ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্য বৈশ্বিক শান্তির অন্তরায়

মেজর নাফিস আনোয়ার মো. মঈনুদ্দীন

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্য বৈশ্বিক শান্তির অন্তরায়

অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্য

গত বছরের ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাস ইসরাইল ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালানোর পর ইসরাইল কর্তৃক নজিরবিহীনভাবে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা চালানোর ১ বছর হয়ে গেছে। কিন্ত জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যেমন বলেছেন, হামলাটি কোনো অকারণ ঘটনা নয়। সেভাবে দেখলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যুগ যুগ ধরে ইসরাইল কর্তৃক অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া দখলদারিত্বমূলক আচরণ এবং প্রচ- নিপীড়নের এক কড়া জবাব এই হামলা।

ভূরাজনৈতিকভাবে ইসরাইল পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক ফিলিস্তিনের ওপর বল প্রয়োগের মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া একটি দেশ, যা গত শতকের শুরুর দশকগুলোতেও পৃথক অস্তিত্ব পায়নি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে ফিলিস্তিনের জনগণকে তাদের পূর্বপুরুষদের মাতৃভূমি হতে জাতিগতভাবে নির্মূল করা হচ্ছে এবং সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

১৯৪৮ সালের জাতিগত নির্মূলের দ্বারা বিতাড়িত (যা ‘নাকবা-১৯৪৮’ নামে পরিচিত) সেই শরণার্থীদের পরবর্তী প্রজন্ম এবং ক্রমান্বয়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অদ্যাবধি একটি নৃশংস এবং গণহত্যামূলক অভিযানের শিকার হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের কিছু সংখ্যক পক্ষপাতদুষ্ট রাষ্ট্রের সমর্থনের কারণে বিগত ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে ইসরাইল যে দায়মুক্তির সংস্কৃতি উপভোগ করে আসছে, তা আজকের এই গণহত্যার অন্যতম কারণ।

এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত প্রায় আনুমানিক ৪২,০০০-এরও বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। যদিও ইসরাইলের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান বেনজামিন নেতানিয়াহু বারবার বলেছেন, বর্তমান এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা। তথাপি এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ফিলিস্তিনের নিরপরাধ বেসামরিক ব্যক্তিদের জীবন এবং সম্পদের ওপর এই অবারিত ধ্বংসযজ্ঞ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও দুর্লভ। চলমান এই যুদ্ধ আধুনিক যুগের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক বিপর্যয় সমূহের মধ্যে একটি।

হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক নাগরিক হত্যা বিশেষত শিশু হত্যা, তাদের বাড়িঘর ধ্বংস, তাদের পৈতৃক জমি দখল করা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের প্রবেশাধিকারে বাধা প্রদান, খাদ্য ও পানিসহ অন্য মৌলিক মানবিক চাহিদাসমূহের পথে বিঘœ সৃষ্টি, এ সবই আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং জাতিগত নির্মূলের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে প্রতীয়মান। দুর্ভাগ্যবশত অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য খুব সামান্যই প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে ইসরাইলের সাম্প্রতিক আক্রমণ শুরুর পর থেকে, গাজার সমস্ত ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের বাড়িঘর থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, অনেকে এমনকি একাধিকবার। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজার আনুমানিক ২.১ মিলিয়ন মানুষ এই অভিযানের দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্যাতিত, যার মধ্যে সম্ভাব্য ৯০ শতাংশ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালীন ইসরাইলি সামরিক বাহিনী গাজার স্কুল, হাসপাতাল এবং শরণার্থী শিবিরগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। গাজা উপত্যকার ৮৩ শতাংশ এলাকা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের জন্য অনিরাপদ বলে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীরা নিজেরাই চিহ্নিত করেছে।

এমনকি বর্তমান সংঘাতের আগেই গাজা উপত্যকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ জনগণের জন্য মানবিক সহায়তার প্রয়োজন ছিল। ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ এবং এর তীব্রতার সঙ্গে এই উপত্যকার মানবিক পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। গাজা সংকট বেড়ে যাওয়ার পর থেকে এক অভূতপূর্ব মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে নিয়মিত এক সংঘাতময় জীবনযাপন করছে, যেখানে অনাহার তাদের নিত্যসঙ্গী। চলমান সহিংসতা এবং সীমান্ত এলাকা বন্ধ থাকার কারণে মানবিক সহায়তা বিতরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধের বছর পূর্তির সঙ্গে সঙ্গে ইসরাইল সামরিক বাহিনী কর্তৃক গাজায় বিশাল সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে, যা এই উপত্যকার বিপর্যস্ত মানবিক পরিস্থিতিকে আরও বীভৎস করে তুলেছে। জাতিসংঘ হতে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, শুধু গাজা শহর এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকা যেখানে ৩,০০,০০০ হতে ৩,৫০,০০০ মানুষের বসবাস, সেই এলাকায় ইসরাইল সামরিক অভিযান জোরদার করেছে এবং একাধিকবার ফিলিস্তিনি জনগণকে অনতিবিলম্বে এলাকা ত্যাগ করার জন্য হুঁশিয়ারি আদেশ জারি করেছে।
বর্তমানে যে কয়েকটি অল্পসংখ্যক মানবিক সাহায্য সংস্থা এই এলাকাতে কর্মরত রয়েছে, তাদের ভাষ্যমতে, এ রকম সশস্ত্র অভিযান ইতোপূর্বে বিরল। এর প্রভাবে এই এলাকায় বর্তমানে বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রীর তীব্র সংকট বিদ্যমান। জাতিসংঘের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরাইলের সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সমুদ্র, আকাশ ও স্থলপথে সৃষ্ট অবরোধ এবং বোমা হামলার কারণে একটি কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হচ্ছে, যাতে গণহত্যার সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে।

