ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১

সডিনরি মলেব্যাগ

কিং চার্লসের সফর ও করমর্দন

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

কিং চার্লসের সফর ও করমর্দন

কিং চার্লস

মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু সময় ধরা দেয়, যা অভূতপূর্ব। যার কোনো ব্যাখ্যা বা পূর্বাভাস অসম্ভব। তেমনি এক বিরল ঘটনা ঘটেছে আমার জীবনে। সে ঘটনায় যাওয়ার আগে বলি, আমরা সবাই জানি আড়াই শ’ বছর ধরে আমরা ব্রিটিশের অধীনে ছিলাম। তখন উপমহাদেশ মানে একটি রাষ্ট্র। অখ- সেই ভারতের অংশ ছিলাম আমরা। ব্রিটিশ শাসনের সুফল আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। তারা না শেখালে আমরা চা পান করতে জানতাম কি না, বা জানলেও তা কখন জানতাম তা বলা মুশকিল। ইংরেজ ছিল বলেই আমরা পোশাকে আধুনিক হয়েছিলাম। সেটা না হলে আমাদের হয়তো ধুতি টিকি লুঙ্গিতেই কাটতো জীবন। ইংরেজ শাসনের কারণে আমরা ফুটবল  ও ক্রিকেট শিখেছি।

ইন্দোনেশিয়া থাইল্যান্ড এমন দেশগুলোর দিকে তাকালে জানবেন কেন আমরা ক্রিকেটপাগল জাতি। কারণ, ইংরেজরাই আমাদের শিখিয়ে গেছে এই খেলা। তারা চলে গেছে অনেক বছর। কিন্তু এখনো তাদের গৌরবের রেশ বহমান। অন্য কোন শাসক দেশের কমনওয়েলথ নামের কিছু  নেই। একমাত্র ইংরেজশাসিত দেশগুলোই এখনো কমনওয়েলথে একীভূত। যার শক্তি বা গুরুত্ব কম নয়।
প্রথমেই বলি সিডনিতে অভিবাসন নিয়ে আসার পর প্রথম যে ভোটটিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাই তা ছিল একটি গণভোট। তখন ছিলেন রানী এলিজাবেথ। তাঁকে মানবেন কি মানবেন না সেটি নির্ধারণ করার জন্য গণভোট হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া জুড়ে। রিপাবলিকের রাষ্ট্রপ্রধান রানী থাকবেন না এদেশের কেউ তার জায়গায় বসবেনÑ এই ভোটে জয় হয় রাজত্বের। রাণী থেকে যান এদেশের আলংকরিক প্রধান হিসেবে। সেই নির্বাচনে আমার ভোটটি নষ্ট হয়নি। তখনই বুঝেছিলাম এদেশের জন্য রাণীর ছায়ার প্রয়োজন।

নানাবিধ ঘটনা বা রাজা রাজত্বের বহু অঘটনে মতামত দ্বিধাবিভক্ত হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। যেমনÑ প্রিন্সেস ডায়নার অকালমৃত্যুর পর ইংরেজ রাজ পরিবারের ওপর মানুষের এক ধরনের বিতৃষ্ণা জন্মে। জনপ্রিয় ডায়না’র মৃত্যুকে হত্যাকা- মনে করা মানুষের সংখ্যা বেশ বড়। তারা এখনো রাজ পরিবারের ওপর বীতশ্রদ্ধ। তবু রানী যতদিন ছিলেন আস্থা আর বিশ্বাস ছিল অটুট।
তাঁর মৃত্যুর পর রাজা হন চার্লস। দীর্ঘ সময় যুবরাজ থাকা চার্লস আসলেই রাজা হতে পারবেন কি না এ প্রশ্ন যখন সবার মনে, তখন শেষ বয়সে তিনি রাজার আসন লাভ করেন। ১৪ নভেম্বর, ১৯৪৮ গ্রীনিচ মান সময় ৯:১৪ মিনিটে বাকিংহাম প্রাসাদে চার্লস জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের আগেই ২২ অক্টোবর, ১৯৪৮ তারিখে রাজা ষষ্ঠ জর্জের রাজাজ্ঞা পত্রের মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছিল যে, প্রিন্সেস এলিজাবেথ এবং ডিউক অব এডিনবরার কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করলেই সন্তানটি বিবেচিত হবে রাজকুমার হিসেবে। সেই সূত্রে চার্লস জন্মকালীন সময় থেকেই প্রিন্সের মর্যাদাপ্রাপ্ত হন।
এই রাজ পরিবারের সঙ্গে আমাদের দেশের সম্পর্কও গভীর। যাঁরা স্যার বা নাইটহুড উপাধি লাভ করেন তাঁরা রানী বা রাজার সাধে দেখা করতে পারেন। কারণ, ঐ খেতাবটি তাঁর কাছ থেকেই নিতে হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্রপ্রধান সরকারপ্রধান না হলে তাঁদের দেখা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি না কোনো কারণে তাঁদের প্রাসাদে আপনি আমন্ত্রিত না হন। আমন্ত্রিত হলেই যে আপনি কাছে গিয়ে কথা বলতে পারবেন বা করমর্দন করতে পারবেন, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
আমার এক অসাধারণ সৌভাগ্যের কথা বলার আগে রাজা চার্লসের এবারের অস্ট্রেলিয়া সফরের নেতিবাচক একটি ঘটনা বলি। রাজা এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। রাজা চার্লসের বক্তৃতার পর সিনেটর থর্প চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘আমাদের জমি ফেরত দাও! তুমি আমাদের কাছ থেকে যা চুরি করেছ তা ফেরত দাও! এটা তোমার জমি নয়, তুমি আমার রাজা নও।’ এর আগে তিনি ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের ‘গণহত্যা’ করা হয়েছে বলেও দাবি করেন। কেননা, অস্ট্রেলিয়া একশ’ বছরেও বেশি সময় ধরে একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল।

