ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৬ কার্তিক ১৪৩১

জনজীবনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২১ অক্টোবর ২০২৪

জনজীবনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব

প্রতিদিনের ভোগ্যপণ্য ক্রেতাদের জীবন ধারণের মূল নিয়ামক

প্রতিদিনের ভোগ্যপণ্য ক্রেতাদের জীবন ধারণের মূল নিয়ামক। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই মানুষকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হয়েছে। প্রাগৈতিহাস থেকে সমকালীন ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতিই ছিল এক অবশ্যম্ভাবী পর্যায়। যখন অবধি আগুনের আবিষ্কারই হয়নি। পশু-পাখির কাঁচা মাংস আদিম মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগান দিত বলে প্রাচীন লেখকদের বর্ণনায় বিধৃত। এক্ষেত্রে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ নৃ-বিজ্ঞানী লুইস হেনরী মর্গানের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করে লিখিত ‘আদিম সমাজ’ বইটির সভ্যতা বিবর্জিত যুগের হরেক রকম যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে খেয়ে বেঁচে থাকার বিষয়টিও বাস্তবসম্মতভাবে পাঠকের সামনে উঠে আসে।

নিত্য দরকারি খাদ্যপণ্য জীবন বাঁচানোর নিয়ামক শক্তি। যা অতি সাধারণ থেকে অনন্য মানুষের জন্যও সর্বাধিক প্রযোজ্য, স্বীকৃত। সে তো বহু যুগ আর কালের প্রাচীনতম ইতিহাসের অনবদ্য দলিল। আর আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ যুগে আমরা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মাঝপথে দাঁড়িয়ে একই বোধে তাড়িত এবং নানামাত্রিক দুর্ভোগ মোকাবিলায় দুর্বিষহ সময় পার করতে ব্যস্ত। এই মুহূর্তে বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশ ও সময়ের বিবেচনায় আমরা সুবিধা আর বিপরীত কিছু আবহকে অতিক্রম করছি। সেখানে সবার আগে সামনে আসছে নিত্য খাদ্যপণ্যের মাত্রাতিরিক্ত মূল্যে জনজীবন নাকাল হওয়ার বিষয়টি। যেন দাবানলের আকালে জীবন বাঁচানোর দরকারি পণ্য ধরাছোঁয়ার বাইরে। যা প্রতিদিনের গণমাধ্যমের সংবাদে এক প্রকার নিয়মনীতি আবর্তিত হয়।

দেশে সাধারণত দ্রব্যমূল্য একবার বাড়লে তা কখনোই পূর্বের অবস্থায় ফেরে না। বরং বাড়তি মূল্যেই এক সময় অভ্যস্ত হতে হয়। পরবর্তীতে আবার যখন ঊর্ধ্বগতি হয় সেটাও কম বিড়ম্বনার নয়। তাও কোনো এক সময় গ্রাহকদের অভ্যস্ত হয়ে যায় যা সামাজিক অব্যবস্থার দুর্বিপাক। বাংলাদেশ এখন সেই দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কৃষিনির্ভর শস্য-শ্যামল সবুজ বাংলাদেশে প্রকৃতির উন্মুত্ত খেলায় নাজেহাল হতেও সময় লাগে না। বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঋতু বৈচিত্র্যের সুন্দর অঞ্চলটির নিত্যনৈমিত্তিক দুর্ভোগ সবই যেন আজ এক সুতায় গেঁথে আছে। সময়মতো বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠে আমরা উষ্ণ আবহাওয়া পেতেও বিলম্ব করি।

আবার বর্ষাকালে বর্ষণের বারিধারা থেকে বঞ্চিত হতেও সময় লাগে না। অন্যদিকে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারায় আমাদের কিছু অঞ্চল প্লাবিত হওয়া সময়-অসময়ের দুর্বিপাক। কার্তিক মাস শুরু হয়ে হেমন্তকালের শিশির ভেজা আবহ আসতে কত সময় পার হবে ভাবতে পারছি না। বৃষ্টি ভেজা পরিবেশে ‘দারুণ অগ্নিবাণ’ একেবারেই অনুপস্থিত। শান্ত, ¯িœগ্ধ প্রতিবেশে একটু আরামদায়ক অনুভূতি প্রকৃতির সন্তানদের সত্যিই মাতিয়ে দিচ্ছে। প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশের সঙ্গে খাদ্য পণ্যের যোগ-বিয়োগও নৈসর্গ্যরে চিরায়ত লীলাখেলা। তার ওপর আছে সামাজিক দুর্বিপাকের নানামাত্রিক অনিয়ম। প্রকৃতিঘনিষ্ঠ বাংলাদেশে সব কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, বরং সমাজপতিদের ছাঁচে আবৃত আর এক বিপন্নতার কাল। বরাবরই খাদ্য পণ্যের ওপর সিন্ডিকেটের প্রভাব নতুন কোনো আলামত নয়। সেটাও যুগ-যুগান্তরের চলে আসা চিরস্থায়ী প্রতাপ।

