ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১

বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের প্রাসঙ্গিকতা

ড. মো. আবু তাহের

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের প্রাসঙ্গিকতা

বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের প্রাসঙ্গিকতা

পৃথিবীব্যাপী  জ্ঞান সৃষ্টি,  বিস্তরণ ও নতুনত্ব উদ্ভাবনের ইনকিউবেটর বা  বাতিঘর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। মূলত অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, গবেষণা ও চিন্তার ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনপূর্বক  এমন আলোকিত মানুষ তৈরি করবে যারা সুস্থ চিন্তা, মানবিকতা ও নৈতিকতা দিয়ে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবেন।  
বিশ্ববিদ্যালয়কে  স্বায়ত্তশাসন এজন্য দেওয়া হয়, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থী মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে জ্ঞান চর্চা করতে পারেন। The Lima Declaration on Academic Freedom and Autonomy of Higher Education Institutions (১৯৮৮) স্বায়ত্তশাসন  ধারণাকে নিম্মোক্তভাবে ব্যক্ত করেছে- ‘Autonomy means the independence of Institutions of higher education from the state and all other forces of society, to make decision regarding its internal government, finance, administration, and to establish its policies of education, research, extention work and other related activities.’
সংখ্যাগত বিবেচনায় উচ্চশিক্ষার প্রসারে বাংলাদেশে  ইতোমধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তবে গুণগতমান নিয়ে বেশ প্রশ্ন রয়েছে। চলমান চতুর্থ  শিল্প বিপ্লবের হাতছানিতে কেবল  প্রযুক্তি দক্ষতায় মানবসম্পদ গড়ার মধ্য দিয়ে রক্তমাংসের যন্ত্রদানব নয়; বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী মানুষ নির্মাণের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে । অন্যথায়, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও  নৈতিক সমাজের আকাক্সক্ষা পথ হারিয়ে আস্তাকুঁড়ে নিপতিত  হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান সৃজনের কাননে সাহিত্য, ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিল্পকলা-চারুকলার সুবাস  না ছড়ালে মানবিক মানুষ তথা মানবিক সমাজ বিনির্মাণের পথ অবরুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। এজন্য  বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলকেই যথাযথ পর্ষদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়।  
উল্লেখ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় আবিষ্কার ও উৎকর্ষে  নতুন সভ্যতা বিনির্মাণের পথে অগ্রগামী হচ্ছে বিশ্ব। উন্নত দেশগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণালব্ধ ফলকে  কাজে লাগিয়ে    নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করার দিকে ধাবমান। আমরা সেখানে বিস্তর পিছিয়ে। যন্ত্রের দাসত্ববরণের অসহায়ত্বকে জয় করে মানুষের মর্যাদায় অবতীর্ণ  হতে আমাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নির্যাস আস্বাদন করতে হবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের  গুরুত্ব সমধিক। 
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। তাই  উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে টিকে থাকতে এবং উন্নত দেশে  রূপান্তরের লক্ষ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষের কোনো বিকল্প  নেই। পাশাপাশি  বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। প্রণয়ন করতে হবে কৌশলগত গবেষণা পরিকল্পনা। উপরন্তু, উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন ও উৎকর্ষের জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের সমস্যাদি নিয়ে যৌথ গবেষণা প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত গবেষণালব্ধ ফল কাজে লাগিয়ে শিল্প উদ্যোক্তারা পণ্য, সেবা বা প্রযুক্তির উৎকর্ষ বৃদ্ধি এবং বৈচিত্র্য আনয়ন  করতে সক্ষম হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে, সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভরশীলতা এবং আর্থিক  ঘাটতির  পরিমাণ কিছুটা হলেও কমে আসবে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের তরুণ সমাজের একটি মেধাবী অংশ ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিজেদের প্রস্তুত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করে। তাদের সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলেরই একটি ঐক্যবদ্ধ ও সামষ্টিক প্রচেষ্টা অপরিহার্য। সরকার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেই অভীষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে হবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অংশ হয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণের রূপকল্প বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলেরই ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের ওপর স্বায়ত্তশাসনের প্রাসঙ্গিকতা অনেকাংশে নির্ভর করে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন রক্ষা এবং এই আইনকে সমুন্নত রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে। 
