ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

বেটাভোল্ট

নিউক্লিয়ার ব্যাটারি- চলবে অর্ধশতাব্দী

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২২ অক্টোবর ২০২৪

নিউক্লিয়ার ব্যাটারি- চলবে অর্ধশতাব্দী

আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃত

মোবাইল ফোন কিংবা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেলে কি যে বিড়ম্বনা হতো, তা বলে শেষ করা যাবে না। অনেক দূরত্বের যাতায়াতে মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেলে এবং সে সময়টাতে যদি হাতের কাছে চার্জার না থাকে, তাহলে কি রকম পরিস্থিতি হতে পারেÑ ভাবা যায় কি? আবার অনেকদিন ব্যবহার করলে মোবাইল ফোনের ব্যাটারিও আগের মতো কাজ করে না। সেক্ষেত্রে বারেবারে ফোন রিচার্জ করতে হয় কিংবা নতুন ব্যাটারি কিনতে হয়।

প্রয়োজনের সময়ে ফোনে চার্জ না থাকলে এমন বিড়ম্বনায় প্রায় সকলকেই পড়তে হয়। যত দামি ফোনই কিনুন না কেন, ব্যাটারিতে চার্জ না থাকার সমস্যা কমবেশি প্রায় সব সংস্থার ফোনেই আছে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই আবার সঙ্গে ‘পাওয়ার ব্যাংক’ রাখেন। সেটিকেও নির্দিষ্ট সময় অন্তর চার্জ দিতে হয় এবং সেই চার্জটুকু সময় ও সুযোগ মতো দিতে না পারলে একই সমস্যায় পড়তে হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিশ্ব বাজারে আসছে নিউক্লিয়ার ব্যাটারিÑ বেটাভোল্ট। বেজিংয়ের একটি সংস্থা এমনই নিউক্লিয়ার ব্যাটারি আনতে চলেছে বাজারে। যা একবার চার্জ দিলেই ফোন চলবে টানা ৫০ বছর। দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে এই ব্যাটারির আকার হবে ১৫ মিলিমিটার।

পাঁচ মিলিমিটার পুরু এই ব্যাটারিটি বর্তমানে তিন ভোল্টের বিনিময়ে ১০০ মাইক্রোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে এক ওয়াট শক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বেটাভোল্ট। তবে এই ব্যাটারি শুধু মোবাইল ফোনেই নয়, মহাকাশ চর্চার সরঞ্জাম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, মাইক্রোপ্রসেসর, উন্নত সেন্সর, ড্রোন এবং ছোট রোবটেও ব্যবহার করা যাবে। এমনকি পেসমেকারের মতো জীবনদায়ী যন্ত্রে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা যন্ত্রেও ওই ব্যাটারি ব্যবহার করা যাবে নির্দ্বিধায়। অবশ্য, পারমাণবিক শক্তির ব্যাটারি তৈরির কার্যক্রম এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।

প্রাথমিকভাবে স্মার্টফোন ও ড্রোনের জন্য বাণিজ্যিকভাবে এ ব্যাটারি তৈরি করা হবে। নিউক্লিয়ার ব্যাটারির মূল শক্তি হচ্ছে আইসোটোপ এবং এর তেজস্ক্রিয়তা। একে রেডিওআইসোটোপ জেনারেটর নামেও অভিহিত করা হয়, যা তেজস্ক্রিয় ক্ষয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ যেমনÑ প্লুটোনিয়াম-২৩৮ এর ক্ষয় থেকে নির্গত শক্তি ব্যবহার করে। এই ব্যাটারিগুলোর সাধারণত একটি দীর্ঘ জীবনকাল থাকে এবং তেজস্ক্রিয় পদার্থের রিচার্জিং বা প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন ছাড়াই বর্ধিত সময়ের জন্য, প্রায়ই কয়েক বছর বা এমনকি দশকের জন্য একটি স্থির শক্তি সরবরাহ করতে পারে।

ক্ষারীয়, লিথিয়াম-আয়ন এবং সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারিসহ প্রচলিত ব্যাটারিগুলো বৈদ্যুতিক প্রবাহ তৈরি করতে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক টার্মিনালগুলোর মধ্যে ইলেকট্রনের চলাচলের ওপর নির্ভর করে। তারা রাসায়নিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করে এবং একটি সার্কিটের সঙ্গে সংযুক্ত হলে এটি বিদ্যুৎ হিসাবে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ তাদের একটি সীমিত আয়ু থাকে এবং রাসায়নিক শক্তি ক্ষয় হয়ে গেলে রিচার্জ বা প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক ব্যাটারির রক্ষণাবেক্ষণ বা রিচার্জ করার প্রয়োজন ছাড়াই দীর্ঘ সময়ের জন্য অবিচ্ছিন্ন এবং নির্ভরযোগ্য শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম হয় ।

এই গুণাবলির জন্য এই ধরনের ব্যাটারিকে এমন অ্যাপ্লিকেশনগুলোর জন্য উপযুক্ত করে তোলে, যেখানে প্রতিস্থাপন বা রিচার্জিংয়ের কোনো ব্যবস্থা থাকে না। যেমনÑ মহাকাশ মিশন, গভীর-সমুদ্রে অনুসন্ধান বা দূরবর্তী পর্যবেক্ষণ সিস্টেমে, যেখানে গবেষণায় সময় লাগে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, এমনকি অর্ধ শতাব্দীও। বেটাভোল্ট ব্যাটারি এক্ষেত্রে খুবই উপযোগী। 
বেটাভোল্টের এই নিউক্লিয়ার ব্যাটারি ব্যবহারে খুবই নিরাপদ, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব। নির্মাণ সংস্থাটির মতে, ব্যাটারির কাঠামোটি বিভিন্ন স্তরে গঠিত হওয়ায় হঠাৎ আঘাতে এতে আগুন ধরা বা এটি বিস্ফোরিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ৬৩টি আইসোটোপকে একত্রিত করে এমন সূক্ষ্মভাবে ব্যাটারিটি তৈরি করা হয়েছে যে, এর থেকে উৎপাদিত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মানব শরীরেরও কোনো ক্ষতি করবে না। পাশাপাশি এ ব্যাটারি বিশ্বের যে কোনো আবহাওয়া জোনে অত্যন্ত কার্যকর এবং মনানসই হবে। শুধু তাই নয়, হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে শুরু করে ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রায় স্বাভাবিকভাবে কাজ করবে এই ব্যাটারি।

এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পারমাণবিক ব্যাটারিতে থাকে নানা চ্যালেঞ্জ। যেমনÑ তেজস্ক্রিয় পদার্থের সাবধানে পরিচালনা এবং নিষ্পত্তি এবং বিকিরণ এক্সপোজারের সঙ্গে সম্পর্কিত সম্ভাব্য ঝুঁকি। উপরন্তু, পারমাণবিক ব্যাটারির বিকাশ ও উৎপাদনের প্রাথমিক খরচ সাধারণত প্রচলিত ব্যাটারির চেয়ে বেশি। বিপরীতে, তুলনামূলকভাবে কম খরচ, বহনযোগ্যতা এবং ব্যবহারের সহজতর কারণে প্রচলিত ব্যাটারিগুলো বিভিন্ন দৈনন্দিন অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রতিস্থাপন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি কিংবা উচ্চশক্তি প্রয়োগের জন্য কম উপযুক্ত। চীনা কোম্পানিটি তার পারমাণবিক ব্যাটারির ভবিষ্যৎ সংস্করণে বিভিন্ন পারমাণবিক আইসোটোপের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করার পরিকল্পনা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে স্ট্রন্টিয়াম-৯০, প্রোমিথিয়াম-১৪৭ এবং ডিউটেরিয়াম, যা একটি ডিভাইসে দুই থেকে ৩০ বছরের মধ্যে স্থায়ী হতে পারে।
নিউক্লিয়ার ব্যাটারি এবং প্রচলিত ব্যাটারি তাদের শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া, জীবনকাল এবং বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের জন্য উপযুক্ততার মধ্যে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত। পারমাণবিক ব্যাটারি তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে, দীর্ঘ আয়ু থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদি, কম রক্ষণাবেক্ষণ অ্যাপ্লিকেশনের জন্য উপযুক্ত। প্রচলিত ব্যাটারি রাসায়নিক বিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে, একটি সীমিত আয়ু থাকে এবং বিস্তৃত পরিসর বহনযোগ্য এবং স্বল্পমেয়াদি শক্তির প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। যাই হোক, পারমাণবিক ব্যাটারিটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হলে ইলেকট্রনিক যন্ত্র চার্জিংয়ে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এর ফলে চার্জার ও বহনযোগ্য পাওয়ার ব্যাংক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে এবং অতিরিক্ত চার্জ দেওয়ার ফলে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ক্ষতি হওয়ার শঙ্কাও কমে যাবে বহুলাংশে, যা পরিবেশ দূষণ রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।  শুধু স্মার্টফোন কিংবা প্রযুক্তি পণ্যই নয়, বিজ্ঞানীরা বর্তমান বিশ্বের যে কোনো যান্ত্রিক প্রয়োজনে দেখছেন নিউক্লিয়ার ব্যাটারির উপযোগিতা। বর্তমান বিশ্বে অর্থনীতির যে কোনো সেক্টরে জীবাশ্ম বা নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকল্প হিসেবে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় নিউক্লিয়ার ব্যাটারি প্রযুক্তি। জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারবে নিউক্লিয়ার ব্যাটারি। 
নিউক্লিয়ার বেটাভোল্ট আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বে প্রথমবারের মতো সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম পরিসরে পরমাণু শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে চীন। তাদের উদ্ভাবিত ছোট্ট একটি কয়েন সদৃশ এই পরমাণু ব্যাটারি একটি স্মার্টফোনকে একটানা ৫০ বছর লাগাতার প্রয়োজনীয় শক্তি জোগাতে সক্ষম। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ আবিষ্কার যদি সত্যি হয় তাহলে বিশ্বের প্রযুক্তি জগৎ থেকে শুরু করে যে কোনো যন্ত্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় শক্তি জোগানোর পুরো ধারণাটাই বদলে যেতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। আর এ আবিষ্কারের পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন তুরস্কের রণাঙ্গনে নিহত ব্রিটিশ সেনা অফিসার হেনরি মোজলি।

কারণ, ১৯১৫ সালে মৃত্যুর দুই বছর আগে ১৯১৩ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে বিশ্বে প্রথমবারের মতো পরমাণু বা নিউক্লিয়ার ব্যাটারি তৈরির প্রযুক্তির এমন এক ছাপ তিনি রেখে গেছেন, যা তার মৃত্যুর শত বছর পরও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃত।  আধুনিক জ্বালানি ও রাসায়নিক বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, শত কিংবা হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু চুল্লি থেকে কম শক্তি উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কিন্তু ক্ষুদ্রাকৃতির পরমাণু রিঅ্যাক্টর অনেক বেশি নিরাপদ এবং ব্যয় সাশ্রয়ী। এই ক্ষুদ্রাকৃতির পরমাণু রিঅ্যাক্টর নির্মাণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন চীনা কোম্পানি বেটাভোল্টের ক্ষুদ্রাকৃতি নিউক্লিয়ার (এ্যাটোমিক) ব্যাটারি, যা বদলে দেবে ভবিষ্যৎ বিশ্বের প্রযুক্তিকে।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×