ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১

সংস্কারের সুফল পেতে করণীয়

ইফতেখার নাজিম

প্রকাশিত: ২১:০৯, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

সংস্কারের সুফল পেতে করণীয়

সংস্কারের সুফল পেতে করণীয়

বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহে সময়ে সময়ে নানা শব্দ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের আবেগ জড়িত। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে মুক্তি, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে স্বনির্ভর, এক এগারোতে পরিবর্তন, শেখ হাসিনার শাসনকালে ডিজিটাল ও স্মার্ট, বর্তমান সময়ে সংস্কার শব্দটি বেশ জনপ্রিয়। শোষিত, নিষ্পেষিত বাঙালি মুক্তির প্রত্যাশায় সময়ের ¯্রােতে এসব শব্দ অনুপ্রাণিত হয়েছে ও হচ্ছে।

তবে, ভাগ্যপীড়িত বাঙালির মুক্তি কখনো স্থায়িত্ব পায়নি। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ধারাবাহিকতায় সমাজ রাষ্ট্র বাস্তবতায় প্রতিবারই ভিন্নমাত্রার শব্দ জাতিকে জাগ্রত করেছে। তবে, নানা গোষ্ঠী স্বার্থের দ্বন্দ্বে কোনো শব্দই আক্ষরিক অর্থে জাতির মুক্তির পথ প্রসারিত করেনি। বরং আশার প্রদীপ নিভে যাওয়ায় বারবার জাতি প্রতারিত হয়েছে শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা। তাই, সিঁদুরে মেঘ দেখলে বাঙালি শঙ্কিত হয়, আবার একটু আশার প্রদীপে উন্মাদ হয়ে ওঠে। 
বাস্তবতার নিরিখে বর্তমানে জাতীয় জীবনে সংস্কার বেশ আলোচিত শব্দ। আগামী প্রজন্মের জন্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও উন্নত সমৃদ্ধ জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র সমাজকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়টি সংস্কার প্রক্রিয়ায় বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিস্থাপকতা সুসংহত করতে এবং এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ রূপান্তরমূলক যাত্রা শুরু করেছে, সেটি বোঝা যাচ্ছে।

এই সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গির লক্ষ্য হলো শাসনকে উন্নত করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করা এবং আর্থ-সামাজিক-পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, সব অন্তর্ভুক্তি ও স্থায়িত্বের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। তবে, রাষ্ট্র সমাজ বাস্তবতায় জন্মচেতনা, দর্শন, ইতিহাস নিয়ে যেখানে জাতীয় ঐকমত্য অনুপস্থিত, শ্রেণি স্বার্থদ্বন্দ্বে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সক্রিয়, সেখানে প্রকৃত সংস্কার কতটা আলোর মুখ দেখবে, সেটি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। 
এই প্রশ্ন কেন ঘুরপাক খাচ্ছে কিংবা আশার প্রদীপ বারবার কেন নিভে যায়, সেটির অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজতে হলে আমাদের জাতীয় চরিত্র বুঝতে হবে। বাঙালির চরিত্র মূল্যায়নের জন্য ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর স্যার জন শোর’র ১৭৮৪ সালের প্রতিবেদনটি প্রণিধানযোগ্য। বাঙালির চরিত্র উন্মোচন করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, বাঙালিরা ভীরু ও দাসসুলভ। তবে অধস্তনের প্রতি আবার ব্যাপক চোটপাট নেয়। ব্যক্তি হিসেবে মানসম্মানবোধ কম।

জাতি হিসেবে তাদের মধ্যে জনকল্যাণমূলক মনোভাব একেবারে নেই। যেখানে মিথ্যা কথা বললে কিছু সুবিধা হতে পারে, সেখানে অনর্গল মিথ্যা বলতে তাদের একটুও বাধে না। যেখানে শাস্তির ভয় নেই, সেখানে মনিবের কথাও শুনতে গড়িমসি করে। বাঙালি মনে করে, চালাকি ও কূটকৌশল জ্ঞানের পরিচায়ক। বাঙালিদের মধ্যে সততা, সত্যবাদিতা ও বিশ^স্ততার বড়ই অভাব। স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিথ্যা বলা একটা স্বাভাবিক বিষয়। সাধারণ কাজেও লোক ঠকানো, ফাঁকি দেওয়া, ধোঁকা দেওয়া, চুরি করা একটা সাধারণ বিষয়।