বিশ্ববিদ্যালয় সমাজেরই একটি অংশ। তাই  সমাজের বিভিন্ন কর্মকা-ের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেলবন্ধন অতীব জরুরি। পঠন-পাঠন, জ্ঞান সৃষ্টি-বিতরণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে তৈরি করার লক্ষ্যে সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ নিয়মিত পাঠদান করে যথাসময়ে কোর্স সম্পন্ন করবেন, পরীক্ষাসমূহ যথাসময়ে গ্রহণ ও এর ফলাফল প্রকাশ করবেন, নিজস্ব গবেষণার বাইরেও শিক্ষার্থীদের গবেষণাকর্ম তত্ত্বাবধান করবেন, শিক্ষার মান উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রয়াস অব্যাহত রাখবেনÑ এটাই তো স্বাভাবিক। এজন্য প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলাবিরোধী কিংবা উচ্ছৃঙ্খলতা করলে দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে তা কঠোর  হস্তে দমন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সব সময় সচেষ্ট থাকতে হবে। 
বিশ্ববিদ্যালয় যেমন স্বাধীন জ্ঞান চর্চার লালনভূমি, তেমনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ স্থান। কুসংস্কার বা পশ্চাদ্মুখী চিন্তা ভাবনার স্থান এটি নয়। পা-িত্য ও জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ, পরমতসহিষ্ণুতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে, আদর্শগত বৈসাদৃশ্য  থাকাও  অস্বাভাবিক কিছু নয়, বিভিন্ন মত ও আদর্শের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও পরমতসহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য  বজায় রাখতে পারলে  বিশ্ববিদ্যালয়ের অভীষ্ট  লক্ষ্য অর্জন করা খুব সহজ হয়। 
নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও শিক্ষার্থীদের অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে চাইÑ ‘শিক্ষার প্রকৃত ক্ষেত্র সেইখানে  যেখানে বিদ্যার উদ্ভাবনা চলিতেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য কাজ বিদ্যার উৎপাদন তাহার গৌণ কাজ  সেই বিদ্যাকে দান করা। বিদ্যার ক্ষেত্রে সেই সকল মনীষীদেরকে আহ্বান করিতে হইবে যাহারা নিজের শক্তি ও সাধনা ধারা অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও সৃষ্টির কাজে নিবিষ্ট আছেন। তাহারা যেখানে নিজের কাজে একত্র মিলিত হইবেন সেখানে স্বভাবতই জ্ঞানের উৎস উৎসারিত হইবে, সেই উৎসধারায়  আলোকে  দেশের প্রতিটি  বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইবে।’
বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় হোক জ্ঞানচর্চার  চারণভূমি।  উক্ত চারণভূমিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করবে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত  ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং যে কোনো অন্যায়-অবিচার-শোষণ-নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। একই সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের  পাঠদানরত/ অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয়ের  ভিশন ও মিশন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা  থাকা প্রয়োজন।
বিদগ্ধজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন ও মিশনকে নিম্মোক্তভাবে  ব্যাখ্যা করেছেন- The vision of University is to attain the global height in higher education through creative endeavour. The mission of University is to acquire and impart knowledge through cutting -edge research, engagement- oriented teaching learning, intensive training, extensive collaborations and engaging dialogues in a highly motivated environment through the adoption of innovative approaches for intellectual enlightenment of the stake- holders of the university including the nations and the global community and also innovative initiative to serve the mankind.’
বর্ণিত ভিশন ও মিশন অর্জনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলকে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একযোগে কাজ করে শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে (যেমন-Teaching-learning & assessment; students admissions and support service; faculty and professional staff development; research, innovation and scholarly activities; institutional integrity and transparency; leadership responsibility and autonomy; good governance; monitoring, evaluation and continual improvement; facilities & resources; outcome based education (OBE) curriculum and so on)

উৎকর্ষ আনয়ন  করতে হবে।  বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের  যেমন স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে, তেমনি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিসহ  অর্পিত দায়িত্ব  যথাসময়ে সম্পাদনে আরও  সচেতন ও দায়িত্বশীল  হতে হবে। অন্যথায়, নিকট ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়  স্বায়ত্তশাসনের প্রাসঙ্গিকতা হারাবে, যা জাতির জন্য কোনো অবস্থাতেই সুখকর হবে না। 


লেখক : অধ্যাপক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×