ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

ভারত-কানাডা উত্তেজনা এবং ট্রুডো সরকারের সংকট

ড. শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২২ অক্টোবর ২০২৪

ভারত-কানাডা উত্তেজনা এবং ট্রুডো সরকারের সংকট

ভারত এবং কানাডার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা সম্প্রতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে

ভারত এবং কানাডার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা সম্প্রতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের হলেও, এটি কখনই খুব মসৃণ ছিল না। ঐতিহাসিকভাবে ভারত-কানাডার সম্পর্ক নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে গেছে, যার পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ বিদ্যমান। আজকের উত্তেজনাটি নতুন হলেও এর শিকড় অনেক পুরনো বিরোধের মধ্যে নিহিত। ভারত ও কানাডার ঐতিহাসিক বিরোধের সূত্রপাত বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।

১৯৪৭ সালে ভারত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভের পর, কানাডা ভারতের সঙ্গে একটি স্বাধীন ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য বরাবরই বিদ্যমান ছিল। বিশেষ করে শিখ অভিবাসীদের বিষয়টি দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছে। কানাডায় শিখ সম্প্রদায় একটি উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অংশ এবং তাদের বড় একটা অংশ খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থক। খালিস্তান একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন, যা ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে এই আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে এবং ভারত সরকারের কাছে এটি একটি সন্ত্রাসবাদী হুমকি হিসেবে চিহ্নিত হয়।

এই ঘটনার সূত্রপাত মূলত আরও বহু আগে। সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ভারতের শিখ সম্প্রদায়ের বহু মানুষ বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কানাডায় পাড়ি জমায়, কিন্তু তাদের আশ্রয় পাওয়া নিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এই ঘটনাটি মূলত ১৯১৪ সালে ঘটে যাওয়া কোমাগাটা মারু জাহাজের ঘটনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। 
১৯১৪ সালে কোমাগাটা মারু নামক একটি জাহাজে ৩৭৬ জন ভারতীয় শিখ, মুসলিম, এবং হিন্দু যাত্রী ব্রিটিশ-ভারত থেকে কানাডায় আসে আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে। তাদের বেশিরভাগই শিখ ছিলেন এবং তারা ভ্যাঙ্কুভারে নতুন জীবনের আশায় কানাডায় প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কানাডার সরকার তাদের আশ্রয় দেওয়ার পরিবর্তে ফিরিয়ে দেয়। সে সময় কানাডা অভিবাসন নীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত কড়া ছিল, বিশেষ করে এশীয়দের জন্য। কানাডা তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় এশীয় অভিবাসীদের আগমন ঠেকানোর জন্য নানা ধরনের বর্ণবাদী আইন চালু করা হয়েছিল।

১৯০৮ সালে অভিবাসন আইন সংশোধন করে ‘ঈড়হঃরহঁড়ঁং ঔড়ঁৎহবু জবমঁষধঃরড়হ’ নামের একটি ধারা প্রণয়ন করেন, যার মাধ্যমে কানাডায় আসার ক্ষেত্রে যাত্রাপথে কোনো বিরতি নেওয়া যাবে না, এই নিয়মটি বাধ্যতামূলক করা হয়। এই নিয়ম অনুযায়ী, অভিবাসীদের তাদের নিজ দেশ থেকে কানাডার উদ্দেশে সরাসরি টিকিট কিনতে হতো, অন্যথায় তাদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো না। বাস্তবে, এই বিধিটি মূলত ভারত ও জাপানের অভিবাসীদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। কারণ, সেই সময় এসব দেশ থেকে কানাডায় সরাসরি যাত্রার কোনো সুবিধা ছিল না। ম্যাকেঞ্জি কিংয়ের প্রতিবেদনে ভারতে থেকে অভিবাসন আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করা হয়েছিল।

তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, কানাডায় বসবাসরত অনেক ভারতীয় বেকার এবং দরিদ্র ছিলেন এবং তাদের পরিস্থিতির জন্য কানাডার জলবায়ু এবং জীবনযাত্রার সঙ্গে তাদের জীবনযাত্রার অসামঞ্জস্যতাকে দায়ী করেছিলেন। তবে, ভারতীয় অভিবাসীদের সরাসরি তাদের নাগরিকত্বের ভিত্তিতে নিষিদ্ধ করা কঠিন ছিল। কারণ, তারা ব্রিটিশ প্রজাস্বত্ব হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পেতেন। এই আইন সরকারকে ভারতীয় এবং জাপানি অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়, যেখানে জাতি, জাতীয়তা বা জাতিগত উৎসের ওপর সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি।

কানাডিয়ান প্যাসিফিক ছিল একমাত্র শিপিং কোম্পানি, যারা ভারত থেকে কানাডায় সরাসরি স্টিমশিপ পরিষেবা প্রদান করত, কিন্তু এই বিধি প্রণয়নের পর কানাডিয়ান সরকার কানাডার উদ্দেশে ভারত থেকে সরাসরি টিকিট বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেয়। এ ছাড়া, এই বিধিটি জাপানি অভিবাসনের জন্য হাওয়াইয়ান পথও বন্ধ করে দিয়েছিল।
ফলশ্রুতিতে যখন কোমাগাটা মারু ভ্যাঙ্কুভারের উপকূলে পৌঁছায়, কানাডার অভিবাসন কর্মকর্তারা তাদের জাহাজ থেকে নামতে দেয়নি। যাত্রীদের সঙ্গে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার শিখ সম্প্রদায়ের নেতারা সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তারা নানা আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন, যাতে তাদের কানাডায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। কিন্তু কানাডার সরকার জোর করে তাদের ফেরত পাঠায়। প্রায় দুই মাসের অচলাবস্থার পর, ৩৭৬ যাত্রীকে অবশেষে ব্রিটিশ ভারতে ফেরত পাঠানো হয়, যেখানে তাদের মধ্যে অনেকেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে নিপীড়নের শিকার হন এবং অনেককে হত্যা করা হয়।

এই ঘটনা শিখ অভিবাসী সম্প্রদায়ের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে এবং এটি কানাডার অভিবাসন নীতির বর্ণবাদী ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়। কানাডা পরে এই ঘটনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, কিন্তু এটি কেবল ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে থেকে যায়নি, বরং বর্তমান সময়ের ভারত-কানাডা সম্পর্কেও এর ছাপ রয়ে গেছে। খালিস্তান আন্দোলন এবং কানাডার শিখ সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে এই অতীতের কিছু সংযোগ রয়েছে।

কানাডার শিখ সম্প্রদায় এখন কেবল একটি বিশাল অভিবাসী গোষ্ঠীই নয়, বরং রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে কোমাগাটা মারু ঘটনার মতো অতীতের বঞ্চনার ইতিহাস কানাডার অভিবাসন নীতির প্রতি সমালোচনার জন্ম দেয়, বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক উত্তেজনার পটভূমিতে।

ভারত-কানাডা বিরোধের আরও কিছু ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। যেমন, ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২-এর বোমা বিস্ফোরণে ৩২৯ জন নিহত হন, যার অধিকাংশই কানাডার নাগরিক ছিলেন। এই ঘটনা ভারত-কানাডার সম্পর্কের ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। কারণ, এর পেছনে সন্দেহভাজন হিসেবে কানাডায় অবস্থিত খালিস্তানপন্থি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। সেই সময়ও ভারত ও কানাডার মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে যায়। কানাডার সরকারের উদাসীনতা ও খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি কিছু কানাডিয়ান নেতার সহানুভূতির কারণে ভারত এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল।

বর্তমানে যে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, তা মূলত কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগকে কেন্দ্র করে। ২০২৩ সালে ট্রুডো প্রকাশ্যে দাবি করেন যে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কানাডায় বসবাসরত হরদীপ সিং নিজ্জর নামক একজন শিখ নেতার হত্যাকা-ে জড়িত। নিজ্জর খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এবং ভারত তাকে দীর্ঘদিন ধরে একজন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে বিবেচনা করে আসছিল। ট্রুডোর এই অভিযোগ ভারত সরাসরি অস্বীকার করেছে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এটিকে ‘অযৌক্তিক ও মিথ্যা’ বলে বর্ণনা করেছে। এই অভিযোগের পর ভারত ও কানাডার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