জীবনের সর্বক্ষেত্রে চলছে প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, ফাঁকিবাজি। অন্যের ক্ষতি করার প্রবৃত্তি বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এরা গালাগাল করে মনের ঝাল মেটায়। আইন প্রয়োগ করেও বাঙালির চরিত্রগত দুর্নীতি নির্মূল করা দুরূহ। নীতিহীন স্বার্থপরতার সমাজে ছড়িয়ে আছে ঘৃণা, বিবাদ, নিন্দাবাদ, মামলাবাজি। বাঙালিরা কপট, অকৃতজ্ঞ ও মিথ্যাবাদী। সাধারণ মানুষ অসহায় ও নির্বিকার। 
এমন চরিত্র উপস্থিতিতে স্বাধীনতার পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে স্বাধীন রাষ্ট্রটি বৈষম্য ও শোষণহীন সমাজ নির্মাণে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, দেশের অর্থবহ পরিবর্তন প্রত্যাশিত থাকলেও চিরাচরিত চরিত্রের কারণে পরিবর্তন ও সংস্কার স্থায়িত্ব পায়নি। রাষ্ট্র ভেঙে নতুন রাষ্ট্র হলো, সরকার এসেছে, সরকার পরিবর্তন হয়েছে, সমাজ বিকশিত হয়েছে, অর্থনীতির অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু বাঙালির যে সুবিধাবাদী চরিত্র, সেটিতে পরিবর্তন আসেনি। মাঝে মাঝে আইন কঠোর হয়েছে।

কিন্তু সেই আইন প্রয়োগে যাদের কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল, তাদের আন্তরিকতার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। প্রয়োগের দুর্বলতায় সেটি স্থায়িত্ব পায়নি। বরং রূপ পরিবর্তন করে সুবিধাবাদী বাঙালি যখন যেমন তেমন রূপ ধারণ করেছে। এরা কখনো চেতনায়, কখনো স্বনির্ভরতায়, কখনো পরিবর্তনে, কখনো সংস্কারের পক্ষে জয়গান গেয়েছে। এই জয়গানে সমষ্টির স্বার্থ কখনো জড়িত ছিল না। সব সময় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ তাড়িত ছিল। আমাদের সর্বক্ষেত্রে অর্থবহ সংস্কার আনতে হলে অবশ্যই এই সুবিধাবাদী চরিত্র দমনে মনোযোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। 
সুবিধাবাদী চরিত্রের বহুমাত্রিকতা যে দলীয় আদর্শ বা সরকার প্রধানের আনুগত্যে পরিচালিত হয়, সেটি নয়। বিশেষ করে পেশাজীবীদের চরিত্র। ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, শিক্ষক, আমলাতন্ত্র, পুলিশ প্রশাসন, সর্বোপরি প্রজাতন্ত্রের সব শ্রেণির কর্মচারীদের ক্ষণে ক্ষণে চারিত্রিক রূপ পরিবর্তনÑ সেটিই সংস্কারের পথে বড় অন্তরায়। এরা দল বা আদর্শকে ভালোবেসে সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয় না, অবস্থান নেয় বাতাসের গতি দেখে শুধু পদায়ন, পদোন্নতি, অবৈধ সুবিধা গ্রহণের মানসিক তাড়নায়।

