ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১

মরুর বুকে চোখ ধাঁধানো দুবাই

ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ২০:২৫, ২৫ অক্টোবর ২০২৪

মরুর বুকে চোখ ধাঁধানো দুবাই

.

এমন বহু মানুষ আছে যাদের ধারণা দুবাই একটি দেশ। আসলে দুবাই কোনো দেশ নয়। পক্ষান্তরে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) একটি দেশ, দুবাই হলো তার অংশবিশেষ। এই সংযুক্ত আরব আমিরাত মোট ৭টি প্রদেশ বা আমিরাত নিয়ে গঠিত। আবার এই ৭টি প্রদেশ বা আমিরাতের অন্যতম একটি আমিরাত বা প্রদেশ হলো দুবাই। মূলত এটি একটি বৈশ্বিক শহর। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ব্যবসায়িক কেন্দ্র। দুবাইকে আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক রাজধানীও বলা হয়। আবার প্রতিটি প্রদেশ বা আমিরাতের শাসনকর্তার পদবি হলো আমির। দুবাইয়ের আমির হলেন দুবাইয়ের শাসনকর্তা। অন্যদিকে আবুধাবির আমির হলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রপ্রধান।

দুবাই মূলত দুটি অংশে বিভক্ত। বার দুবাই এবং দেয়ারা দুবাই। বার দুবাই হলো পুরনো শহর আর দেয়ারা দুবাই হলো আধুনিক শহর, যেখানে বিশাল এলাকাজুড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো আকাশচুম্বী অট্টালিকার সমারোহ। এসব সারি সারি উঁচু ভবনগুলো অত্যাধুনিক সুবিধাসহ পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে। অপরদিকে পুরনো শহর বার দুবাইয়ে রয়েছে ষাট দশকের সব ঐতিহ্যবাহী চালচিত্র। তারা কখনো ভুলে যায়নি তাদের পুরনো ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে। তাইতো বার দুবাইকে তারা সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে পুরনো ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে।

আবার অনেকেই মনে করেন, দুবাইয়ের অর্থনীতি তেলনির্ভর। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে দুবাইয়ের এই ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক সাফল্যের পেছনে কি রয়েছে? মূলত দুটি জিনিস রয়েছে। এক হলো- সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অনুযায়ী  টুরিজম বিজনেস। দুই- বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতি। দুটোতেই তারা অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শপিং মল- দ্য দুবাই মল, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন- দ্য বুর্জ আল খলিফা (১৬৩ তলা), পৃথিবীর একমাত্র সেভেন স্টার হোটেল- দ্য বুর্জ আল আরব যা জুমেরা বিচ থেকে সমুদ্রের ভিতরে কৃত্তিম দ্বীপের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন এক পালতোলা জাহাজ, মরুর বুকে মিরাকল গার্ডেন, বিশাল কৃত্তিম ওয়াটার ডান্স, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বর্ণের মার্কেটঞযব এড়ষফ ঝড়ঁশএসবই দুবাই অর্থনীতির সাফল্যের স্বীকৃতি। তাই তো সবটিতেই তারা বিশ্বসেরা হতে চায়, চায় সবটিকে ছাড়িয়ে যেতে। পারলে গোটা দুনিয়াটাকে নিজের করে নেয়।

মরুভূমির দেশটি এখন স্বপ্নের দেশ। ভিসা পাওয়াটা অত সহজ নয়। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের লোকদের। ধনী দেশগুলোকেই তারা বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। মরু দেশটিতে রয়েছে পর্যাপ্ত হোটেল কিন্তু তা সত্ত্বেও অ্যাডভান্স বুকিং না দিলে রুম পাওয়াটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে যায়।  দেশটির মোট জনসংখ্যা ৩৫ লাখ। তন্মধ্যে বেশিরভাগই বহিরাগত এবং ফরেন ওয়ার্কার।

