ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

স্বর্ণপদক প্রাপ্ত কৃষিবিদ মোহাম্মদ আবদুল খালেক

প্রফেসর ড. হাবিবা খাতুন

প্রকাশিত: ২০:০৭, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

স্বর্ণপদক প্রাপ্ত কৃষিবিদ মোহাম্মদ আবদুল খালেক

আবদুল খালেক

মোহাম্মদ আবদুল খালেক বর্তমান নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার শুকন্দী ইউনিয়নের নারান্দী নামের একটি ছোট গ্রামে ১৯৩৪ সালের আগস্ট মাসে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা মো: ইয়াকুব আলী, মাতা তৈয়বুন্নেছা। তিনি একটি স্বচ্ছল কৃষক পরিবারের সন্তান। অভিভাবকগনই তার শিক্ষাজীবনের উৎসাহদাতা। তার চাচা পন্ডিত শামসুদ্দিন আহমদ প্রাইমারি স্কুলের স্বনামধন্য শিক্ষক এবং হাফেজ আবুল কাশেম মসজিদের ইমাম ছিলেন। তাঁর দাদা আহাদ বেপারি এ গ্রামের মাতব্বরদের একজন এবং ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। 

শৈশবেই খালেক সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিদ্যালয়ে যাওয়া তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।কেননা তিনি দেখেছিলেন যে তার মা রাতে তার পরিহিত একমাত্র প্যান্ট ও শার্ট ধুয়ে দিতেন; যাতে পরের দিন সকালে সেই পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে স্কুলে যেতে পারেন। শৈশবেই এভাবে তিনি পরিচ্ছন্নতায় অভ্যস্ত হয়েছিলেন, একই সাথে অল্পে তুষ্টে থাকতে শিখেছিলেন। 

গ্রামের পন্ডিত শামসুদ্দিন আহমদ (পন্ডিত চাচা) ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মোহম্মদ আলী মাস্টার ছিলেন নারান্দী গ্রামে প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা। প্রাইমারি স্কুলে বৃত্তি পেয়ে খালেক সাহেব নিকটবর্তী হাতিরদিয়া সাদত আলী হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখানে ১৯৫০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা যোগ্যতার সাথে শেষ করেন। এই স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন মৌলভী মোহাম্মদ আবু তাহের। তিনি আমাদের ইতিহাস প্রসিদ্ধ শহীদ আসাদুজ্জামান এর পিতা। 

ছাত্রবস্থা থেকেই তিনি এই শিক্ষকের ভক্ত ছিলেন। সত্যকথা বলতে তিনি এই শিক্ষকের মতোই অকুতোভয় ছিলেন। খালেক সাহেবের বাড়ীর কাছে সে সময় কোন কলেজে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ ছিলনা বিধায়Ñ তাঁকে দূরবর্তী কিশোরগঞ্জ জেলাস্থ গুরুদয়াল কলেজে আই. এস.সি (ও.ঝপ) পড়ার জন্য যেতে হয়েছিল। সেখানে একটি স্বচ্ছল কৃষক পরিবারের বাড়িতে তিনি ‘জায়গীর মাস্টার’ বা গৃহ শিক্ষক ছিলেন। 

এই পরিবার তাকে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। এখানে একটি কথা না বললেই নয়- তা হল, তাকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল, তাতে খিল এটে থাকার ব্যবস্থা ছিল বটে তবে এক পাশে একটি বেড়া ছিল না। 

তাই সারারাত তাকে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাখতে হত, তা না হলে তার ভয় কাটত না। তবে অতি যতেœর সাথে বাড়ির মালিক তার দেখাশুনা করতেন, তিনি সে গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন বলেই ১৯৫২ সালে আই.এস.সি পাশ করে কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনার জন্য ঢাকাস্থ শেরে বাংলা কৃষি কলেজে ভর্তি হন। সে সময় শেরে বাংলা কৃষি (ডিগ্রি) কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বর্ধিত অনুষদ (ঊীঃবহফবফ ঋধপঁষঃু) ছিল। 