প্রত্যক্ষভাবে এই সংঘাত পর্যবেক্ষণকারী জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরের নিপীড়িত জনগণের জন্য ইতোমধ্যেই ১ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি মানবিক সহায়তা সরবরাহ করেছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এটাও অপ্রতুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় পোলিও ভাইরাসের পুনরায় আবির্ভাব ঘটেছে। যেখানে শিশুদের জন্য টিকাদান কর্মসূচি একান্তভাবেই জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন শীতকালে দুর্গত এলকাসমূহে বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে, যা সাহায্য/উদ্ধার কাজকে আরও কঠিন করে তুলবে।

স্বাস্থ্যসেবা আরও ঝুঁকিগ্রস্ত হবে এবং পানি ও বায়ুবাহিত রোগ বিস্তারের ঝুঁকি আরও বাড়বে। অর্থনীতিবিদদের মতে, গাজা পুনর্গঠনে ৮০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের চেয়েও বেশি অর্থের প্রয়োজন। বিশেষত দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কারণে এই অঞ্চলের শ্রমবাজার এবং উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। যা ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হবে। অদ্যাবধি গাজার ৬০ শতাংশ আবাসিক ভবন আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরাইলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধে ইসরাইলের মাথাপিছু জিডিপি ন্যূনতম ৪.১ শতাংশ হ্রাস পাবে।
ইসরাইলের সামরিক অভিযানের কারণে সৃষ্ট ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংসযজ্ঞ এবং গাজার অনিশ্চিত মানবিক পরিস্থিতি একটি বড় আন্তর্জাতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং আঞ্চলিক সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। বিশ্বের অধিকাংশ নিরপেক্ষ সংস্থা এই বিষয়ে ইসরাইলের তীব্র সমালোচনা করছে এবং শাস্তি দাবি করেছে। এছাড়াও দায়িত্বশীল সকল পক্ষই এই অবস্থার দ্রুত উন্নতিসহ সংঘাতের অবসান করার আহ্বান জানিয়েছে। 
জানুয়ারি ২০২৪-এ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) দক্ষিণ আফ্রিকা কর্তৃক ইসরাইলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত গণহত্যামূলক কর্মকা-ের অভিযোগসমূহকে সমর্থন করেছে। এ সংক্রান্ত মামলা চলাকালে গত মে ২০২৪-এ আইসিজে ইসরাইলকে অবিলম্বে ফিলিস্তিনে তাদের সামরিক অভিযানসহ অন্য যে কোনো পদক্ষেপ, যা ফিলিস্তিনের প্রতি যে কোনো সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে, তা বন্ধের নির্দেশ দেয়। এ প্রেক্ষিতে ইসরাইল জানায় যে, তাদের সামরিক অভিযান ফিলিস্তিনের বেসামরিক ব্যক্তিদের জন্য কোনোরূপ ঝুঁকি সৃষ্টি করে না।

একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর করিম খান ইসরাইলি রাষ্ট্রপ্রধান নেতানিয়াহুসহ শীর্ষ ইসরাইলি ও হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে কথিত যুদ্ধাপরাধের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন। বিষয়টি বর্তমান বাইডেন প্রশাসন ও ইসরাইলি নেতাদের কঠোর নিন্দার সম্মুখীন হয়। তারা দাবি করেন যে, আইসিজের এই রূপ কোনো এখতিয়ার নেই। উল্টো এই বিষয়কে কেন্দ্র করে ইউএস কংগ্রেসের কিছু সংখ্যক নেতা আইসিজে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির আবেদন তোলে।

গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ হতে অদ্যাবধি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পর্ষদ কর্তৃক ৪টি রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য ছিল চলমান সংঘাতের বিরতি, সকল জিম্মির মুক্তি, মানবিক সহায়তার দ্রুত প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং গাজার বেসামরিক ও নিরপরাধ ফিলিস্তিনি জনগণের নিরাপত্তা জোরদার করার আহ্বান জানানো। এখানে উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্যে তিনটি রেজুলেশনের পক্ষে ভোট দেওয়া হতে বিরত থাকে এবং জুন ২০২৪-এ শুধু একটি (ইসরাইল ও হামাস উভয়পক্ষকে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বাস্তবায়নের আহ্বানমূলক) রেজুলেশনের পক্ষে ভোট দেয়।