সেই সময়ে হাজার হাজার আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানকে হত্যা করা হয়েছিল এবং সম্প্রদায়গুলোকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া ১৯০১ সালে প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু কখনই একটি পূর্ণাঙ্গ প্রজাতন্ত্র হয়ে উঠতে পারেনি। যেখানে রাজা চার্লস বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান। আর সেই সুবাদেই বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া ও সামোয়ায় ৯ দিনের সফরে এসেছিলেন তিনি। যা তার ক্যান্সার নির্ণয়ের পর প্রথম বড় সফর।
এ সময়ে হঠাৎ করে একদিন আমি একটি ম্যাসেজ পেয়ে বিস্মিত হয়ে যাই। আমার পুত্র অর্ক একটি আমন্ত্রণ পত্র পাঠায়। নিউ সাউথ ওয়েলস তথা এদেশের সবচেয়ে বড় এবং জনবহুল অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পাঠানো এই আমন্ত্রণপত্রে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রী অর্ককে বার বি কিউ পার্টিতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সে সঙ্গে একজন অতিথিকেও নিতে পারবে। এই বার বি কিউ পার্টিতে উপস্থিত থাকবেন ব্রিটিশ রাজা চার্লস ও তাঁর পতœী কামেলা। সিদ্ধান্ত হলো একজন অতিথি হিসেবে অর্ক আমাকে সঙ্গে নেবে। এরপর অপেক্ষার পালা। পার্টির তিন দিন আগে জানানো হলো কড়া নিরাপত্তার লিখিত বিধান।

ড্রেসকোডে না স্যুট না টাই ক্যাজুয়াল এমনকি যার যার দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করলেও চলবে। বাড়ির কাছে বিশাল এক পার্কের একটি চত্বরকে নিরাপত্তায় মুড়ে আয়োজিত বার বি কিউ পার্টিতে গিয়ে দেখি আমন্ত্রিতদের জন্য জামাই আদরের ব্যবস্থা। ত্রিশ-বত্রিশটি স্টল বা তাঁবুতে ব্যাপক খানাপিনার আয়োজন। বিশ্বখ্যাত সুরা, নরম পানীয় থেকে শুরু করে দেশীয় খাবার চা-কফি সবকিছু অঢেল। আমরা খাই আর ঘুরি। ভাবলাম রাজা আসবেন হাত নাড়বেন চলে যাবেন।
কিন্তু তাঁর আগমনের ঠিক দশ মিনিট আগেই দড়ি দিয়ে দুই ভাগে ভাগ করা হলো মানুষজনকে। মাঝখানে অল্প একটু যাওয়ার পথ। যে পথ দিয়ে রাজা হেঁটে গিয়ে খোলা মঞ্চে উঠবেন। দড়ির একদিকে কামেলা আরেক দিকে রাজা চার্লস। সৌভাগ্যক্রমে কিং পড়লেন আমাদের দিকে। কা’র সঙ্গে হাত মেলাবেন আর কা’র সঙ্গে মেলাবেন না সেটা ভাগ্য কিংবা লটারীর মতো। ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে থাকা রাজা  আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দনের ফাঁকে কথাও হলো একটু আধটু।

আমার পেছনে দাঁড়ানো অর্কের সঙ্গেও বাক্য বিনিময় করে করমর্দন করলেন কিং চার্লস। আমাদের ঘোর কাটতে না কাটতে পার্কের খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বল্ল কথায় ভাষণ দিলেন তিনি। কী আশ্চর্য, বসার জন্য একটি চেয়ারও রাখা ছিল না। ছোট্ট ভাষণে কোনো গুরুগম্ভীর কিছুই বলেননি তিনি। রাজনীতিও না। হালকা রসিকতা আর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ চেনাজানার গল্প বলেই শেষ করলেন। কিং চার্লস দুনিয়া কাঁপানো হলেও সহজ সরল। রাজা চলে গেছেন। আর কোনোকালে কোনো দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না। কিন্তু আজীবন মনে থাকবে করমর্দনের সুখস্মৃতি, যা এক জীবনে আসে না বারবার।
    [email protected]

×