ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২ কার্তিক ১৪৩১

ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব অপরিসীম

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এ খাতে সুশাসন সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাকে অনেক উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে বলে  অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন। গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। যেমনÑ সুশাসনের অভাব এবং এ খাতের জন্য প্রণীত নীতিমালা, আইন-কানুন, কোম্পানি আইন, আন্তর্জাতিক নীতিমালা ইত্যাদি সঠিকভাবে পরিপালন করা হয় না কিংবা নিয়ম-কানুন আন্তর্জাতিকমানের হলেও এগুলো সঠিকভাবে অনুসৃত হয় না।

ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি দায়িত্ব বিবেচনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সংজ্ঞায় স্বচ্ছতা হলো এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি যেখানে মুদ্রা ও আর্থিক নীতি সম্পর্কিত সব তথ্য সময় সময় জনগণকে বোধগম্য উপায়ে জানানো হয়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে টেকসই সুশাসন ও সার্বিক আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সরকারি কার্য পরিচালনায় স্বচ্ছতা বিধান এর পূর্বশর্ত। জবাবদিহি হলো পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে বিদ্যমান সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি বা বেসরকারি কোনো এজেন্ট কর্তৃক সুলভে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান।

আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণকারী প্রধান গোষ্ঠী ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতা, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারী, জাতীয় কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানÑ সবার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির যথার্থ উদাহরণ  এ দেশে রয়েছে। যেমনÑ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় এ সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। যদিও  বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এর বাইরে নয়। ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অবস্থা শক্তিশালী করতে ২০২৩ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি ব্যাংকের সোয়া ৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমানো অর্থাৎ, এ টাকা খেলাপিদের কাছ থেকে আদায় করা হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি করেছিল। 
চুক্তিতে বলা হয়, খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। যার  কারণে প্রভিশন ও মূলধনের পর্যাপ্ততা সঠিক মানে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য আগামী দিনে অধিক পরিমাণ ভালো ঋণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি নগদ আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনা হবে। সেখানে ব্যাংকিং খাতের আর্থিক অবস্থা শক্তিশালী করতে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ব্যাংকগুলোর মতে, খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধির কারণে মূলধন সংকট দেখা দিয়েছে, যে কারণে গ্রাহকরা ব্যাংকের ওপর ভুগছে আস্থাহীনতায় ।
এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের প্রচলিত ১০টি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেসবের মধ্যে ইসলামী ধারার অর্ধেক ব্যাংক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকায় ডুবতে যাওয়া এ সকল ব্যাংক খাতে আশার আলো দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে টাস্কফোর্স গঠন, কমপক্ষে এক ডজন ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, দখলদারদের হাত থেকে ব্যাংক উদ্ধার এবং কাগুজে নোট ছেপে ব্যাংকের তারল্য সংকট না কমানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ফল দেবে বলে মনে করছেন তারা। তবে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকে এখনো তারল্য সংকট আছে।

ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সিলিং তুলে দেওয়া হলেও এখনো কোনো কোনো ব্যাংক বড় অঙ্কের চেকে টাকা দিতে পারছে না বলে অভিযোগ আছে। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর অর্থ উপদেষ্টা করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদকে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করা হয় অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকার ড. আহসান এইচ মনসুরকে। দুজনই ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের কথা, তারা যে উদ্যোগ এরই মধ্যে নিয়েছেন তা অব্যাহত থাকলে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরে আসবে। আর সুশাসন ফিরে এলে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কাটবে। গ্রাহকের আস্থা ফিরে পাবে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৭টি ব্যাংক ‘উদ্ধার’ করেছে। ওই সাতটি ব্যাংকসহ মোট ১২টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো হলোÑ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউসিবি, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এর বাইরে আরও কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হবে বলে জানা গেছে।

এসব ব্যাংক আসলে নিজেদের আত্মীয়স্বজনের পরিচালনা পর্ষদ দিয়ে চলত। এস আলম ছয়টি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ৯৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এর পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। দেশের মোট ৫৪টি ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে গত সরকারের আমলেই ৩৮টি ব্যাংককে ‘দুর্বল ব্যাংক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। সেই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করার কাজও করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকদের অর্থ না তুলে সবল ব্যাংকে না রাখতে। তাহলে ওই ব্যাংকগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।

