ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

বহুরূপী: বহু গুণীর সমাবেশে উপভোগ্য এক সিনেমা

মারুফ রায়হান

প্রকাশিত: ১৮:৫২, ২৪ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ১৮:৫৩, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

বহুরূপী: বহু গুণীর সমাবেশে উপভোগ্য এক সিনেমা

কলকাতার সিনেমা হলে ঢোকার আগে লেখকের সঙ্গে জীবাংলার সারেগামাখ্যাত শিল্পী সম্পা বিশ্বাস 

কলকাতায় বেড়াতে গেলে আমার অন্তত একখানা থিয়েটার আর একটা সিনেমা (বাংলা নয়) দেখা চাই-ই চাই। আমাদের বন্ধু, জীবাংলার সারেগামাখ্যাত শিল্পী সম্পা বিশ্বাস জানেন সেটা। তিনি বললেন, দাদা তোমাকে সাউথ সিটিতে ‘বহুরূপী দেখাব। বেহালা থেকে সাউথ সিটি, অটো ও মেট্রোতে সহজেই যাওয়া যায়। অটো মানে অটোরিক্সায় চারজন বসেন, তাই দিব্যি আমার পাশে কোনো অপরিচিতা বসে পড়তেই পারেন। ঢাকার মানুষের আড়ষ্টতা ও সংকোচ হয় তাতে। সে যাক, রাস্তার দু ধারের মানুষজন দেখতে দেখতে ভ্রমণ করা যায়। আর মেট্রোতে ভিড় থাকলে সেখানেও বহুরূপী মানুষ এবং কর্মচাঞ্চল্য দেখা যেতেই পারে। সিনেমা বহুরূপী দেখবার আগে এইসব দর্শন ভালোই লাগে। সাউথ সিটি শপিং সেন্টারে গেলে বরাবরই স্ফূর্তির পাশাপাশি কিছুটা বিরক্তিও আসে যদি সেখানে সিনেমা দেখতে যাই। কীরকম? মলে ঢোকার আগে ব্যাগ স্ক্যান চেক, বডি চেক এসব তো স্বাভাবিক। ওপরে সিনেমা হল প্রাঙ্গণে প্রবেশের আগেও আরেক দফা কড়াকড়ি চেক হয়। ডবল চেকের মানে কি? এরা তাহলে নিচের নিরাপত্তা তল্লাশিকে ভরসা করে না? অনলাইনে টিকেট কেটে রেখেছিল সম্পার কন্যা গ্রাফিক ডিজাইনার মিষ্টি। মোবাইল ফোনে সেটি দেখিয়ে প্রবেশ করা। ঢাকার সিনে কমপ্লেক্সের মতোই এই হল, আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। তবে খাবারের অর্ডার দিলে আপনার সিটেই খাবার চলে আসবে। মন্দ নয়। আরেক দফা বিরক্তি এলো একগাদা বিজ্ঞাপন দেখানোয়। আরে বাবা গাঁটের পয়সা খরচ করে সিনেমা দেখতে এসেছি, তোমাদের বিজ্ঞাপন দেখতে আমাদের বাধ্য করছ কেন? এতে সময়ও তো নষ্ট করছ আমাদের! অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন দেখিয়ে অর্থোপার্জন করলে টিকেটের দামটাও তো কমিয়ে রাখতে পারো বাপু।এবারের পুজোর ব্যবসাসফল ছবি বহুরূপী। কলকাতার মূলধারার, মানে বিনোদনধর্মী সিনেমা যে দারুণভাবে বদলে যাচ্ছে তার একটা উদাহরণ বলতে পারি এই বহুরূপীকে। সিনেমার স্ক্রিপ্ট বা থিম এককথায় আকর্ষণীয়। সেই চিরাচরিত চোরপুলিশ খেলা হলেও পরতে পরতে, মানে দৃশ্যে দৃশ্যে নতুনত্ব আছে, চোখ সরানো যায় না। সংক্ষেপে গল্পটা বলি: এক রিটায়ার্ড সৎ পুলিশ অফিসার নিজ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখেছেন, সেটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান। 

