ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

বয়স বাড়বে মর্যাদার সঙ্গে

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ২২ অক্টোবর ২০২৪

বয়স বাড়বে মর্যাদার সঙ্গে

২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে ষাটোর্ধ মানুষের সংখ্যা ছয় শ’ মিলিয়ন

২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে ষাটোর্ধ মানুষের সংখ্যা ছয় শ’ মিলিয়ন থেকে দুই বিলিয়ন পর্যন্ত পৌঁছাবে। বলা যায়, অকল্পনীয়ভাবে ষাটোর্ধ মানুষের সংখ্যা বিস্ফোরণের দিকে এগোচ্ছে। এ নিয়ে উন্নত বিশ্বের চেয়ে উন্নয়নশীল বিশ্ব চার গুণ বেশি সমস্যায় পড়বে। 
২০০১ সালে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব বয়স্ক সম্মেলনে তখনকার জাতিসংঘ মহাসচিব এ তথ্য জানিয়েছিলেন। আরও জানিয়েছিলেন, ষাটোর্ধ বয়স্কদের মধ্যে জেন্ডার বৈষম্যের কারণে পুরুষের চেয়ে নারীদের অবস্থা বেশি ভালনারেবল হবে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে। গড় আয়ু বেশি হওয়ায় নারী বয়স্কদের সংখ্যা বেশি হবে অথচ বয়স্কদের মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে কোনো সনদ বা আইন নেই। 
এদিকটি সামনে এনে জাতিসংঘ সিডও কমিটি তাদের ৪২তম অধিবেশনে ষাটোর্ধ নারীদের মানবাধিকার রক্ষায় কমিটি গঠন করে ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর দ্য জেনারেল রিকমেন্ডেশন অন ওল্ডার উইমেন’ নামে। কমিটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে সিডও কমিটির সেসময়ের বাংলাদেশ-সদস্য বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষ, বিশেষ করে নারীরা মানবাধিকার বঞ্চিত জীবনযাপন করেন।

তারা যত বৃদ্ধ হতে থাকেন পরিবারে তত গুরুত্ব হারাতে থাকেন। এখানে আমরা প্রতিবাদ করছি। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এজিং উইথ ডিগনিটি অর্থাৎ বয়স বাড়বে মর্যাদার সঙ্গে। বয়স্করা যেন পরিবারে প্রাপ্য মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারেন। তাঁরা যেন পরিত্যক্ত না হন। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশের কথা আমরা জানি যেখানে বয়স্কদের আপদ মনে করে পুড়িয়ে মারা হয়।’ 
প্রাচ্য মূল্যবোধের দেশগুলোতে এত বীভৎসতা আমরা কল্পনা করতে পারি না। তবে মূল্যবোধ যে অক্ষুণœ রয়েছে তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। পরিবর্তন আমাদের এখানেও শুরু হয়েছে। শারীরিকভাবে পুড়িয়ে না ফেললেও অনেক ক্ষেত্রে মানসিকভাবে দগ্ধ করা হয় বৃদ্ধ স্বজনদের। 
পৃথিবীজুড়ে চিকিৎসা শাস্ত্রের উৎকর্ষ, জীবনমান উন্নত হওয়া ইত্যাদি কারণে গড় আয়ু বাড়ছে। বেড়ে যাওয়া আয়ু যেন তাঁদের জন্য অভিশাপ না হয়, বরং তাঁরা যেন কর্মক্ষম সময় পার করতে পারেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা, আবাসন সুবিধা পান সে বিষয়গুলো নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমাদের দেশে বয়স্ক নারীরা যতদিন কর্মক্ষম থাকেন পরিবারে কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এসব কাজের কোনো স্বীকৃতি তাঁরা পান না। বেশ কিছুকাল ধরে বয়স্ক নারীদের ওপর অন্য ধরনের দায়িত্ব বর্তেছে। দেখা যায় মা-বাবা বিদেশে যাচ্ছেন, সন্তানদের রেখে যাচ্ছেন নানি, দাদি বা খালা, ফুফুদের কাছে। একটি সন্তান দেখাশোনার দায়িত্ব বিশাল। কিন্তু এ কাজের জন্য তাঁদের কোনো মূল্যায়ন হয় না। গ্রাম অঞ্চলে সরকার থেকে বয়স্ক ভাতা হিসেবে যা দেওয়া হয় তা নিতান্ত অপ্রতুল।

তাদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুবিধা নেই। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। বয়সের ভারে যাঁরা বাড়ির বাইরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন না তাঁদের বাড়িতে এসে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রায়ই দেখা যায়, মেনোপজের পর আমাদের দেশের নারীরা পরিবারে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন। যারা চাকরি করেন একটা সময়ে তাঁদের অবসর নিতে হয়। ষাট বছরের পরও অনেকে কর্মক্ষম থাকেন। তাঁরা যাতে তাঁদের কাজ দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারেন সে জন্য সরকার থেকে নানা ধরনের কর্মসংস্থানমূলক কাজের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

সরকার চাইলে তাদের সম্মানসূচক বিভিন্ন কাজ দিতে পারে, যেখানে তাঁরা তাঁদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবেন। এ শুধু আমাদের দেশের জন্য নয়, ইউনিভার্সাল নিড। ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর দ্য জেনারেল রিকমেন্ডেশন অন ওল্ডার উইমেন বয়স্কদের এজ গ্রুপ করেছে। যেমন ষাট থেকে সত্তর বছর পর্যন্ত এক ধরনের নিড আবার সত্তর থেকে আশি বছর বা তার বেশি পর্যন্ত অন্য ধরনের নিড থাকে। বিষয়গুলো সিডও অধিবেশনে জেনারেল রিকমেন্ডেশনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

সিডও কনভেনশনের আলোকে ষোলোটি বিভিন্ন আর্টিক্যালের আওতায় উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে এটি বয়স্ক নারীদের মানবাধিকার রক্ষায় একটি আন্তর্জাতিক দলিল বা আইনে পরিণত হয়। তা হলে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। 
দু’হাজার তেরো সালের সতেরো নবেম্বর ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা’ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়। এরপর জাতীয় অধ্যাপক এম আর খানকে প্রধান করে একটি কোর কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী অ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছে। এতে জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সব ধরনের পরিবহনে কম ভাড়ায় যাতায়াত, হাসপাতালে সাশ্রয়ী মূল্যে আলাদা চিকিৎসাসেবা, আলাদা বাসস্থান সুবিধা ইত্যাদি। কর্মপরিকল্পনার বিভিন্ন দিক আরও বিস্তৃত করেছিলেন  সেসময়ের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব।

তিনি জানিয়েছিলেন, প্রবীণরা সাধারণত যে সব রোগে ভোগেন যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদির চিকিৎসাসেবা দিতে হাসপাতালগুলোতে জেরিয়াটিক মেডিসিন বিভাগ চালু করার জন্য নব্বই লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারিভাবে যেসব আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে, সেখানে প্যারেন্ট রুম থাকবে। প্রবীণরা শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে ও হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখতে পারেন। এ জন্য তাদের সম্মানী দেওয়া হবে। তাঁরা পরিচয়পত্র পাবেন।

নতুন আইন করে তার আওতায় প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন করে জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। শিল্পোন্নত দেশে পঁয়ষট্টি বা তারও বেশি বয়সীদের প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করলেও জাতিসংঘের স্বীকৃতি অনুযায়ী ষাট বা তার বেশি বয়সীরা আন্তর্জাতিকভাবে প্রবীণ হিসেবে বিবেচিত হন। 
বিআইডিএসের পরিসংখ্যানে জানা যায়, উনিশ শ’ নব্বই সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার চার দশমিক আটানব্বই শতাংশ ছিল প্রবীণ জনগোষ্ঠী। জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ অনুযায়ী দু’হাজার পঞ্চাশ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর এই হার হবে শতকরা বিশ ভাগ। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন হবেন প্রবীণ। বিভিন্ন জটিল রোগের প্রতিষেধক বের হওয়া, লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে মানুষের গড় আয়ু ও কর্মক্ষমতা বেড়েছে। তার পরেও প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বার্ধক্য আসবেই। একে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুতিটা তাই রাষ্ট্রীয়ভাবেই থাকা উচিত।