একমাত্র এই কলেজেই সে সময় পূর্ব বাংলায় কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষাদান করা হতো। ইতিহাসে কৃষিবিজ্ঞানে পারদর্শী প্রিন্সিপাল জনাব ফরিদ আহমদ, জনাব সুলতান আহমদ তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন। তাদের সময়ানুবর্তিতা, কৃষককুলের কঠিন পরিশ্রমের বার্তা, মাটি ও মাঠের পরিচর্যা বিষয়ক জ্ঞান ছাত্রদের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তৎকালীন সময়ে পাশ করা বিখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী ছিলেন ড. কাজী বদরুদ্দোজা, ড. কামালউদ্দিন আহমদ, ড. হাসানুজ্জামান, আই এইচ খান প্রমুখ। তারা বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার অগ্রগামী দল। ১৯৫৭ সালে বি.এ.জি (গ্রাজুয়েট) পরীক্ষা শেষ করে আবদুল খালেক সহ অন্যান্য সহপাঠীরা নিজ নিজ বাড়ীতে অবস্থান করার সময় একটি সরকারি চিঠি পান। 

চিঠির মাধ্যমে তাদের মধ্যে তিনজন - যথা আবদুল খালেক, আবদুল মুনিম, কাজী রিয়াজ জানতে পারেন যে তারা কলম্বো প্ল্যান ট্রেনিং এর জন্য সিলেক্টেড। অতিশীঘ্র তাদের কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে, তারা লন্ডনে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স কোর্স অধ্যয়ন করার সুযোগ পাবে এবং তা সরকারি খরচে। সে যুগে এ ধরনের স্কলারশিপ পাওয়া আজকের কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পাওয়ার শামিল। ক্যাম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ে আবদুল খালেক বৃত্তির অর্থ পেয়ে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রির অংশ সম্পন্ন করেন। 
মি. থমপসন ছিলেন তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক। ক্যাম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় চত্ত¡রে এখনো একটি রাস্তা আছে তার নামে। পরবর্তী জীবনে মোহাম্মদ আবদুল খালেক (সম্ভবত দীর্ঘ ১৫ বছর পরে) ময়মনসিংহ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় হতে এম.এ. জি ডিগ্রি (১ম শ্রেনী) অর্জন করেন। এ সময় তিনি ড. হাসানুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের ‘পাট শস্য’ শীর্ষক থিসিস রচনা করেন। 

লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি সে দেশের জনজীবনের কৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। আরও জেনেছিলেন যে বাংলাদেশের সিলেটি মানুষেরা সে দেশের রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশী খাবার পরিবেশন করে। তাদের এক জনগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করে। সপ্তাহান্তে লন্ডনের বাংলাদেশী ছাত্ররা আলী ভাই এর রেস্টুরেন্টে আলু ভর্তা ও ডাল খাওয়ার লোভে সমবেত হয়। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ডিগ্রী শেষ হওয়ার পূর্বেই জনাব আবদুল খালেক দ্রুত দেশে ফিরে আসেন। মা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই ফিরে আসাকে তিনি আশীর্বাদ স্বরূপ নিয়েছিলেন। দেশে ফিরে আসার পর জনাব খালেক ‘চষধহঃ চৎড়ঃবপঃরড়হ ঙভভরপবৎ’ পদে কৃষি বিভাগে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। 

পরে কৃষি বিভাগের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গুলোতে শিক্ষকরূপে নিয়োজিত হন। প্রথমে রংপুর জেলার তাজহাট এর শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬০ সালে ময়মনসিংহ জেলাস্থ শেরপুর টাউনে অবস্থিত শেরপুর কৃষি ইনস্টিটিউটে বদলি হয়ে আসেন। শেরপুর একটি জমিদার প্রধান এলাকা ছিল। সেখানে ‘পৌনে তিন আনি’ জমিদার বাড়িতে তিনি বাস করতেন। এ সময় ঢাকার বিখ্যাত আলেম মাওলানা কবিরউদ্দিন রহমানীর দ্বিতীয় কন্যা হাবিবা খাতুনের সথে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রী শেরপুর গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। শেরপুর থেকে ঢাকাস্থ কৃষি ট্রেনিং ইনস্টিউটে বদলি হবার পর জনাব খালেক স্বপরিবারে কৃষি কলেজ গেইট সংলগ্ন ‘ভিলেজ এইড’ সরকারি বাসায় বসবাস করতেন। 

