ্য। লঞ্চঘাট ও ফেরিঘাট এলাকায় প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে।

সংগত কারণে ফসলি খেত সর্বনাশের আবর্তে পড়েছে। চলমান সময়ের আমন ধান ও শীতকালীন শাক-সবজির ক্ষতি হয়েছে। গাছ উপড়ে পড়ে এলাকার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রবল প্রতাপ তো বটেই। ফরিদপুরেও লাগাতার বৃষ্টি পড়ার অবস্থা স্বস্তিদায়ক ছিল না। অনেক ধানগাছ বৃষ্টির ধারায় সয়লাব হওয়াও পরিস্থিতির নির্মমতা। তবে এবার কৃষকদের কিছুটা স্বস্তি এসেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। কারণ, যতখানি আশঙ্কা করা হয়েছিল ঘূর্ণিঝড়ের প্রচ-তা তার কিছু কম হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কৃষকদের সেভাবে ক্ষতির আশঙ্কায় ফেলেনি। 
কৃষি কর্মকর্তারা আশা করছেন যেটুকু ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়ারই মতো। ধারণা করা হচ্ছে ক্ষতির আশঙ্কায় পড়া, পানিতে ডোবা ধান গাছগুলো পুনরায় উজ্জীবিত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। সাগর উত্তাল হলেও জোয়ারের পানি সেভাবে উপচে না পড়াও আর এক ইতিবাচক বিষয়। খুলনা-যশোরের কপোতাক্ষ নদ ও তৎসংলগ্ন এলাকার নদ-নদীর তীরের বাসিন্দাদের ওপর ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সেভাবেই প্রত্যক্ষ করা গেছে। তবে কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেলেও তা পুনরায় সংস্কারের আওতায় আনার সংবাদ এলাকাবাসীকে স্বস্তি দিয়েছে। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে বিধ্বস্ত জায়গায় সংশ্লিষ্ট কর্মযোগ সত্যিই এক ইতিবাচক ব্যবস্থাপনা। দায়-দায়িত্বে ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড।

তবে রাতভর অঞ্চলবাসীকে অস্বস্তিতে রেখেছে ঘূর্ণিঝড়ের দাপট আর জল¯্রােত। তবে খুলনা ও সাতক্ষীরায় রোদ আর মেঘের খেলা শরতের অন্য মাত্রিক নৈসর্গ জনমনে সাড়া জাগায়। এখন চলছে কার্তিক মাস। হেমন্তের শিশির ভেজা সকাল এখনও অনিয়মিত। কোনো এক সময় নিয়মিত সবাইকে মাতিয়ে দেবে তেমন অপেক্ষায় দিন গোনা। ষড়ঋতুর নানামাত্রিক বৈভবে আবহমান বঙ্গভূমির যে রূপময়তা তা যুগ-যুগান্তরের। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব ঋতু বৈচিত্র্যে আঁচড় বসালেও তার সৌরভ ম্লান করা যায়নি।

তাই ধান কাটার মৌসুম হেমন্ত তার সর্ববিধ আবেদন নিয়ে অঞ্চলবাসীর অন্তরে নতুন আলো বিচ্ছুরণ করছে। নবান্নের চিরস্থায়ী রূপে বঙ্গভূমির যে রূপশৌর্য তা যেমন অম্লান একইভাবে ধনে-ধান্যে, পুষ্পে ভরা দেশটির শাশ্বত গৌরবও। সেটাই উজ্জ্বলভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে ‘দানা’র পরবর্তী রৌদ্রস্নাত চমৎকার প্রতিবেশে। মেঘ-রোদের সহনীয় অভিযোজনে ‘দানা’র প্রভাব প্রতিপত্তি এবার সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি অঞ্চলজুড়ে। ‘দানা’র সতর্ক সংকেতেও কোনো আতঙ্ক কাজ করেনি সংশ্লিষ্ট মাছ ধরার মৎস্যজীবীদের মধ্যে।

জেলেরা নদীতে নেমে মাছ ধরার যে সৎসাহস দেখিয়েছেন তাও এই বঙ্গভূমির সন্তানদের এক লড়াকু অভিগমন। যা দেশটাকে সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামল করতে প্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছে। মৎস্য সম্পদেও আমরা বিশ্বের প্রায় স্বয়ংম্ভর এক  জাতিসত্তা। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’Ñএমন প্রবাদ তো জন্ম জন্মান্তরের এক অনন্য বৈভব। জাতীয় মাছ রুপালি ইলিশের কদর তো বিশ্বজোড়া। যা অঞ্চলবাসীর ও এক অভাবনীয় পরম পাওয়াই শুধু নয় তৃপ্তিও বটে। বাংলাদেশে ‘দানা’ মারাত্মক আঁচড় বসাতে না পারলেও পশ্চিম বাংলার উড়িষ্যায় তার ক্ষতবিক্ষত দাপটে ইতোমধ্যেই উঠে এসেছে।

‘দানা’ পশ্চিমবঙ্গের উড়িষ্যার ধামরা মৎস্য বন্দর দিয়ে সন্নিহিত কণিকা দ্বীপ হয়ে সাগরদ্বীপে আঁছড়ে পড়ে তা-ব চালায়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ বিভিন্ন সময় উপকূলীয় ঝড়ঝাপটা আর প্লাবনে অস্বস্তিকর জীবন কাটানো চিরস্থায়ী এক দুর্বিপাক। তেমন সংকট মোকাবিলা করেই উপকূলীয় অঞ্চলবাসী নিজেদের যেভাবে সুরক্ষা দিয়েছে পাশাপাশি ভাঙনের উম্মত্ততাকেও সন্মুখ সমরে সামলানোর ইতিবৃত্ত সেই পুরাকাল থেকে আজ অবধি।
লেখক : সাংবাদিক

×