ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৬ কার্তিক ১৪৩১

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আগামীর চ্যালেঞ্জ

মো. হেদায়েত উল্লাহ তুর্কী

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ২১ অক্টোবর ২০২৪

আগামীর চ্যালেঞ্জ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

শত সীমাবদ্ধতা এবং সীমিত ক্যাম্পাস নিয়ে দুর্বার গতিতে আপন লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে পুরান ঢাকা তথা বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজকের জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়। বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির বয়স আঠারো পেরিয়ে উনিশে পড়লেও প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত বয়স একশ’ পঞ্চাশ বছরের বেশি। সম্ভবত এটিই বিশে^র একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেটি পাঠশালা থেকে পর্যায়ক্রমে স্কুল-কলেজের গ-ি পেরিয়ে রূপান্তরিত হয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৬৮ সালে জগন্নাথ রায় চৌধুরী জগন্নাথ স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন।

বালিয়াটির (মানিকগঞ্জ) জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরীর মধ্যম পুত্র (জগন্নাথ রায় চৌধুরীর তিন সন্তান ছিলেন) কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ১৮৮৪ সালে এটিকে কলেজে রূপান্তরিত করে নামকরণ করেন জগন্নাথ কলেজ। তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য এবং সহযোগিতা করেছিলেন অনাথবন্ধু মল্লিক, আইনজীবী ত্রৈলোক্যনাথ বসু ও বিচারপতি সারদাচরণ মৈত্র। জগন্নাথ কলেজ মাত্র ৪৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। জগন্নাথ কলেজের সুনাম ছড়িয়ে পড়লে সন্তোষের জমিদার রাজা মন্মথ রায় চৌধুরী কলেজ কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে টাঙ্গাইলের প্রমথ-মন্মথ কলেজটিকে জগন্নাথ কলেজের সঙ্গে যুক্ত করেন।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জন্মলগ্নে তার সূতিকাগৃহে যে দুটো কলেজ তাদের পুষ্টি, সাহচার্য ও সেবা দিয়ে পালন করেছিল, তার একটি হলো জগন্নাথ কলেজ এবং অপরটি ঢাকা কলেজ। জগন্নাথ কলেজ তার ছাত্র, শিক্ষক, বই-পুস্তক ইত্যাদি দিয়ে সেদিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে তার হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থা থেকে উত্তরণে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা কলেজের ডিগ্রি ক্লাসের সমস্ত ছাত্র নিয়ে ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের। জগন্নাথ কলেজ পূর্ববাংলায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করতে গিয়ে নিজে ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েড কলেজে পরিণত হয়। 
কালের পরিক্রমায় এটি সরকারি জগন্নাথ কলেজ, সরকারি জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় কলেজ এবং ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ মহান জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার মাধ্যমে পরিপূর্ণ বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে পথচলা শুরু করে। পথচলার শুরুর দিকটা এতটা মসৃণ ছিল না। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় আইন ২০০৫ এর ২৭ (৪) ধারা মোতাবেক এটি পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। এই ধারায় উল্লেখ ছিল, বিশ^বিদ্যালয়টি তার নিজস্ব আয় থেকে ব্যয় করবে। যার ফলে প্রথমদিকে অনেক শিক্ষক চাকরির অনিশ্চয়তার কারণে বিশ^বিদ্যালয়ে যোগদান করেননি এবং তৎকালীন কলেজের প্রায় সকল শিক্ষকই বিশ^বিদ্যালয় ছেড়ে অন্য সরকারি কলেজে যোগদান করেন।

২০১২ সালে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে ২৭(৪) ধারা বাতিল হলে এটি একটি পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে পথ চলা শুরু করে। ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় আইন বলে পূর্বতন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য হয়। তাদের নিয়ে অল্প কয়েকটি বিভাগের মাধ্যমে বিশ^বিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম চালু হয়। পরবর্তীতে যুগোপযোগী অনেক বিভাগ খোলা হয়। সংগীত, চারুকলা, নাট্যকলা বিভাগ খোলার মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়কে পুরান ঢাকার সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত করা হয়।

পহেলা বৈশাখে পুরান ঢাকার প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে এ কর্মকা- পরিচালিত হয়ে থাকে। স্বল্প সময়ে বিশ^বিদ্যালয়টি আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসব আয়োজন করে বিশে^র সংগীতপ্রেমীদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়ে সাতটি অনুষদে ৩৯টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউটে ১৫ হাজার ৯৬০ শিক্ষার্থী, ৬৭৮ জন শিক্ষক ও প্রায় ৭০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন।

একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি মেধাবিকাশের জন্য রয়েছে সাংস্কৃতি কেন্দ্র, আবৃত্তি সংসদ, চলচ্চিত্র সংসদ, ডিবেটিং সোসাইটি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, আইটি সোসাইটি, রঙ্গভূমি, সায়েন্স ফিকশন সোসাইটি, ফিল্ম ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, মাইম সোসাইটি ইত্যাদি। সেবামূলক সংগঠন হিসেবে রয়েছে বাঁধন, রোভার স্কাউটস, রেঞ্জার ইউনিট, বিএনসিসি। সবার আগে বিশ^বিদ্যালয়ের খবর সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রয়েছে সাংবাদিক সমিতি, রিপোর্টার্স ইউনিটি, প্রেস ক্লাবসহ নানা মাধ্যম।  
জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বর্তমান সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের চাকরির পরীক্ষায় প্রথম সারিতে অবস্থান করছেন এ বিশ^বিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থীরা। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কৃতী শিক্ষার্থীরা তাদের অর্জিত জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগের মধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী এবং গবেষক হিসেবে সুযোগ করে নিয়েছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনে বরাবরই সরব উপস্থিতি রয়েছে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের। 
সবচেয়ে বড় আশার জায়গা হলো, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করছেন। এই সকল মেধাবী শিক্ষকের হাত ধরেই আগামীর চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত হচ্ছে আগামীর প্রজন্ম। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ছে মেধা। জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ সকল রাজনৈতিক কর্মকা-ে জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। খাতা-কলমের হিসেবে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের বয়স ১৮ পেরিয়ে ১৯ হলেও এর আবেগের বয়স ১৫০ বছর।

সে জন্য এখনো বিশ^বিদ্যালয়ের যে কোনো অনুষ্ঠানে ছুটে আসেন কলেজ আমলের শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন বিভাগের এলামনাই গঠনে কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমন্বয় দেখা যায়। বলা যায়, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের বয়স একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা মাত্র কিন্তু এর আবেগ-ভালোবাসা অপরিসীম। সীমিত ক্যাম্পাস, জায়গার অপ্রতুলতা, নানা সীমাবদ্ধতা, গবেষণাগারের অভাব, ছাত্রহলবিহীন একটা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়কে একটি বিশ^মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার জন্য। আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়। আজকের শিক্ষার্থীদের হাত ধরে একদিন বিশ^মঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

×