কালক্রমে ‘ঢাকা ফার্মের চীফ সুপারিনটেন্ডেন্ট’ পদে নিয়োজিত হন। ঢাকা ফার্ম তৎকালীন কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ছিল। এ ফার্মকে কেন্দ্র করে কৃষি বিজ্ঞানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনিস্টিটিউট’, যা সংক্ষপে ‘বারি’ (ইঅজও) নামে জয়দেবপুরে স্থানান্তরিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকা থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুরে ফার্ম স্থানান্তকরনের দিনে তৎকালীন কৃষি বিজ্ঞানীগণ অক্লান্ত পরিশ্রম করেন ও ঢাকাস্থ শেরে বাঙলা নগর হতে সেখানে আন্তজার্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কৃষি বিজ্ঞানী আবদুল খালেক এর অবদান এখানে অনস্বীকার্য। 

নারী শিক্ষা বিস্তারের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। শেরে বাঙলা নগরে অবস্থান কালে তিনি তার স্ত্রীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়ার সুযোগ করে দেন। ফলে তার স্ত্রী এম.এ ক্লাসে (১ম শ্রেনীতে প্রথম) হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ পান। তার স্ত্রী প্রফেসর ড. হাবিবা খাতুন কৃতজ্ঞতার সাথে বলেন, “আমার স্বামী ও শাশুড়ির নারী শিক্ষার প্রতি সংবেদনশীলতার জন্যই আমার এম.এ পড়া সম্ভবপর হয়েছে। আমি বিকেলে লাইব্রেরী ব্যবহার করতাম, রাতে বাসায় ফিরতাম। আমার স্বামী সে সময় আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়ে আসতেন। তা না হলে কঠোর পরিশ্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হত না।” সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মোহাম্মদ আবদুল খালেক ‘টঢ়ংধষধ টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঝবিফবহ’ এ কৃষি গবেষণায় উন্নত জ্ঞান অর্জন করেন। 

হাতে কলমে শিক্ষার সুযোগ পেয়ে এক গ্রæপ কৃষিবিজ্ঞানী তার নেতৃত্বে গভীর গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। এদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হল “উচ্চফলনশীল ঝঝ ৭৫” শীর্ষক সরিষার বীজ উদ্ভাবন। কৃষি বিভাগে এ বীজ ‘সোনালী সরিষা’র বীজ নামে পরিচিত। এ বীজ কৃষককূলের হাতে সরিষার উৎপাদনকে তিনগুন বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৮০ সালে এ উদ্ভাবনকে স্বর্ণপদক দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করেন, “জেবুন্নেছা এবং কাজী মাহবুবুল্লাহ কল্যাণ ট্রাস্ট”। কৃষিবিজ্ঞানী মোহম্মদ আবদুল খালেক ও ৪ জন কৃষিবিজ্ঞানী- আশরাফুল ইসলাম, জামালপুরের কৃষি অফিসার (নাম অজানা), ড. আলী আকবর ও সোলায়মান খান কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তৈলবীজ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। 

তাদের এ উদ্ভাবন কৃষিগবেষণা ইনিস্টিটিউটের মর্যাদা বহুগুনে বর্ধিত করে। কৃষি বিজ্ঞানীদের তৎকালীন সফলতার এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কৃষি বিজ্ঞানী আবদুল খালেকের নিরক্ষর কৃষক পিতা গ্রামীন সমাজে একজন বিজ্ঞ ফসলীজমির মাটি বিশারদ ছিলেন। মূলা চাষ করার বিশেষ কায়দা বা মাটি প্রস্তুত প্রণালী তার জানা ছিল। পিঁয়াজ, আলু জাতীয় ফসল কী কারণে পচে যেতে পারে তা তিনি প্রকৃতি থেকে শিখেছিলেন। গ্রামের মানুষ তাঁর কাছে এসব বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসতেন। 

