ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২ কার্তিক ১৪৩১

কিংবদন্তি ম্যান্ডেলার অনুকরণীয় আদর্শ

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

কিংবদন্তি ম্যান্ডেলার অনুকরণীয় আদর্শ

নেলসন ম্যান্ডেলা

নেলসন ম্যান্ডেলা, যিনি বর্ণবাদী শাসন অবসানের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় বহুজাতিক গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, বিশ্বের অন্যতম অনুকরণীয় ও সম্মানিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিগণিত। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব, উদার ব্যক্তিত্ব এবং ত্যাগের মাধ্যমে তিনি একটি জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। ম্যান্ডেলার জীবনের এই দিকগুলোÑ তাঁর শক্তিশালী আদর্শ, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের বিপরীতে ক্ষমা প্রদর্শন এবং বৈরিতা ভুলে সমন্বয় তৈরির ক্ষমতাÑ এমন কিছু দিক যা সারাবিশ্বের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এই শিক্ষা থেকে বাংলাদেশে সমূহ সম্ভাবনার সুযোগ রয়েছে।
নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনের শুরু থেকেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি স্পষ্ট ছিল। ১৯১৮ সালে ইস্টার্ন কেপ প্রদেশে থেম্বো রাজকীয় পরিবারের কাউন্সিলরের সন্তান হিসেবে তাঁর জন্ম। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘মাদিবা’ নামে, যা তাঁর পূর্বপুরুষের গোত্রের নাম ছিল। জোহানেসবার্গে চলে আসার পর তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) যুব শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে চালিয়ে যাচ্ছিলেন ম্যান্ডেলা এবং তাঁর দল। কিন্তু ১৯৬০ সালে শার্পভিলে বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে ৬৯ জন নিহত হলে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ম্যান্ডেলা তখন উপলব্ধি করেন যে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন যথেষ্ট নাও হতে পারে এবং এএনসি সশস্ত্র সংগ্রামে মনোনিবেশ করে। এর ফলে, সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তাঁকে কারাবন্দি করে এবং ম্যান্ডেলা যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হন।
দক্ষিণ আফ্রিকার রোবেন দ্বীপে নেলসন ম্যান্ডেলার দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাজীবন ছিল অমানবিক কষ্টের প্রতীক। সেখানে তাঁকে কঠোর শ্রম করতে হতো এবং শারীরিক নিপীড়নের পাশাপাশি তিনি মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কারাগারে বন্দি থাকাকালীন তাঁর চোখের দৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং তিনি পরিবারের সঙ্গেও প্রায় যোগাযোগ করতে পারতেন না। তবুও, এই অমানবিক পরিস্থিতি ম্যান্ডেলার মনোবলকে ভাঙতে পারেনি। বরং এই সময়ের মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিহিংসা পোষণ না করে ক্ষমা এবং সংলাপের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। 
ম্যান্ডেলা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ঘৃণা মানুষের মনকে অন্ধকারে ঢেকে দেয় এবং সে কৌশলগতভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারায়। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘ঘৃণা মনকে অন্ধকার করে দেয়। কৌশলের পথ রুদ্ধ করে দেয়। নেতাদের ঘৃণা করা সাজে না।’ এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি বুঝেছিলেন যে, শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা বা বিদ্বেষের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাঁর মতে, সত্যিকারের মুক্তি এবং সমতা অর্জন করতে হলে ক্ষমা, সহানুভূতি এবং সমঝোতার পথে হাঁটতে হবে। ম্যান্ডেলার এই অসাধারণ জীবনদর্শন তাঁকে শুধু একজন বিপ্লবী নেতা হিসেবে নয়, একজন শান্তির দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
কারাগারে কাটানো এই দীর্ঘ সময় তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার বৃহত্তর জনগণের জন্য একতাবদ্ধ হওয়ার পথে চলতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর জীবনের এই অধ্যায় থেকেই তিনি ক্ষমা এবং পুনর্মিলনের শক্তিতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী হন। তিনি যে সংগ্রাম করেছিলেন, তা ছিল শুধু মুক্তির জন্য নয়, বরং শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং জাতীয় সংহতির জন্য। ম্যান্ডেলার এই মতবাদ তাঁকে একজন বিশ্বনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যিনি ইতিহাসে তাঁর অবদান রাখার মাধ্যমে অনন্তকাল ধরে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ক্ষমা ও পুনর্মিলনের প্রতি নেলসন ম্যান্ডেলার অঙ্গীকার তাঁর নেতৃত্বের অন্যতম অনুকরণীয় দিক। তিনি প্রতিশোধের বদলে ক্ষমা ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে জাতিকে একতাবদ্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। ১৯৯০ সালে দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাবাস শেষে মুক্তি পাওয়ার পর ম্যান্ডেলার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেওয়া।