গণমাধ্যমের বিভিন্ন সংবাদে উঠে আসছে হরেক প্রাকৃতিক সংহারে আবহমান বঙ্গভূমির চরম বিপাক। অতিবৃষ্টিতে পানিতে ভেসে যাওয়া শস্য ক্ষেত্রের সর্বনাশ আর অনাবৃষ্টিতে যে খরার আকাল সেখানেও শস্য ক্ষেত্রের চরম ক্ষতি দেখে সহ্য করার মতো নয়। তেমন প্রকৃতির লীলাযজ্ঞে সমাজের বিত্তবানদের যে অশনি সংকেতের অপছায়া সেখানেই নাকি আরও বেশি জিইয়ে থাকে দ্রব্যমূল্যের সংকট, ঊর্ধ্বগতি কিংবা অধোগতি।

খাদ্যপণ্যের সংকট আসলেই অদৃশ্য। কারণ বর্ধিত দামে বিভিন্ন পণ্য আবার বাজারে পাওয়াও যাচ্ছে। কারসাজিটা কোন্ অতল গহ্বরে? সব সময় উঠে আসা প্রশ্নটির উত্তর অজানাও নয়। তবে তা অদৃশ্য শক্তি ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে দেয়। ক্রান্তিকালে পেঁয়াজকা-ে নয়-ছয় দেখে অস্বস্তিতে পড়েছি। মূল্য আজ অবধি না কমাও সিন্ডিকেটের দুর্দান্ত প্রতাপ। 
ইতোমধ্যে বাজারে আসতে শুরু করেছে শীতকালীন সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর শাকসবজি। কিন্তু ক্রেতাদের মাথায় হাত। প্রতিদিনের হিসাব নিকাশে কোনো কিছুর কুলকিনারা না পাওয়াও আর এক বেসামাল অস্থিরতা। সবজির জন্য রবি মৌসুম এক স্বস্তিকর আবাদযোগ্য সুবর্ণ সময়। এই মৌসুমেই শুরু করা হয় শীতকালীন সবজির আবাদ। মাসটি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। বীজ বোনা থেকে কীটনাশক ছিটিয়ে ফসলের খেতকে উপযোগী করা হয় চাষাবাদের মহতী উদ্যোগে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে এসে যায় শীতকালীন সবজি।

তখন সারা বছরের কিছু সবজি লাউ, মিষ্টি কুমড়া, পেঁপে, আলু এ সবের দামও কমতির দিকে থাকে। কিন্তু শিম, ফুলকপির বাজার এখন আকাশছোঁয়া। সেখানে মিষ্টি কুমড়ার মতো সস্তা খাদ্য পণ্যটিও ক্রেতাদের নাগালের মধ্যেই থাকছে না। এমন অপদৃশ্য সব সময় সাধারণ নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের জন্য সুখকর আর স্বস্তিদায়ক নয়। যেখানে আয় রোজগারই বাড়ে না সেখানে প্রতিদিনের খাদ্য মূল্যে গ্রাহককে যে বাড়তি মূল্য দিতে হয় পরবর্তীতে তা পোষানোরও কোনো সুযোগ থাকে না। কৃষকদের বক্তব্যে উঠে আসছে রবি মৌসুমের আগেই তারা আগাম কিছু সবজি বাজারে নিয়ে আসে।

কিন্তু এবার অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যায় সবজির খেত তলিয়ে যাওয়ায় তাদের আয় রোজগারেও ভাটা পড়তে শুরু করে। মূল সম্যাটাই এখানে। কৃষক যথার্থ দাম পাচ্ছে না, যাদের হাড় ভাঙ্গা আর উদয়াস্ত পরিশ্রমে বাংলার শ্যামল সবুজ প্রান্তরে সোনা ফলে। অন্যদিকে গ্রাহকরাও ন্যায্যমূল্যে পণ্যদ্রব্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণি মুনাফা লুটে নিচ্ছে। আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষণ বারবার পানির ঢল নামাচ্ছে ভাদ্র-আশ্বিনে। যা সাধারণত শুষ্ক এক পরিবেশকে জনসম্মুখে স্বাচ্ছন্দ্য আর অবারিত করে। এবার তার পুরো উল্টো চিত্র।