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের হায়দ্রাবাদে অবস্থিত বিখ্যাত কৃষি গবেষণা কেন্দ্রটির নাম ওঈজওঝঅঞ. ইঅজও গবেষণা কেন্দ্রের আবদুল খালেক ও অন্যান্য কৃষি বিজ্ঞানী একযোগে গবেষণায় তৎপর ছিলেন। ফলে ‘ত্রিদানা চীনাবাদাম’, ‘সয়াবিন’, ‘সূর্যমুখী’ - ফসলের উপর তারা গবেষণা করেছিলেন। গবেষণা কর্মের জন্য জনাব আবদুল খালেক ২০০০ সালে  ÔICRISATÕ KZ©„K ÒSignificant Scientist of SouthEast AsiaÓ পদকে ভূষিত হন। অনুরূপ অন্যান্য তৈলবীজ গবেষণায় ও তিনি আমাদের দেশের বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রª BCSIR, Atomic Energy Center, Agriculture University of Mymensing  এর গবেষণাধর্মী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। 

ÔFAOÕ (Food and Agricultural Organisation of The United Nation) কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানী আবদুল খালেক বাংলাদেশের “ডিকেড অব এডিবল অয়েল” শীর্ষক পুস্তিকা রচনা করেন। এ সময় তৈলবীজ বিভাগের বিজ্ঞানী আহসানউল্লাহ তাকে সহযোগিতা দিয়েছিলেন। এছাড়া একই অর্গানাইজশেনের মাধ্যমে সুইডেন, কানাডা, মিশর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিজ্ঞানীদের সাথে যোগাযোগ রেখে কৃষি বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন করেন। 

সার্ক কৃষি সম্মেলনে বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা বিষয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন তিনি। ফলে সার্কভুক্ত দেশগুলোর সাথে যুক্ত হয় ‘বারি’এবং তরুণ বিজ্ঞানীদের ‘পি এইচ ডি’ ডিগ্রী অর্জনের সুযোগ হয়। ১৯৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ‘সয়াবিন’ শস্য দানার উপর কনফারেন্সে তিনি যোগ দিয়ে বাংলাদেশে এ শস্যের অবস্থান তুলে ধরেন। পরবর্তী সময়ে সয়াবিন গবেষণা এ দেশে গুরুত্ব পায়। ‘সয়া দুধ’, ‘সয়া ময়দা’, ‘সয়া ব্রেড’ এদেশে উৎপন্ন হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের দিনে তেজকুনি পাড়া বস্তিতে সয়া প্রোটিন বিস্কুট বিতরন করেছিলাম আমি। 

সূর্যমুখীর দানা হতে দেশীয় তৈল উৎপাদন করা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে ‘বারি’র তত্ত্বাবধানে। উৎপাদিত তেল উচ্চপদস্থ কৃষিবিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত করা হয়েছিল - উন্নতির বার্তা পৌছানের জন্য। একই সময়ে বনজ ‘বাজনা দানা’, ‘ভেড়েন্ডা দানা’, ‘রয়না(রহিনা)দানা’ ইত্যাদি সংগ্রহ করেছিল তৈলবীজ বিভাগ ও তেল উৎপাদন করেছিল, সরকারি অনুদানে মৌমাছি পালন করার জন্য ‘সোনালী সরিষা’ ক্ষেত্রে মৌমাছি পালন করা শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানী আবদুল খালেক। 

কৃষি বিজ্ঞানীদের সফলতার কথা ‘কৃষিকথায়’ নিয়মিত প্রকাশিত হত। বিজ্ঞানী খালেক সাহেব সে পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। বিজ্ঞান গবেষণার জগতে বিচরণ করলেও মুক্তিযুদ্ধের দিনে দেশমাতার সেবায় ব্রতী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গেরিলা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী তরুণদের তার অফিস আইডি(ওউ) দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সে সব তরুনদের পরিবারকে নিজের পরিবারের সাথে তদারকি করতেন। 