তিনি স্মৃতিচারণ করছেন, বলছেন পুরষ্কৃত অফিসার হওয়া স্বত্ত্বেও নিজের ব্যর্থতার গল্প। সেটি কি? মালিকপক্ষ শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতাকে খুন করে এক সৎ কর্মচারীকে ফাঁসিয়ে দেয়। আপনজনেরা মিথ্যে করে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য দিলে বিনা দোষে লোকটির জেল হয়ে যায়। তদন্তকারী ওই সৎ পুলিশ অফিসার লোকটির আন্তরিক সত্য ভাষ্যে বিশ্বাস করে না, বরং হাজতে নির্যাতন চালায়। জেলে গিয়ে লোকটি এক দাগী অপরাধীর স্নেহভাজন হয়ে ওঠে এবং তার কাছ থেকে ব্যাংক ডাকাতির কৌশল রপ্ত করে। ডাকাতির অপরাধ কিভাবে সংঘটিত হচ্ছে তা খতিয়ে পুলিশ মামলার ধারা ঠিক করে, বিচারক সেভাবেই সাজা দেন। তিনজনের দল নিয়ে ডাকাতি করলে সাজা পাঁচ বছর। মানুষের বাড়িতে ডাকাতি করলে এতে ব্যক্তির ক্ষতি হবে, কিন্তু ব্যাংক ডাকাতি করলে তাতে সরকারের ক্ষতি হবে। 

সরকার বিনা অপরাধীকে জেল দেয়, আরো নানা অন্যায্য কর্ম করে বা সিস্টেম করতে বাধ্য করে। তাই লোকটির দর্শন হলো মানুষকে ভালোবেসে সে ব্যাংক ডাকাতিই করবে। আর ডাকাতি করার সময় সেখানে উপস্থিত কারো সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করবে না। বুদ্ধিমান লোকটি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ওই ডাকাতি-প্রশিক্ষক গুরুর গ্রামে যায়, যার নাম ছ্যঁচড়াপুর। সে গ্রামের সবাই কোনো না কোনো অপরাধ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ওখান থেকে ডাকাতিকর্মের জন্য তিনজন (একটি মেয়েসহ) সহকারী বেছে নেয়। পুরোনো গুরুজনতুল্য দাড়িঅলা এক ব্যক্তিকেও দলে নেয়। তিনজনের ডাকাতি দলের সাজা একরকম, আর পাঁচজনের ভিন্ন রকম। বিচক্ষণ লোকটির পরিকল্পনা অনুযায়ি সে সহ তিনজন ব্যাংকে প্রবেশ করে ডাকাতিতে অংশ নেবে, বাইরে রাস্তায় চোরাই মোটর সাইকেলে থাকবে দুটি, একটিতে বসে অপেক্ষায় থাকবে চতুর্থজন; আর নারীটির ভূমিকা ভিন্ন, সে স্পটেই থাকবে না। 

সব বলে দিলে আর সিনেমার মজা থাকে না, তাই এখানেই থামছি। লোকটি ডাকাতি করার জন্য বেছে নেয় ওই পুলিশ অফিসারের থানা এলাকাই। একের পর এক ডাকাতি চলতে থাকে মাত্র চার মিনিটের বিচিত্র কৌশলী অপারেশনে। নাস্তানাবুদ খেতে থাকেন পুলিশ অফিসার। শেষমেশ ধরা পড়েন ডাকাত নেতা, জেলপূর্ব জীবনের সেই সৎ কর্মচারী। তার বাসায় নি¤œপদস্থ পুলিশদল অভিযান চালায়, টাকা ও সোনা জব্দ করে। সে সময় পুলিশ অফিসার মন্দিরে ব্যস্ত ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ (বাইপোলার) স্ত্রীর কারণে। আদালতে ডাকাতনেতা তার জবানবন্দিতে বলে, বিচারকের সামনে পুলিশ সোনা ও টাকার যে হিসাব দিয়েছে সেটি অনেক কম করে দেখিয়েছে। সে বিশদ প্রমাণ হাজির করে আদালতে তার অঢেল স্বর্ণসম্পদের। পুলিশ অফিসার বুঝতে পারেন অধীনস্ত পুলিশরা টাকা ও সোনা মেরে দিয়েছে। ফলে সব কজন পুলিশেরই জেল হয়ে যায়। ডাকাত-পুলিশের খেলায় কে জিতল তবে? ডাকাত নেতা পুলিশ অফিসারের উদ্দেশে বলে, বড় বাবু, আপনি সৎ আমি জানি। কিন্তু সততার তো একটা মূল্য দিতে হবে। অর্থাৎ সে মনে করিয়ে দিল হত্যা না করেও তাকে জেল খাটতে হযেছে। সততার মূল্য দিতে হয়েছে তাকে।