গাজা ইসরাইলের সামরিক অভিযানের আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়াসমূহ প্রধানত নেতিবাচক। তা সত্ত্বেও, ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক অথবা শান্তিচুক্তি রয়েছে এমন কোনো আরব দেশই এই চলমান ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অদ্যাবধি তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। ৭ অক্টোবর ২০২৩ হামলা পরবর্তী ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অন্যান্য চুক্তি নিয়ে সৌদি আরব-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় আলোচনা প্রাথমিকভাবে বন্ধ থাকলেও ২০২৪-এ সৌদি আরবে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে তা আবার শুরু হয়েছে।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ মন্তব্য করেন যে, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তার দেশ যে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে, তা চলমান থাকবে এবং তা ব্যতীত সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না। পরবর্তীতে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য একটি নতুন যৌথ আরব-ইউরোপীয় উদ্যোগ চালুর ঘোষণা দেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইল-ফিলিস্তিন চলমান সংকটে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে ইরানের প্রত্যক্ষ আবির্ভাব গোটা বিশ্বকে এই বিষয়ে আরও বেশি সচেতন করে তুলেছে। ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাস কর্তৃক ইসরাইল আক্রমণের জবাব হিসেবে ইসরাইল যখন গাজা এলাকায় সশস্ত্র অভিযান শুরু করে, তখন থেকেই ইরান অন্যতম আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসরাইলের উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্ত এলাকাসমূহকে লক্ষ্য করে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে।

ইসরাইল-ইরানের মধ্যে চলমান এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গত ১ এপ্রিল ২০২৪ তারিখ সিরিয়ার দামেস্কে অবস্থিত ইরানী দূতাবাসে ইসরাইল অতর্কিত বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় দূতাবাসে কর্মরত ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি)  আট কর্মকর্তা এবং দুই বেসামরিক সিরিয়ান নাগরিকসহ মোট ষোল  ব্যক্তি নিহত হন এবং দূতাবাসের কনস্যুলার ভবন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইরান ১৩ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে দিবাগত রাতে ইসরাইলে পাল্টা হামলা চালায়।

তেহরান এই হামলায় ড্রোন এবং ভূমি হতে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য বিভিন্ন ধরনের মিসাইল ব্যবহার করে, যা জর্দান, ইউএসএ, ইউকে এবং ইসরাইল তাদের সমন্বিত আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যবহার করে নিস্ক্রিয় করার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ লেবাননে অবস্থিত হিজবুল্লাহ সদর দপ্তরে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হন। গত ত্রিশ বছরের বেশি সময়ে যাবৎ নাসরুল্লাহ লেবাননভিত্তিক এই সশস্ত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।

নাসরুল্লাহ হত্যাকা- ইরান-ইসরাইলের চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। এর মধ্য দিয়ে ইরান-ইসরাইল প্রত্যক্ষ সংঘাত আরও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় গত ১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে ইরান ইসরাইলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে আনুমানিক ২০০ টি ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করে। এই মিসাইল হামলাটি ২টি ওয়েভে ভাগ করে চালানো হয়। এটি ছিল ইরান কর্তৃক সরাসরি ইসরাইলকে লক্ষ্য করে চালানো দ্বিতীয় হামলা।

ইরান এই হামলাকে তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া ও আইআরজিসি জেনারেল আব্বাস নিলফরৌশান এবং লেবাননে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে ইসরাইলি হামলায় হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে তেহরানের আত্মরক্ষায় চালানো আক্রমণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি গত ১৬ অক্টোবর ২০২৪-এ গাজায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হামাসের নেতা ইয়াহিয়া ইব্রাহিম হাসান সিনওয়ার নিহত হন।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট বিষয়ে বাংলাদেশের একটি সুস্পষ্ট ও সামঞ্জস্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরাইলের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। এছাড়াও ইসরাইলের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য এবং অন্য যে কোনো দ্বিপক্ষীয় সহাযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশের রয়েছে বিভিন্ন শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক কালে কালে শোষিত হওয়ার এক দীর্ঘ ইতিহাস। সর্বশেষ এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশ বিশ্বাস করে ইসরাইলি দখলদারিত্ব ও সামরিক বাহিনীর জোরপূর্বক বল প্রয়োগের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইল কর্তৃক অন্যায়ভাবে বসতি স্থাপন এই অঞ্চলে শান্তি আনয়নে অক্ষম।

এই ইস্যুতে বাংলাদেশ ১৯৬৭ সালের ইয়ম-কিপ্পুর যুদ্ধপরবর্তী ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে এবং জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকার করে। তাই এই দীর্ঘ সমস্যার দ্রুত সমাধান এবং কয়েক দশক ধরে অবিচার ও নিপীড়নের শিকার ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে অবস্থান করে বাংলাদেশ অবিলম্বে এর জরুরি সমাধানের দাবি জানিয়েছে।

×