ষাটের দশকে যে দেশটি ছিল ধু ধু মরুভূমি, সেই মরুভূমির বুকে মাত্র কয়েক দশকে গড়ে উঠেছে চোখ ধাঁধানো স্বপ্নের রাজ্য। তেল পাওয়ার আগে তারা ছিলেন মূলত জেলে সম্প্রদায়। আরব সাগর পারস্য উপসাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দুবাই জাদুঘরে তাদের পূর্ব পুরুষদের ছবিগুলো এখনো ফ্রেমে বন্দি রয়েছে। ওই সময়ে লুঙ্গি পরে মাছ শিকার করত। আর এখন ঘরেও লুঙ্গি পরে না, ট্রাউজার বা জিন্সের প্যান্ট পরে। তেলের পয়সায় হাজার হাজার বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন। এখন স্যার সম্বোধন শুনতেই বেশি অভ্যস্ত। গাড়ি বাড়ি, দামি গহনা এবং নানা শখ আহ্লাদের জীবনযাপনকে যদি বিলাসী জীবন বলা হয়, তাহলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখরা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। তেল সম্পদের অঢেল অর্থ তাদের ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। তাই তো শ্রমিকদের তারা মানুষ বলে গণ্য করে না, তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞার চোখে দেখে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার এবং ওমানে প্রচুর বাংলাদেশী শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের সেই স্বর্ণালি দিন এখন আর নেই। চাকরির সুযোগ-সুবিধা বেতন ভাতা অনেকটাই কমে গেছে। তারপরও শ্রমবাজার হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের জুড়ি নেই। মোট রেমিটেন্সের প্রায় অর্ধেকই আসে সৌদি আরব থেকে। এরপরই রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএই। শ্রমবাজারটি দিন দিন সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে। যতই দিন যাচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন নতুন রস্তাঘাট, দালান-কোঠা তৈরি হচ্ছে। যেন উন্নয়নের জোয়ার বইতে শুরু করেছে। পাশাপাশি বিদেশী শ্রমিকের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চাকরি করার সুবাদে অনেক সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার সুযোগ হয় আমার। আর তখনই দেশটির অর্থনীতিকে খুব কাছে থেকে দেখি। তবে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বেশিরভাগ বাংলাদেশী শ্রমিক অদক্ষ/ আধা দক্ষ বলে প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে তেমন একটা সুবিধা করতে পারছে না। ইন্ডিয়া, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া এমন কি নেপালের থেকেও পিছিয়ে রয়েছে। ফলে, কনস্ট্রাকশনের কাজেই তারা বেশি নিয়োজিত। এতে যেমন রয়েছে হাড়ভাঙা খাটুনি, তেমনি বেতন-ভাতাও তুলনামূলকভাবে কম। দেশের আকাশছোঁয়া নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে ব্যস্ত হলুদ বর্ণের পোশাক পরা পরিশ্রমী মুখগুলো দেখলেই বুঝা যায় এরা বাংলাদেশী শ্রমিক। বহু শ্রমিক রয়েছে, যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। আবার এমন বহু বিদেশী কর্মী রয়েছে, যারা আকর্ষণীয় বেতন ভাতায় কাজ করছে। অর্থাৎ জীবনযাত্রার মানে রয়েছে এক বিশাল তারতম্য। 

পর্যটনের শহর দুবাই। প্রায় সময়ই কোনো না কোনো ফেস্টিভ্যাল লেগেই থাকে। এজন্য দুবাইকে ফেস্টিভ্যাল সিটিও বলা হয়। বিনোদনের কোনো অভাব নেই। নাইট ক্লাব, ড্যান্স ক্লাব, বার সবই রয়েছে। সবই চলছে ওয়েস্টার্ন স্টাইলে। ইসলাম ধর্মালম্বীরা স্বভাবতই রক্ষণশীল। আর মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চল হচ্ছে রক্ষণশীলতার দুর্গ- এমন একটা ধারণা নিয়ে যারা শহরটিতে যাবেন, তারা নিশ্চিতভাবে এগুলো দেখে বিস্মিত হবেন। কিন্তু রক্ষণশীলতার সঙ্গে পর্যটকদের সমীকরণটা ভিন্ন। তাই তো বাংলাদেশ প্রতিপদে পদে এর মূল্য দিচ্ছে। অথচ রক্ষণশীলতাকে পাস কাটিয়ে উপসাগরীয় এলাকা এখন পর্যটকদের জনপ্রিয় ভ্রমণ কেন্দ্র হয় উঠেছে। এসব নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

দুবাইয়ের অর্থনীতির গতিকে সঞ্চারিত করার পেছনে যে জিনিসগুলো কাজ করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো তাদের বিমান সংস্থা এমিরেটস এয়ারলাইন্স, শপিং মল হোটেল ব্যবস্থাপনা। এই ৩টির প্রতিটির সঙ্গে অন্যটির রয়েছে নিবিড় ব্যবসায়িক যোগাযোগ। প্রতিবছর শপিং ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে ভ্রমণকারীদের সুবিধার্থে এমিরেটস এয়ারলাইন্স আকর্ষণীয় প্যাকেজ ঘোষণা করে থাকে। দুবাই পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণ সংবর্ধনা, বিমানবন্দর সহায়তা এবং হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে স্ট্যান্ডবাই গাড়ির ব্যবস্থা রাখা হয়। ভ্রমণকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বিষয়টি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয়। থেকেই বুঝা যায়, তারা তাদের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কতই না বিচক্ষণ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। 