তিনি গ্রাহকদের  আমানতের নিশ্চয়তাও দিয়েছেন। আর সবল ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে দুর্বল ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্যের আমানত রাখতে। তাদের তারল্যের একটি অংশ যদি দুর্বল ব্যাংকগুলো পায় তাহলে তারাও সবল হয়ে উঠবে। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক সংস্কার কমিশন না করে টাস্কফোর্স গঠন করার কারণে ব্যাংক সংস্কার দ্রুত গতিতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)  বলেন, ‘মোট তিনটি টাস্কফোর্সের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালী করা, বাণিজ্যিক ব্যাংক শক্তিশালী করা ও খেলাপি ঋণ বিষয়ক এবং আরেকটি হলো বণিজ্যিক ব্যাংক পুনর্গঠন।

ফলে সূচনাটা বেশ ভালো দেখছি। আশা করছি এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরে আসবে। ব্যাংক খাত নিয়ে শ্বেতপত্রও প্রকাশ করা হবে। টাস্কফোর্স আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ, প্রধান ঝুঁকিগুলো নিরূপণ করবে। এছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথকীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তিনি আরও বলেন, ‘টাস্কফোর্সগুলোর প্রতিবেদন পাওয়া গেলে ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি পরিষ্কার হবে।’
ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যার একটি হলো খেলাপি ঋণ। দেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণগ্রস্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানকেও আর ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। আর নানা কৌশলে ঋণ অবলোপন বা খেলাপি তালিকার বাইরে থেকে ঋণ নেওয়াও বন্ধ করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, এখন খেলাপি ঋণ আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ফুটোগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করছে।

কিন্তু ওইসব ফুটো দিয়ে যে হাজার হাজার কোটি টাকা বের হয়ে গেছে তা উদ্ধার করতে হবে। দেশের বাইরে ওই অর্থ পাচার হয়েছে। তাও ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে হবে। তার মতে, ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্র, রাজনৈতিক প্রভাব দূর করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এর সুফল পেতে আরও সময় লাগবে। আর বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন,  ব্যাংক খাতে মূল কাজ হলো আস্থা ফিরিয়ে আনা, এই খাতে লুটপাট বন্ধ করা, একই সঙ্গে ব্যাংক খাত পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত না করা।

বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে তার মাধ্যমে আস্থা ফিরে আসবে বলে মনে করি। এরপর ধাপে ধাপে আরও সংস্কারের কাজ করতে হবে। ব্যাংক খাতে পুরোপুরি সুশাসন দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক আর টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করবে না। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি কমার আশা করা হচ্ছে। ব্যাংকের সুদের হারও বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের সুদের হার। বাংলাদেশ ব্যাংক আর সরাসরি সরকারকে ঋণ দেবে না। সরকারকে ঋণ নিতে হলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে আর টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিতে হবে না। এর ফলেও মুদ্রাস্ফীতি কমবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে এবং নতুন খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে হবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে তা যথাযথ পর্যালোচনা করতে হবে, প্রদত্ত ঋণকে তদারকি করতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় আইন, গাইডলাইন এবং নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন, গাইডেন্স এবং তদারকি বাড়াতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকেও দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। ব্যাংক সেক্টরের উন্নয়নের স্বার্থেই বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে। অধিকন্তু অর্থঋণ আদালতসহ আইনি প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত এবং সংস্কার করতে হবে, যাতে আইনের সাহায্য নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় এবং ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। 
তাছাড়া গ্রাহককে যেনতেন প্রকারে ঋণ প্রদান করে মুনাফা অর্জনের টার্গেট ব্যাংকগুলোকে পরিহার করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণ নীতিমালা পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং ঋণকে বিভিন্ন সেক্টরে বণ্টন করতে হবে। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন শক্তিশালী করতে হলে বিদ্যমান আইনের সংস্কার প্রয়োজন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমানে কিছু উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে। যেমনÑ ঋণ পুনরুদ্ধার কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা।