প্লাবনে নষ্ট হয়ে যাওয়া ফসল নতুন করে বপন-রোপণ করতে হচ্ছে খোদ কৃষককেই। সেখানেই তার লাভ লোকসানের হিসাবও গরমিলের পর্যায়ে। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হাজারো কৃষকের শ্রমে ও অর্থে গড়া ফসলি খেত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সামনে অপেক্ষা করছে বোরো মৌসুম। ফসলের বীজ ফেলার আর এক সুবর্ণ সময় তো বটেই। সংশ্লিষ্ট কৃষকদের সময় কাটছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায়। শীতকালীন সবজির পরম সুসময়ে কৃষকের মাথায় হাত। চাষাবাদে বিনিয়োগ করা অর্থ উঠে আসবে কি না তাও এক অসহনীয় দুশ্চিন্তা।

আসলে এবার অসময়ে, অকালে অতিবৃষ্টি আর বন্যার কারণে আবাদি ফসলের যে সমূহ সর্বনাশ তার দাম গুনতে হচ্ছে একদিকে খোদ কৃষককে, আর অন্যদিকে অসহায়, বিত্তহীন, অতি সাধারণ মানুষকেও। কিন্তু মাঝখানে মুনাফা লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্ব¡ভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণি। এই শ্রেণিতেই আবার লুকিয়ে আছে সিন্ডিকেট। যাদের দোর্দ- প্রতাপে কৃষক থেকে অতি সাধারণ গ্রাহক তটস্থ, দিশেহারা। আমরা ইতোমধ্যে তা প্রত্যক্ষ করেছি ঝাল কাঁচামরিচের ঝাঁঝালো উৎপাত। সামান্য হাতবদলের হেরফেরে তা কোনো এক সময় ৬০০ টাকাও ছাড়িয়ে যায় বলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের অভিযোগ।

যতই দাম বাড়ুক টাকা দিলেই অধরা পণ্যটি আবার পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট পণ্যের আসলে সংকট তো নেই-ই বরং মুনাফার আকাক্সক্ষায় তার কোনো নির্দিষ্ট মূল্য থাকছে না। যেভাবে যেখানে সম্ভব হচ্ছে, দুর্ভেদ্য সিন্ডিকেট সব নিজের কব্জায় আনতে কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করছে না। মাঝখানে সর্বশান্ত হচ্ছে খোদ কৃষক সমাজ আর শেষ অবধি অতি সাধারণ গ্রাহকরা। এই মুহূর্তে বাজার অস্থিরতায় যে ডিম নিয়ে কারসাজি সেটাও নিত্যপণ্যের বাজারে আর এক অস্থিরতা। কোনো এক সময় শিশু থেকে বয়স্করা পর্যন্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ এই দরকারি পণ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। শুধু কি তাই? বাজার থেকে উধাও হয়ে যাওয়া ডিমকা- আরও কতদূর গড়াবে সেটা সময়ের বিবেচনা।

তবে বিশেষ করে চট্টগ্রামে মৌসুমি সবজির খেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পুনরায় আবাদ করতে লোকসান গুনতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের। বরাবরই ক্ষতির মুখোমুখি হলেও বর্গা নেওয়া কৃষকদের জমির মালিক তাদের আসল লভ্যাংশ তুলে নিতে কোনো কিছুকে আমলে নেয় না। তাই শীতকালীন সবজির এমন ভরা মৌসুমে গ্রাহকও হিমশিম অবস্থায় ঊর্ধ্বগতির প্রকোপে। কিন্তু মূল বাজার পরিচালনা করে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অবিচ্ছেদ্য চেইন। যা অনতিক্রম্য, দুর্ভেদ্য আর ধরাছোঁয়ার বাইরে। তথ্য উপাত্তে উঠে আসছে গত শরৎ মৌসুমে চট্টগ্রামে ৮০০ হেক্টর জমি চাষ করা হয়েছিল।

এবার তা বেড়ে ৮১০ হেক্টর জমিতে শাকসবজির চাষ করা হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে এবার উৎপাদন মোটেও বাড়বে না। বরং তা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রকার শাক, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, ঢেঁড়শ, শিম ও করলা। অনেক কৃষক ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ করেছেন সবজির আবাদে। কিন্তু বিক্রি করার পর হাতে এসেছে মাত্র বারো হাজার টাকা। এমনভাবেই হিত আর বিপরীত পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়ে উৎপাদিত ফসলের মূল্যে লোকসান গুনতে হয় দরিদ্র কৃষককে। মাঝখান থেকে ফায়দা আর মুনাফা কব্জা করছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। 

লেখক : সাংবাদিক

×