প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের পরিবর্তে তিনি শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ উভয় সম্প্রদায়কে একত্রিত করার প্রয়াস নেন। ২৭ বছর জেল খাটার পর তিনি যেভাবে তাঁর পূর্বেকার শত্রুদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে সচেষ্ট হয়েছেন তা গোটা বিশ্ববাসীকে অবাক করেছে। এই অসাধারণ গুণের জন্য তিনি আজও বিশ্বে সমাদৃত; আজও প্রাসঙ্গিক এবং চির অনুকরণীয়।  
১৯৯৪ সালের ১০ মে, ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন দেশকে বর্ণবাদ থেকে মুক্ত করা এবং গণতান্ত্রিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। বর্ণবাদী সরকারের শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের প্রতি প্রতিশোধের পরিবর্তে তিনি তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে জাতি পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন। ম্যান্ডেলার বিশ্বাস ছিল, ক্ষমার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
ম্যান্ডেলার ক্ষমা ও পুনর্মিলনের বার্তা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। তিনি বলেন, ‘যদি কেউ ঘৃণা করতে শেখে, তাহলে সে ভালোবাসা শিখে নিতে পারে। ঘৃণা নয়, মানব হৃদয়ে স্বাভাবিকভাবে ভালোবাসার জন্ম হয়।’ এই মনোভাবের কারণেই তিনি তাঁর সাবেক শ্বেতাঙ্গ শাসকদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কাজ করেন। তাঁর এই উদারতা এবং ক্ষমার নীতি শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়, সারাবিশ্বে শান্তি ও সহনশীলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার পুনর্মিলন প্রক্রিয়াটি ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে সম্ভব হয়েছিল, যা বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ম্যান্ডেলার এই অনন্য আদর্শ তাঁকে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাতেই নয়, সারাবিশ্বে শ্রদ্ধা ও সম্মান এনে দিয়েছে। তিনি শান্তি এবং মানবাধিকারের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচার চালিয়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন সংবিধান প্রণীত হয়, যা কেন্দ্রীয় সরকার, আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি স্থাপন করে। এই সংবিধান অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ব্যক্তি যেই হোক বা তার চামড়ার রং যাই হোক না কেন।
ম্যান্ডেলা ১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্সির মেয়াদ শেষ করে অবসর গ্রহণ করেন, কিন্তু তাঁর জীবনের কর্মব্যস্ততা থামেনি। স্বাধীনতা এবং বিশ্বশান্তির প্রতীক হিসেবে তিনি সক্রিয়ভাবে জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিযুক্ত রাখেন। বিশেষত, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং এইডস নিরাময়ের জন্য প্রচারণায় তিনি কাজ করেছেন। ম্যান্ডেলা সবসময় মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন এবং মানবাধিকারের পক্ষে তাঁর সোচ্চার অবস্থান ধরে রেখেছিলেন।

নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এবং তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার হলো ক্ষমা এবং মীমাংসা ও আপোস-নিষ্পত্তি (রিকন্সিলিয়েশন)। দীর্ঘ ২৭ বছর কারাবাসের পরও তিনি প্রতিশোধের পথে হাঁটেননি। বরং তিনি বুঝেছিলেন, একটি বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর পথ হলো ক্ষমা এবং সহযোগিতার মনোভাব। তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি যতটা অর্জন করতে পারবেন, তার চেয়ে ঢের বেশি অর্জন করতে পারবেন ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে।’ ম্যান্ডেলার এই ক্ষমা ও রিকন্সিলিয়েশনের শিক্ষা শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাকেই নয়, সারাবিশ্বকে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এই দৃষ্টিভঙ্গি আজ প্রাসঙ্গিক।  
তাঁর নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিপক্ষের প্রতি ঘৃণা নয়, ভালোবাসা ও সহানুভূতির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্ষমা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা শত্রুদের বন্ধুতে পরিণত করতে পারে এবং একটি ক্ষতবিক্ষত সমাজকে পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে। এই শিক্ষা তাঁকে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার জাতির পিতা হিসেবেই নয়, সারাবিশ্বের একজন প্রতীকী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
৯৫ বছর বয়সে বিশ্ববরেণ্য মানবতার কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী দূত নেলসন ম্যান্ডেলা ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ম্যান্ডেলাকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি কিভাবে স্মরণীয় থাকতে চান? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চাই আমার সম্পর্কে এরকম কথাই বলা হোক, এখানে এমন এক মানুষ শায়িত আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন।’ এই উত্তরের মধ্যেই নিহিত রয়েছে তাঁর জীবনের সারমর্ম -তিনি ছিলেন একজন দায়িত্বশীল নেতা, যিনি মানুষের মুক্তি, সমতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। তাঁর এই শিক্ষা ও উত্তরাধিকার আজও পৃথিবীর নানা প্রান্তে নিপীড়িত মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে এবং ভবিষ্যতেও তা মানবতার পথ প্রদর্শক হয়ে থাকবে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী একজন কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনের গল্প, তাঁর আদর্শ এবং তাঁর নেতৃত্ব আজও সারাবিশ্বের জন্য প্রেরণার উৎস। তাঁর ত্যাগ, উদারতা এবং ক্ষমার শিক্ষা ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। ম্যান্ডেলা প্রমাণ করেছেন যে সহিষ্ণুতা, ক্ষমা এবং সমঝোতার মাধ্যমে শান্তি এবং উন্নতি অর্জন করা সম্ভব। তাঁর আদর্শ শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাই নয়, সারাবিশ্বে মানবতার পথে নতুন দিশা দেখিয়েছে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে খোদাই হয়ে থাকবে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের বার্তা ও তাৎপর্য বাংলাদেশসহ বিশ্বকে ছুঁয়ে যাক চিরকাল।

লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×