পর্যটন এমন একটা শিল্প যা নানা দিক দিয়ে আয় সৃষ্টি করে এবং দিন শেষে জাতীয় অর্থনীতিতে সংযোজন ঘটায়। আমরা যদি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডের দিকে তাকাই, তাহলে দেখি তাদের অর্থনীতির ভিত মজবুত হওয়ার পেছনে রয়েছে পর্যটন শিল্পের প্রসার। বাংলাদেশেও পর্যটন শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যটন শিল্পের যথাযথ বিকাশ ঘটলে শুধু খাত থেকেই বাংলাদেশ হাজার কোটি টাকা আয় করতে সক্ষম হবে। সুতরাং পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে বেকারদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে এটি এক বিরাট সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

দুবাই শহরটি যেন চিরযৌবনা, আলোকোজ্জ্বল। যতই দেখা যায় ততই চমক সৃষ্টি হয়। ফ্রি ট্রেড জোন বিধায় সবই উন্মুক্ত। কোনো হোটেল বা মার্কেটের প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টরের দরকার হয় না। পুরো দেশটাকেই এরা নিরাপদ করে গড়ে তুলেছে। পান থেকে চুন খসলেই জেল-জরিমানা। তাই অপরাধের হার শূন্য।

ফ্রি ট্রেড জোন হওয়াতে সারা পৃথিবীর বনেদি ধনীরা আকাশছোঁয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। কোটি কোটি টাকা দামের ফ্ল্যাটের নামে কিনছে স্বর্গের প্রাসাদ। আবার অনেকে জুমেরা বিচের পাশে অভিজাত এলাকায় দামি প্রাসাদ সমতুল্য ভিলা কিনছেন। সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি এসব দামি দামি বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি ঘর দেখলে মন-চোখ দুটোই  জুড়িয়ে যায়। শোনা যায় কানাডায় বেগমপাড়ার পর দুবাইয়েও এসব ভিলাতে বাংলাদেশী প্রতিপত্তিশীলদের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে।

এখানে   কণঈ (Knwo your customer) নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। টাকাটা কোথা থেকে কিভাবে এলো, বৈধ না অবৈধ তা দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। দুবাই শহর হলো বিশ্বের অন্যতম আন্তর্জাতিক ব্যবসা কেন্দ্র। তাই তো সব বড় মাফিয়া চক্র আর হুন্ডি ব্যবসায়ী রাঘববোয়ালরা জাল বিস্তার করে বসে আছে।

মধ্যপ্রাচ্য বলতেই  চোখের সামনে ভেসে ওঠে তেল সম্পদে গড়ে ওঠা সারি সারি আকাশচুম্বী দালান-কোঠা আর অট্টালিকা। কিন্তু বদলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বাড়লেই তাদের অর্থনীতি চাঙা হয়। আর কমতে শুরু করলেই অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে আসে। এই উপলব্ধিকে সামনে রেখে তারা তেলনির্ভরতা থেকে  বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যে সৌদি যুবরাজ তাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি পর্যটনকে ঢেলে সাজাতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। বাকিরাও একই পথে হাঁটছেন।

তেল সম্পদ ব্যবহার করে তারা যেমন সম্পদের বিস্তার ঘটিয়েছেন, তেমনি জীবনযাত্রাকেও নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। তেল সম্পদের কারণে আরবরা যে মানের জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, তা থেকে বেরিয়ে আসা কী সম্ভব? দুনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের বিকল্প তৈরি হচ্ছে। ওদিকে ধীরে ধীরে তাদের তেল সম্পদও ফুরিয়ে আসছে। তাই তো আইএমএফ বলেছে, তারা যদি তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে না পারে কিংবা বিকল্প অর্থনীতির পথ খুঁজে বের করতে না পারে তাহলে সামনের দিনগুলোতে যে বিপর্যয় নেমে আসবে তা ঠেকানো কষ্টকর হবে।

লেখক : চেয়ারপার্সন, ব্যুরো বাংলাদেশ

×