উভয় দেশই একে অপরের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে এবং কয়েকটি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্থগিত করেছে। কানাডার মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহল এই ইস্যুতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কানাডার একাধিক সংবাদমাধ্যম যেমন ঞযব এষড়নব ধহফ গধরষ এবং ঞড়ৎড়হঃড় ঝঃধৎ এ নিয়ে বিস্তৃত রিপোর্ট করেছে। তারা ট্রুডোর বক্তব্যের পক্ষে কিছু তথ্য উপস্থাপন করলেও ভারতের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ এখনো সর্বসাধারণের কাছে সুস্পষ্ট নয়। যদিও কানাডিয়ান কূটনীতিকরা বলেছেন, তারা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছেন। 
ভারতীয় মিডিয়ায় ট্রুডোর অভিযোগকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। ট্রুডো কানাডার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে এই ইস্যুটিকে তুলে ধরছেন বলে অনেক ভারতীয় মনে করছেন। কানাডার অর্থনৈতিক অবস্থা, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে ট্রুডোর সরকার ব্যাপক সমালোচনার মুখে আছে। শিখ সম্প্রদায় কানাডায় একটি বড় ভোটব্যাংক, এবং ট্রুডোর লিবারেল পার্টির প্রতি তাদের সমর্থন উল্লেখযোগ্য। ফলে, ট্রুডো এই সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট করার জন্য ভারতকে অভিযুক্ত করছেন বলে সমালোচকরা বলছেন। তবে, শুধু ভোট ব্যাংককে সন্তুষ্ট করার জন্য এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলার মতো রাষ্ট্র কানাডা নয়, এটি মনে রাখা জরুরি।

যদিও কানাডার আসন্ন ফেডারেল নির্বাচনে এই ইস্যু একটি বড় ফ্যাক্টর হতে পারে। ট্রুডো যদি এই ইস্যুকে নির্বাচনি প্রচারে কাজে লাগান এবং কানাডার জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে ধরেন, তবে এটি তাকে ভোটারদের একটি নির্দিষ্ট অংশের সমর্থন পেতে সাহায্য করতে পারে। তবে এটি বিপরীত প্রতিক্রিয়াও আনতে পারে। কানাডার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ভারতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে খারাপ হলে, অর্থনৈতিক দিক থেকে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, যা ট্রুডোর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে পারে, বিশেষত শিখ সম্প্রদায় ছাড়াও কানাডায় আরও নানা বর্ণের ভারতীয় অভিবাসী রয়েছে।

উভয় দেশের মধ্যে খাদ্যশস্য, প্রযুক্তি এবং পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। ভারত কানাডার জন্য একটি বড় রপ্তানি বাজার এবং উভয় দেশই বহু আন্তর্জাতিক ফোরামে একে অপরের সহযোগী। এই সম্পর্ক যদি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে কানাডার অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থান কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই উত্তেজনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমেরিকার অবস্থান। আমেরিকা কানাডার নিকটতম মিত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের কানাডার প্রতি দীর্ঘদিনের সমর্থন রয়েছে। তবে ভারতও আমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র। সম্প্রতি, আমেরিকার মিডিয়ায় যেমন ঞযব ঘবি ণড়ৎশ ঞরসবং এবং ঞযব ডধংযরহমঃড়হ চড়ংঃ এই ইস্যুতে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যেখানে আমেরিকাও ভারতের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ তুলেছে।

যদিও এ অভিযোগ কানাডার ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়, তবে একই সময়ে আমেরিকার অভিযোগ উত্থাপন এটি পরিষ্কার করে তুলেছে যে, ভারত ইস্যুতে আমেরিকা কানাডার পাশেই থাকবে। ২০২৪ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এই পরিস্থিতি সামনে পরিবর্তিতও হতে পারে। যদি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস নির্বাচনে জয়ী হন, তাহলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ায় তিনি এই পরিস্থিতি সমাধানের জন্য এক ধরনের গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারেন। হ্যারিসের ব্যক্তিগত সংযোগ এবং দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাকে ভারত-কানাডার উত্তেজনা প্রশমিত করার পথে নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করতে পারে।