দেখলাম পুজোর বহু আগেই বহুরূপী সম্মন্ধে কলাকাতার কাগজ এই সময় লিখেছিল: 
টিজারে একদিকে যেমন বন্দুক হাতে সুপার-অ্যাকশন মুডে আবীর। তেমনই আবার শিবপ্রসাদের চোখ জানান দিচ্ছে পরতে পরতে রহস্য। পলাশ ফুলে নিজেকে রাঙিয়েছেন ঝিমলি চরিত্রে কৌশানি। আর সাবেকি রূপে ঋতাভরীর চেহারা পাক্কা গিন্নি। তবু রক্তবীজের পর বহুরূপী যে বড় চমক দেবে, একথা বলাই যায়।

পরিচালক নন্দিতা রায় তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেছেন, প্রি-প্রোডাকশন থেকে ৮৪টি স্থানে প্রায় ৩৪ দিনের শুটিং। এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে প্রত্যেকের সকলের আবেগ বলে বোঝানোর মতো নয়। আমাদের লক্ষ্য ছিল বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি হওয়া অ্যাকশন ড্রামার ঘরানাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে। এবং শেষ পর্যন্ত দর্শকদের সেই অনবদ্য মুহূর্ত উপভোগ করাতে পারব বলে আশা করছি। ছবির ফল নিয়ে ভীষণভাবে উত্তেজিত।

অন্যদিকে, পরিচালনার পাশাপাশি ভালো অভিনেতা হিসেবে বারবার দর্শকের মন কেড়ে নিয়েছেন ডাকাতের চরিত্রে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এই ছবির জন্য ওজন কমানো থেকে চেহারার পরিবর্তন, সবমিলিয়েই এক অন্য রূপ। শিবপ্রসাদ বলেন, বহুরূপী এমন একটি সিনেমা, যার জন্য আমি দীর্ঘদিন ধরেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি। 

বহুরূপীর জন্য পরিচালক নন্দিতা রায় যদি বড় পুরস্কার পান, অবাক হবো না। তথাকথিত উত্তেজক নাচ-গান না দেখিয়েও যে বিপুল দর্শক হলে টানা যায় তার দৃষ্টান্ত বহুরূপী। একটিও অযৌক্তিক দৃশ্য দেখলাম না, সংলাপ শুনলাম না। ডাকাত দলের বহুরূপী সাজে এলাকাবাসীদের মনোরঞ্জনের প্রয়াসও প্রশংসা করার মতো। সিনেমার শুরতেই ছিল টানটান উৎকণ্ঠা। দর্শক নড়েচড়ে বসবেন। বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ, হাস্যরস, রঙ্গরস, উৎকণ্ঠা, প্রেমের আবেগ, দাম্পত্য মায়া ও নৈতিকতা, বাস্তবোচিত দৃশ্য, ক্রাইম একশন, মন্দির ও পুজো, পশ্চিমবঙ্গের দর্শকেরা বড় পর্দায় যা যা উপভোগ করতে চান, তার সবই আঁজলায় মেপে পরিবেশন করা হয়েছে। প্রধান দুই নারী ও দুই পুরুষ চরিত্রে অভিনয়কারী দুর্দান্ত, স্বল্প সময়ের চরিত্র রূপদানকারীরাও দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। তারাই চলচ্চিত্রে প্রাণ সঞ্চারকারী। লোকেশন গল্প-উপযোগী ও নজরকাড়া। একবাক্যে বলব, বহুরূপী দেখলে পয়সা উশুল। কলকাতার বাংলা ছবি এভাবেই এগিয় যাক। বহুরূপীর সকল শিল্পী ও কলাকুশলীকে জানাচ্ছি আমার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। 

কলকাতা থেকে ফিরে
২৪ অক্টোবর ২০২৪
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]
 

শহিদ

×