ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার পথ বন্ধ করতে হবে

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২০:৩১, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার পথ বন্ধ করতে হবে

২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়

২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এসব সমাধানে এনবিআর আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক সংক্রান্ত ২৭ হাজারের বেশি মামলার নিষ্পত্তির কাজ করছে। যেগুলোর পরিমাণ কমপক্ষে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। আপিল ট্রাইব্যুনাল ও হাইকোর্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে সরকারি কোষাগারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এনবিআরের চেয়ারম্যানের এই  উদ্যোগ সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
দেশের বিভিন্ন আদালতে ৩২ হাজারের বেশি রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা ঝুলে আছে। তাতে অনাদায়ী রাজস্বের পরিমাণ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। কাস্টমস, এক্সাইজ, ভ্যাট, আয়কর, মূসক ও বন্ড সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনাদায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে ৮ হাজার ৮২৬টি আপিল ও রিটের বিপরীতে ২৩ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকার রাজস্ব আটকে রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বার্থানে¦ষী মহল মূলত বিচার বিভাগের চলমান দীর্ঘসূত্রতাকে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আটকে রেখেছে। তারা মামলাকে রাজস্ব আটকানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। বর্তমানে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে একাধিক বেঞ্চ নির্ধারিত থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এমন পরিস্থিতিতে বেঞ্চ বৃদ্ধির পাশাপাশি ঝুলে থাকা মামলা নিষ্পত্তিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এনবিআর ও আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সারাদেশে বিচারাধীন রয়েছে রাজস্ব সংক্রান্ত ৩২ হাজার ২৫৪টি মামলা। এসব মামলার বিপরীতে সরকারের রাজস্ব জড়িত ৪৯ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। আপিল বিভাগে ৬৯১ আপিলে রাজস্ব জড়িত রয়েছে ৪ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। হাইকোর্টে ৫ হাজার ৩৪৭টি রিটের বিপরীতে জড়িত ১৬ হাজার কোটি টাকা এবং হাইকোর্টে ট্যাক্স ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৭৮৮ আপিলের বিপরীতে জড়িত ৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকা আটকে রয়েছে।

আপিল কমিশন ও ট্রাইব্যুনালের ২৩ হাজার ৭২৮ মামলার বিপরীতে আটক ২৫ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা; কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিল কমিশনে ১২ হাজার ৬১৩ মামলার বিপরীতে ১০ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা; কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনালে ১০ হাজার ৩০৫ মামলায় ৮ হাজার ৬১২ কোটি টাকার রাজস্ব জড়িত রয়েছে। তা ছাড়াও আয়কর সংক্রান্ত ৫১০টি মামলায় ৬ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা আটকে রয়েছে।
রাজস্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে করদাতা কিংবা ব্যবসায়ীরা চাইলে আদালতের আশ্রয় নিতে পারে। বিভিন্ন সময় এমন বিরোধে করদাতারা আদালতে গেছে। সম্প্রতি এ প্রবণতা বেড়েছে। যে হারে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা হচ্ছে, নিষ্পত্তির হার সে তুলনায় ধীরগতি হওয়ায় দিন দিন মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ভ্যাট-ট্যাক্স সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে যেমন ব্যবসায়ীরা আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে, একইভাবে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীরাও আদালতে মামলা করে আটকে রাখছে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। এনবিআর কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ভ্যাট বা ট্যাক্স দাবি করলে তার বিরোধিতায় আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

সে ক্ষেত্রে অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আবেদন বা উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করা যায়। রিট দায়েরের পর উচ্চ আদালত আবেদন খারিজ করে এনবিআরে পাঠাতে পারে। সে ক্ষেত্রে এনবিআরের অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হয়। সে জন্য দাবিকৃত অর্থের ১০ শতাংশ পরিশোধ করতে হয়। অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজনীয় শুনানি শেষে রায় দেন। তারপর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ফের উচ্চ আদালতে আপিল করে। এভাবে গড়িয়ে যায় বছরের পর বছর। উচ্চ আদালতে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য এনবিআরের নিজস্ব কোনো আইনজীবী প্যানেল নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ই এসব মামলা পরিচালনা করে। সে ক্ষেত্রে এনবিআর ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একজন সমন্বয়ক কর্মকর্তা পদায়ন করে এনবিআর।