এসব উদ্যোগ তখনই সফল হবে যখন ঋণখেলাপিরা দেখবে যে, আইনের প্রয়োগ হচ্ছে এবং কাউকেই অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে না। প্রয়োজনে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হোক। প্রস্তাবিত কমিশনের ম্যান্ডেট হতে পারে বিষয়গুলোর ওপর সুচিন্তিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চিহ্নিত করা, খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য সমস্যার মূল চিহ্নিতকরণ; আইনি কাঠামোর সংস্কার; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা বিধান; ব্যাংক বোর্ড গঠনের জন্য নীতিমালা; আইন প্রয়োগে সমস্যার চিহ্নিতকরণ এবং আইনের পরিবর্তন। কমিশন ব্যাংক খাতের দক্ষ, যুগোপযোগী ও সুশাসনভিত্তিক পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেবে।

সরকারকে সেসব পরামর্শ বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে এ ধরনের উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এখন খেলাপি ঋণ আদায়ে ও সুশাসনে  যে সকল বিষয় সুবিবেচনায় আনার প্রয়োজন রয়েছে তা হলোÑ প্রথমত, ঋণ বিতরণ ও আদায়ে সমতা বিধান করা। ঋণ বিতরণ যদি স্বচ্ছতার সঙ্গে উৎপাদনশীল খাতে হয় তাহলে আদায়ের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ ব্যাপারে ব্যাংকার ও কাস্টমারের  নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যারা অসাধুতাকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত করে তারাই উভয়ই সমান দোষী। এ ব্যাপারে প্রথমে ব্যাংকারদের সতর্ক হতে হবে এবং পরবর্তীতে গ্রাহকদেরও এই পথ অনুসরণ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, দেশের ৩৯টি বেসরকারি ও চারটি সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাধারণত আর্থিক বাজারের অংশ হিসেবে স্বল্পমেয়াদে গৃহীতাদের ঋণের চাহিদা পূরণ করার কথা। বাস্তবে দেখা যায় এই ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে, যার বেশিরভাগ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিয়মনীতি ভঙ্গ করে  ঋণ দেওয়া এবং ঋণ খেলাপি হওয়ার মতো একটি যাতনাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। যার ফল তারল্য সংকট, মুনাফার ঘাটতি ও ইমেজ সংকট।

অথচ দীর্ঘমেয়াদে বৃহদায়কার ঋণ প্রদানের জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক যেমন- বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), বেসিক ব্যাংক, রাকাব ইত্যাদি রয়েছে যারা সরকারি ব্যাংক হিসেবে সরকারের সাহায্যপুষ্ট হয়ে বেশি সময়ের জন্য অর্থায়নে অংশ নিতে পারে। এই অসংগতিগুলো  দূর করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, ব্যাংকিং খাতের বৃহদাকার ঋণগুলোর স্বচ্ছতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন না হওয়ায় অনেকে অলাভজনক খাতেও ঋণ বিনিয়োগ করেছে, যা পরবর্তীতে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক লোন মঞ্জুর করা হয়। যার বেশিরভাগ অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যায়। যার পরিণতি হয় খেলাপি ঋণ। 
গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করলেও  অন্তত ব্যাংকিংয়ের মতো সেবাধর্মী আর্থিক খাতটিকে রাজনীতিমুক্ত রাখা যাবে না কেন? এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতের অভিভাবক হিসেবে তার সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারে না কেন? চতুর্থত, ঋণ মওকুফ, ঋণের পুনঃতফসিলিকরণ, ঋণের অবলোপন ইত্যাদি বিষয় এখন খুবই ক্ষতিকর ও অলাভজনক। ব্যাংকও ঢালাওভাবে সবাইকে সুযোগ দিতে পারে না কিংবা  ঢালাওভাবে বিবেচনায়ও আনতে পারে না।

এখানে ব্যাংকার কিংবা ব্যাংকিং সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সহায়তা, প্রশাসনিক সমর্থন ইত্যাদি তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য খুব জরুরি। সবশেষে বলা যায়, সরকার যদি সচেষ্ট হয় তবে সামাজিকভাবে খেলাপি ঋণের মোকাবিলা করা সম্ভব, আবার প্রশাসনিকভাবেও সম্ভব। এখন কোনটি ভালো হবে তা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবে। তবে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই ব্যাংকিং শিল্পের স্বার্থে।
    
    লেখক : গবেষক ও অর্থনীতিবিদ

×