বিশেষ করে আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশে। কেননা বিত্তবানরা বিত্তের সুবাদে অন্তত কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রবীণ বয়সে ভোগ করলেও বিত্তহীনরা অবর্ণনীয় দুরবস্থায় পড়েন। এ শুধু আমাদের দেশে নয়। সব দেশে সবখানে সব কালে বিত্তের ব্যবধানই মানবিক এবং মানবেতর জীবনযাপনের সীমারেখা টেনেছে। 
শিল্পায়ন ও পুঁজিবাদের প্রসার ঘটার যুগে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে অতি ধনী ও অতি গরিব প্রবীণদের মধ্যে ধন-বৈষম্য এক ধরনের প্রবীণতন্ত্র জন্ম দিয়েছিল। উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রবীণরা ক্রমশ রাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। সে সময় প্রবীণদের পক্ষেই সম্পত্তির মালিক হওয়া সম্ভব হতো। যথেষ্ট সম্পত্তি যাদের ছিল তারাই ভোটাধিকার পেত। অন্যদিকে শ্রমশক্তি হারিয়ে গরিব প্রবীণরা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতেন। পুঁজিবাদী দেশগুলোয় বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ‘সায়েন্টিফিক ম্যানেজমেন্ট অব ওল্ড এজ’ নামে প্রবীণদের সেবা দেওয়ার ব্যবস্থাপত্র চালু হয়েছে। যার পেছনে মুনাফার বিশাল চক্র রয়েছে।

প্রবীণদের জন্য ওল্ড ভিলেজ চিকিৎসাসেবা ইত্যাদির জন্য চড়া দামে প্রিমিয়াম নিয়ে জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানের রমরমা ব্যবসা চলে সে সব দেশে। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে প্রবীণদের জন্য সহায়ক নানা উপকরণ বের করে মিডিয়ায় চলে প্রচার যজ্ঞ। এসব উপকরণ ও প্রযুক্তির ভোক্তা যারা হতে পারেন তারা নিজেদের প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুললেও সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। মানবিক সম্পর্কের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়। মানবিক মর্যাদা হারিয়ে টাকার বিনিময়ে শারীরিক আরাম আয়েশ কিনে বেঁচে থাকছেন তাঁরা।

কেনার সামর্থ্য যাদের নেই তাদের দিকে রাষ্ট্র হাত বাড়ায় না। দুরবস্থাই তাদের সঙ্গী হয় শেষ পর্যন্ত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের মূল্য নির্ধারণ হয় তার উৎপাদন ক্ষমতার ওপর। উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় মানুষ হিসেবে তার যাবতীয় মূল্য। হয়তো সে জন্যই শেষ জীবনে কাউন্ট তলস্টয় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান চেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছিলেন। নিজের সব সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়েছিলেন কৃষকদের মধ্যে। এ নিয়ে তাঁর পারিবারিক অশান্তি চরমে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত কিং লিয়ারের মতো ঘর ছাড়েন বৃদ্ধ তলস্টয় এবং মারা যান অখ্যাত এক রেল স্টেশনে। 
শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্র্যাজেডি ‘কিং লিয়ার’-এর রাজা লিয়ার দুই মেয়ের মধ্যে রাজ্য ভাগ করে দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে বিপন্ন হয়ে ঝড়ের রাতে খোলা প্রান্তরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। করডেলিয়া, ঠোঁট কাটা ছোট মেয়েটি, সত্য কথা বলার জন্য যাকে তিনি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন শেষ পর্যন্ত সীমাহীন সহানুভূতি নিয়ে সে-ই এসে উদ্ধার করে বাবাকে। বৃদ্ধ বয়সে যাদের তত্ত্বাবধানে থেকে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করবেন ভেবে সব সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছিলেন সেই দুই মেয়ে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল বাবাকে। সহানুভূতি বা মানবিক বোধ কোনো কিছুই কাজ করেনি তাদের ভেতর।

×