অন্যদিকে, যদি রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও নির্বাচনে জয়ী হন, তবে তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এবং কূটনৈতিক জটিলতার প্রতি অনাগ্রহের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। ট্রাম্পের ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আমেরিকার ভারত সম্পর্ক কিছুটা ইতিবাচক ছিল, তবে কানাডা যেহেতু আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র, তাই নির্বাচিত হলে এবার তার প্রশাসনকেও এই ইস্যুতে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। 
এখন প্রশ্ন হলো, ভারত-কানাডার এই দ্বন্দ্বের প্রভাব বাংলাদেশে কিভাবে পড়তে পারে? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সবসময়ই আঞ্চলিক উত্তেজনার প্রভাব অনুভব করে। বাংলাদেশ ভারত ও কানাডার উভয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছে। ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব বাংলাদেশে গভীর। অন্যদিকে, কানাডাও বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী দেশ।

বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারের একটি বড় অংশ কানাডায় এবং উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রেও কানাডার ভূমিকা রয়েছে। বিশেষত বিগত সরকারের আমলে কানাডা ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর সম্পর্ক ছিল। বর্তমানে ক্ষমতায় পটপরিবর্তনে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক বেশ শীতল এবং কানাডার সঙ্গে সম্পর্ক সামনে কোন্দিকে এগুবে, সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। যদি ভারত-কানাডার সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদে খারাপের দিকে যায়, তবে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ কখনোই সরাসরি কোনো পক্ষ নিতে চাইবে না। কারণ, উভয় দেশের সঙ্গে তার স্বার্থ জড়িত।

ভারতের সঙ্গে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বিপুল বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, অন্যদিকে কানাডার সঙ্গে অভিবাসন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কানাডায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী অভিবাসী রয়েছে এবং অনেক শিক্ষার্থীও এখানে পড়াশোনা করছে। যদি ভারত-কানাডার সম্পর্কের অবনতি ঘটে, তবে এটি বাংলাদেশী অভিবাসী এবং শিক্ষার্থীদের ওপর কিছু প্রভাব ফেলতে পারে, যদিও তা সরাসরি বা তাৎক্ষণিকভাবে নয়। সামগ্রিকভাবে, ভারত-কানাডার এই উত্তেজনা দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।

এটি কেবল দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এর প্রভাব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পড়বে। আমেরিকা, বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর ওপরও এর প্রভাব দেখা যাবে। আগামী দিনে এই সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করবে উভয় দেশের সরকারের পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ভূমিকার ওপর।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বর্তমানে কেবল ভারতের সঙ্গে উত্তেজনাময় সম্পর্কের সম্মুখীন নন, বরং তার সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও রয়েছে। বিশেষ করে ট্রুডোর লিবারেল পার্টির চার প্রভাবশালী মন্ত্রী ২০২৫ সালের ফেডারেল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র ট্রুডোর নেতৃত্বে আস্থাহীনতার ইঙ্গিতই দেয় না, বরং তার দলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা এবং তার নেতৃত্বের প্রতি দলের সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এই পরিস্থিতি ট্রুডোর জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে এবং তা তাকে তার নেতৃত্বের ওপর গভীরভাবে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে।

দলের মধ্যে নেতাদের আস্থা সংকট এবং নেতৃত্বের প্রতি অসন্তোষ বৃদ্ধি পেলে, তা নির্বাচনি প্রচারণায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কেন এই প্রভাবশালী নেতারা নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন না? একাধিক কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ট্রুডো সরকারের নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক সিনিয়র নেতার মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে। ট্রুডোর নেতৃত্বে প্রথম কয়েক বছর লিবারেল পার্টি বেশ সাফল্য অর্জন করেছিল, বিশেষ করে ২০১৫ সালে তার জনপ্রিয়তা শীর্ষে ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা বিতর্ক, যেমন ব্ল্যাকফেস স্ক্যান্ডাল, ইথিক্স ভঙ্গের অভিযোগ, এবং কোভিড মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা- সব মিলিয়ে ট্রুডোর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে।

দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে ট্রুডোর নেতৃত্বের প্রতি এক ধরনের ক্লান্তি তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন যে, দলের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের পরিবর্তন দরকার এবং এটি একটি প্রাকৃতিক প্রবণতা যা দীর্ঘদিনের সরকারে দেখা যায়। বিশেষত যখন সরকারের কার্যক্রমে কোনো বড় পরিবর্তন বা উদ্ভাবন দেখা যায় না, তখন দলের সদস্যদের মধ্যে নেতৃত্বের পরিবর্তনের দাবি বৃদ্ধি পায়। এটি কেবল লিবারেল পার্টির মধ্যে নয়, বরং যে কোনো দীর্ঘমেয়াদি সরকারে দেখা যায়। তৃতীয়ত, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে ট্রুডোর নেতৃত্ব ক্রমশ চাপের মুখে পড়ছে।

কানাডার অর্থনৈতিক অবস্থা যেমন মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ বেকারত্বের হার, এবং আবাসন সংকট- সব মিলিয়ে জনগণের অসন্তোষ বাড়ছে। অনেক সিনিয়র মন্ত্রী এই চাপের মধ্যে নিজেকে আর সামনে রাখতে চান না। কারণ, এর ফলে তাদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সুনাম হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ট্রুডো এই পরিস্থিতি কিভাবে সামলাচ্ছেন? ট্রুডোর নেতৃত্বে চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও তিনি এখনো কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নিচ্ছেন যা তাকে এই সংকট মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে পারে। প্রথমত, তিনি চেষ্টা করছেন দলের নতুন প্রজন্মের নেতাদের সঙ্গে কাজ করতে এবং তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রদানের মাধ্যমে দলকে পুনর্গঠিত করতে। লিবারেল পার্টির অভ্যন্তরে নতুন নেতৃত্বের বিকাশ ট্রুডোর জন্য একটি কৌশল হতে পারে, যা তাকে দলের অভ্যন্তরীণ চাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ট্রুডো তার জনপ্রিয়তার পুনরুদ্ধার করতে চেষ্টা করছেন বিভিন্ন সামাজিক এবং পরিবেশগত ইস্যুতে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে। যেমন, তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কানাডার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন, যা লিবারেল পার্টির মূল ভোটারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ট্রুডো জানেন যে, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন কানাডার তরুণ ভোটারদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এবং তিনি সেই ভোটারদের সমর্থন ধরে রাখতে চান। তৃতীয়ত, ট্রুডো ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক উত্তেজনা নিয়ে রাজনৈতিক কৌশলগত পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিকে কেন্দ্র করে ট্রুডো চেষ্টা করছেন জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে একটি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে, যা তার সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। যদিও এই কৌশলটি ঝুঁকিপূর্ণ।

কারণ, এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কানাডার অবস্থান দুর্বল করতে পারে। তবে এটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ট্রুডোর জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের একটি প্রচেষ্টা হতে পারে। সাধারণত কানাডিয়ানদের মধ্যে বর্তমানে ভারত বিদ্বেষ তুঙ্গে। কানাডিয়ানরা মনে করছে, ট্রুডোর সময়ে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় অভিবাসী এবং শিক্ষার্থীকে কানাডায় আসতে দেওয়ার ফলে কানাডিয়ানদের জীবনমানের অবনতি হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ভারত নিধন ভূমিকা ট্রুডোর হারানো জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও গত কয়েক মাসে বেড়েছে বলে মনে করেন। 
তবে, পরিস্থিতি এখনো জটিল এবং ট্রুডোর সামনে একটি কঠিন পথ অপেক্ষা করছে। তার সামনে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন এবং কূটনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা; দ্বিতীয়ত, তার দলের অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব সংকট সমাধান করা। এই দুটি বিষয় আগামী নির্বাচনে তার সাফল্যের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করবে। যদি তিনি দক্ষতার সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারেন, তবে তার নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি আবারও ক্ষমতায় আসতে পারে। তবে যদি তিনি ব্যর্থ হন, তবে এটি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আগামী কয়েক মাসে এটিই বিবেচ্য বিষয় যে, ট্রুডো কৌশলগত পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন কিনা! আপাতত দৃষ্টিতে তার অবস্থান দুর্বল, এতটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়। 


২১ অক্টোবর ২০২৪

[email protected]

×