বিগত ১৬ বছর ধরে যারা বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার চেতনায় উন্মাদ হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি অনিয়ম করেছে, কিংবা তার পূর্ববর্তী সরকারের আনুগত্যে একই কাজ করেছিল, তারা এখন সংস্কারের জয়বন্দনা করছে। এই মানসিক দুর্নীতি মূলত অন্যান্য দুর্নীতিকে সমাজ রাষ্ট্রের পরতে পরতে জেঁকে বসতে সহায়তা করেছে। এই দুর্নীতি সংস্কারের পথে অন্যতম বাধা ও চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ব্যাপক দুর্নীতিবিরোধী কৌশল বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জবাবদিহি বৃদ্ধি করা। ডিজিটাল গভর্নেন্স টুল প্রবর্তন এই কৌশলে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। 
বাংলাদেশের সুশাসনের পথে অন্যতম অন্তরায় জবাবদিহির অভাব। এই সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে মোটাদাগে যে সকল উপকরণকে দায়ী করা যেতে পারে, তার মধ্যে সুষ্ঠু জনমত প্রয়োগে নির্বাচন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি অন্যতম। যেখানে কালো টাকার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সংসদ সদস্য থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থীকে নির্বাচনি তরী পার হতে মনোনয়ন বাণিজ্য, প্রশাসন ম্যানেজ, ভোট কেনার মতো অসৎ উপায়গুলো অবলম্বন ও মোকাবিলা করতে হয়। যে কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণ নির্বাচনকে অর্থলগ্নি হিসেবে দেখেন।

এই অর্থলগ্নি শুধু প্রশাসন ম্যানেজ ও ভোট কেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তারা আধিপত্য বিস্তার বজায় রাখতে পেশিশক্তির ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘বড় ভাই’ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এই বড় ভাইকে কেন্দ্র করে কিশোরগ্যাং থেকে চাঁদাবাজ, দখলবাজ, টেন্ডারবাজ, ভূমিদস্যু, সিন্ডিকেশন, মাদককারবারি ও লুটেরা শ্রেণির বিস্তার ঘটে। যার প্রত্যক্ষ পরোক্ষ প্রভাব গিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। নানা কারণে ভেঙে পড়ে আইনের শাসন। তাই, সংস্কারের পথে এগোতে হলে স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কর্মকা- থেকে সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়ন কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা অপরিহার্য।
কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুশাসনের পথে আরেকটি অন্তরায়। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে এক ধরনের সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। যার ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে অধীনস্ত বিভাগ ও অধিদপ্তরে। সরকারি টেন্ডার, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলিÑ সবই এই সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ফলে, উন্নয়ন পরিক্রমা স্থায়ী হয় না, উন্নয়ন পরিকল্পনায় একই কাজ বারবার চলে আসে। কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের এই দুর্বৃত্তায়নের লাগাম টেনে ধরতে হলে অবশ্যই স্থানীয় শাসনব্যবস্থা উন্নয়নে মনোযোগ বাড়াতে হবে।

প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণে সংস্কার অনুসরণ করে জনগণের কাছাকাছি সেবা নিয়ে যেতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব ও সম্পদ হস্তান্তর বাড়ানোর পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে স্বাধীন কমিশন গঠন প্রয়োজন। যেটি পরিষেবা সরবরাহ উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে পারে। 
নানা কারণে দেশের উচ্চ আদালত থেকে নি¤œ আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ^াসে ফাটল ধরেছে। বিচারালয়ের প্রতি নির্বাহী বিভাগের ন্যক্কারজনক হস্তক্ষেপ ও দলীয় বিবেচনায় অদক্ষ বিচারপতি নিয়োগ এর জন্য দায়ী। সংস্কার প্রক্রিয়ায় বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা ও কার্যকারিতা উন্নত করার প্রচেষ্টা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে মামলা জট হ্রাস, বিচারিক জবাবদিহি বৃদ্ধি ও সকল নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও তাদের ভেতর দেশপ্রেম, মানবিক দর্শন গভীর করা ছাড়া কার্যত কোনো সংস্কার কাজে আসবে না।