তবে ওই পদে এক থেকে দুই মাসের জন্য পদায়ন করা হয়। ফলে ঘন ঘন সমন্বয়ক কর্মকর্তা পরিবর্তনের কারণে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বেগ পেতে হয়। আর দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে মামলাগুলো। বর্তমানে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে হাইকোর্টে তিনটি বেঞ্চ রয়েছে। তার মধ্যে দুটি ভার্চুয়াল ও একটি সশরীরে উপস্থিতিতে চলা বেঞ্চ। ওই তিন বেঞ্চে প্রতিদিন গড়ে ১৪ থেকে ১৫টি মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। তবে মামলার সংখ্যা অনুযায়ী মাত্র তিনটি বেঞ্চ পর্যাপ্ত নয়।
এনবিআরের অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের আওতায় আয়কর খাতের জন্য ৭টি বেঞ্চ এবং মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও শুল্ক খাতের জন্য ৩টি বেঞ্চ রয়েছে। এসব বেঞ্চে অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের দুটি শাখায় মামলা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম শুনানি ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। এনবিআরের অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের দুটি আদালতে এক মাসে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৭টি মামলার শুনানি সম্ভব।

তবে কোনো কোনো মাসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, সাক্ষীর অনুপস্থিতিসহ বিভিন্ন সমস্যায় তার চেয়ে কমসংখ্যক মামলার শুনানি হয়। অথচ এসব বিভাগে প্রতিমাসে গড়ে একশ’ থেকে দেড়শ’ নতুন মামলা যুক্ত হয়। ফলে নিষ্পন্ন মামলার তুলনায় অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। তা ছাড়া বারবার সময় আবেদনও মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হওয়ার অন্যতম কারণ। 
রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার একটি সাধারণ উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে মামলা। বছরের পর বছর এসব মামলা ঝুলে থাকলেও সেসব নিষ্পত্তির আশানুরূপ কোনো উদ্যোগ নেই। কিছুদিন আগে এনবিআর অলটারনেটিভ ডিসপিউট রেজ্যুলেশনের (এডিআর) মাধ্যমে রাজস্ব সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলেও তা কাগজেকলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এখন এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আদালতের ওপর সরকারের চাপ প্রয়োগ ছাড়া কোনো পথ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

এসব মামলা নিষ্পত্তিতে এনবিআরের গাফিলতি রয়েছে আর রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া ব্যবসায়ীরা মামলা দীর্ঘমেয়াদি করতে নানাভাবে তৎপর। এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা পরিচালনাকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, অনেক সময়ই আবেদনকারীর পক্ষে মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রতায় ফেলার চেষ্টা করা হয়। তবে আইনজীবীরা তৎপর থাকায় এখন সে সুযোগ তারা খুব একটা পায় না।
রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, রাজস্ব ফঁাঁকির মামলাগুলো দেখার জন্য এনবিআরের লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট নামে একটি বিভাগ রয়েছে। ওই বিভাগ পুরনো মামলাগুলো নিয়মিত নজরদারি করে। রাজস্ব বোর্ডের সদস্যের নেতৃত্বে কর কমিশনারগণ ওই বিভাগে কাজ করেন। আয়কর বিভাগের মতো ভ্যাট এবং শুল্ক খাতেও এমনটি রয়েছে। ঝুলে থাকা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এনবিআরের একটি এডিআর বিভাগ রয়েছে। তার মাধ্যমে আদালতের বাইরে উভয়পক্ষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মামলা নিষ্পত্তি হয়।

তা ছাড়া আদালতে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যও এনবিআরের উইংগুলো অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সময়োপযোগী পদক্ষেপ বটে। বড় কর দাতারা রাজস্ব না দিয়ে মামলার দিকে ঝুঁকে পড়ে, যা একটি বাজে দৃষ্টান্ত। এতে করে রাজস্ব ঘাটতিসহ সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় প্রতিবছর। কাজেই রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার পথ বন্ধ করতে হবে।

লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

×