যুদ্ধোত্তর সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার স্বভাবে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছিলেন- তিনি তাদের তার বাগানের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। এরূপ একজনের নাম আবুল হাসান মাসুদ। এই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে তৎকালীন সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও আর্থিক অনটনের দিনে তাকে স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে নিজ বাসস্থানের বাগানে কাজ করার সুযোগ দেন। 

নিজ তদারকিতে তাকে ব্যস্ত রাখাই ছিল উদ্দেশ্য। মুক্তিযোদ্ধারা সবসময় পিস্তল হাতে নিয়ে থাকতে অভ্যস্ত ছিল। বাগানে কাজ করার সময় খুরপি হাতে রাখতে হত। ধীরে ধরে হাত থেকে পিস্তলের বদলে খুরপি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যাস পাল্টে যায়। কৃষিকাজের সূত্র ধরে খুরপি জীবনের মোড় পাল্টে দেয়। খুরপি থেকে কলম ধরার অভ্যাস শুরু হয়। বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা বুয়েটের শিক্ষাজীবনে মনোযোগ দেন। সফলতার সাথে স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি বিশিষ্ট ক্যামিকাল ইঞ্জিনিয়ার। 

বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী এবং খালেক সাহেবের স্ত্রী প্রফেসর হাবিবা খাতুনের ছোট ভাই। স্বাধীনতার উত্তরকালে, ১৯৭৪ সালের অভাবের দিনে তিনি তার পরিবারকে আশেপাশের দরিদ্র ব্যক্তিদের প্রতি খাবার দিয়ে সাহায্য করতে উৎসাহিত করতেন। নিজে সাহায্য করতেন। এসব কাজের কথা তিনি কারও কাছে প্রকাশ করতেন না। বরং জীবনের প্রতি স্তরে এ অভ্যাসকে কার্যকরী রাখার পরামর্শ দিয়েছেন ঘনিষ্ঠজনদের মাঝে। 

কৃষি বিজ্ঞানী আবদুল খালেক ১৯৯৪ সালে পার্কিনসনস রোগে আক্রান্ত হয়ে চলা ফেরার শক্তি হারান। কম্পিউটার ব্যবহার করে তিনি বিদেশে পাঠরত সন্তানদের সাথে ই-মেইলে যোগাযোগ করতেন। প্রতিদিন চিঠি লিখতেন। তার সময় জ্ঞান ছিল তীক্ষ্ণ। তিনি বলতেন- সময় দাম দিয়ে কেনা যায়- সময় হারালে আর কিছু ফেরানো যায় না। এর অর্থ হল, গাড়ি ব্যবহার করে, টাকা খরচ করে দ্রæত কাজের স্থানে পৌছালে বেশী কাজ করা সম্ভব কিন্তু টাকা বাঁচিয়ে হেটে গেলে বা অন্য যানবাহনে যেয়ে টাকা বাঁচালে কাজ কম হবে- সময় হারিয়ে যাবে। সে সময় আর ফিরবে না। 

কাজেই যাকে যতটুকু আয়ু দিয়েছেন আল্লাহ তার উচিত তার সদ্ব্যব্যবহার করা। বিজ্ঞানী মোহম্মদ আবদুল খালেক এ দেশের আদর্শ কৃতি সন্তানদের মাঝে অন্যতম। সাদাসিধেভাবে চলা ও ত্যাগী মানুষ হিসেবে তিনি বেশি প্রসিদ্ধ। ধার্মিক মোহম্মদ আবদুল খালেক ২০০২ সালের ৫ অক্টোবর ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছায় নারান্দি পারিবারিক গোরস্থানে তাকে সমহিত করা হয়। তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তান রেখে গেছেন। তাঁর প্রিয় বাড়িটির নাম ‘সূর্যমুখী’।
 

এসআর

×