তাই, মানবপুঁজির গুরুত্ব অনুধাবন করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সংস্কারে সরকারকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নের জন্য বৈশি^ক চাহিদা অনুযায়ী কারিকুলাম আধুনিকায়ন, মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণে দৃষ্টিপাত দিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবায় মানসম্পন্ন চিকিৎসা পরিষেবাগুলোর অ্যাক্সেস সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্য অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। 
দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের বিকল্প নেই। নানা কারণে বিগত দিনে সরকারের পরিচ্ছন্ন সহযোগিতায় দুষ্টচক্র আর্থিক খাতের ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছে। পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিংখাত ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছে। স্থিতিশীল আর্থিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণে এ খাতে সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নিয়ন্ত্রক তদারকি বাড়ানো, ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা উন্নত করা ও সংশ্লিষ্ট খাতে দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। 
অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। যে কারণে সামান্য বৃষ্টিপাতে বন্যা, খরা জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আগামী দিনে উন্নয়নের সময় পরিকল্পনায় প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বারোপ করে এ খাতে সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের নামে স্থানীয় সরকার বিভাগ যে ধরনের আত্মঘাতী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, সেটি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। প্রাকৃতিক জলাধার, খাল-বিল, নদ-নদী রক্ষায় স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে মনোযোগ বাড়াতে হবে। 
পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী শাসন ও ভূমি উদ্ধারের যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, সেখানে বরাদ্দকৃত অর্থ বেশিরভাগ লুটপাট হয়ে যায়। ফলে, জাতীয়ভাবে নদী শাসন ও ভূমি উদ্ধারে যে অর্থ বরাদ্দ হয়, সেটির সুফল জাতি পায় না। সামগ্রিক সংস্কার পরিকল্পনায় এটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নে দলীয় ঠিকাদারদের কাজ দিয়ে যেভাবে কাজের মান উপেক্ষা করা হয়, সেটির লাগাম টেনে ধরতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য লিজভিত্তিক বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

এ ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হলে অবকাঠামো উন্নয়নকে কেন্দ্র করে দলীয় পরিচয়ে যে ধরনের টাউট-বাটপারের আধিপত্য বিস্তার ঘটে, তা কমে আসবে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য ফেডারেল শাসনব্যবস্থার কথা শোনা যাচ্ছে। ছোট্ট আয়তনের বৈষম্যযুক্ত সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের উদ্যোগ জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। তাই, আবেগবশে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গভীরভাবে ভাবতে হবে। বরং সচিবালয় বিকেন্দ্রীকরণ ও বিভাগভিত্তিক হাইকোর্ট বিভাগের শাখা নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। 
পরিশেষে বলা যায়, অরাজনৈতিক সরকারের সময়ে জনপ্রত্যাশার আলোকে সংস্কারের গুরুত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ। কিন্তু দিন শেষে সেই সংস্কার আলোর মুখ দেখে না, বরং মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি উচ্চাভিলাষী এবং ব্যাপক হলেও বলা যায় সংস্কার প্রক্রিয়ায় বেশ  চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সংস্কারের কার্যকর বাস্তবায়ন এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর করা অন্যতম। উপরন্তু, পরিবেশগত স্থায়িত্বের সঙ্গে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংস্কার দৃষ্টিভঙ্গি দেশের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি সাহসী ও বহুমুখী পদ্ধতির প্রতিনিধিত্ব করে।

অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ, শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ এবং সামাজিক ও পরিবেশগত টেকসই করার ওপর নির্ভর করছে ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিস্থাপকতা। সরকারের ক্রমাগত প্রতিশ্রুতি, নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহায়তা, সর্বোপরি রাজনৈতিক দলগুলোর গুণগত সংস্কার ছাড়া একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব নয়। সেদিকে নজর দিয়ে সকল ক্ষেত্রে সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। অন্যথায়, বাঙালির জাতীয় চরিত্রের যে প্রথাগত দিকদর্শন বিদ্যমান, সেখানে সংস্কার প্রত্যাশার আলোকে কতটা কার্যকর হবেÑ সেই শঙ্কা থেকেই যায়। 
লেখক : গবেষক

×