ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৬ কার্তিক ১৪৩১

তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও জনগণের অধিকার

ড. মো. আবু তাহের

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ২১ অক্টোবর ২০২৪

তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও জনগণের অধিকার

ড. মো. আবু তাহের

সুইডেনে তথ্য আইন পাসের মধ্য দিয়ে তথ্যে জনগণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৭৭৬ সালে। অথচ বাংলাদেশ তথ্য অধিকার আইন পাস হয় ২৯ মার্চ ২০০৯ সালে। তথ্য অধিকার আইন জারির আগে ২০০৮ সালের ২৪ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ ২০০৮ জারি করলেও তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন, আপিল ও অভিযোগ দায়ের সংক্রান্ত মূল তিনটি ধারা স্থগিত রাখা হয়।

পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ২৯ মার্চ  নবম জাতীয় সংসদে তথ্য অধিকার আইন পাস হয় এবং রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়ে পহেলা জুলাই ২০০৯ থেকে কার্যকর  হয়। উক্ত আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পহেলা জুলাই ২০০৯ গঠন করা হয় তথ্য কমিশন। 
উক্ত আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছেÑ
১. তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত হলে জনগণের চিন্তা, বিবেক ও স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়; ২. জনগণ রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক; তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়; ৩. জনগণের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত হলে সরকারি ও সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংগঠনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। 
তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ নিশ্চিত করেছে যেÑ
১. নাগরিক যে কোনো প্রয়োজনে তথ্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনের মাধ্যমে চাইতে পারে;
২. উক্ত আইনের ধারা-৭ এর আওতাবহির্ভূত সকল তথ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সকল কর্তৃপক্ষকে চাহিত তথ্য জনগণকে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে;
৩. তথ্য সরবারের কাজ সহজাত এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য যথাযথ তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে;
৪. আইনের লঙ্ঘনের জন্য রয়েছে জরিমানা ও শাস্তির বিধান। 
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে এবং ৩৯(২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ  সংঘটনে  প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। জনগণের তথ্য অধিকার এই মৌলিক অধিকারসমূহের অবিচ্ছেদ্য অংশ। 
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক।’ কাজেই জনগণের সার্বিক কল্যাণ সুনিশ্চিতকরণের জন্য তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। 
একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের ক্ষমতায়ন আবশ্যক। জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। তথ্যে নাগরিকের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হলে রাষ্ট্রে জনগণের সত্যিকার অর্থে মালিকানাসহ ক্ষমতায়ন সুনিশ্চিত হয়। 
চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই অধিকারসমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারণে তথ্য অধিকারকে চিন্তা, বিবেক ও স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তথ্য অধিকার আইনে নির্ধারিত বাধানিষেধ ব্যতীত দেশের প্রতিটি কর্মকা-ের তথ্য চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বা স্বপ্রণোদিতভাবে জনগণকে জানানোর বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। 
তথ্য অধিকার আইনটি নাগরিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, যা ব্যবহার করে একজন নাগরিক কাক্সিক্ষত তথ্য পেতে পারেন এবং তার ন্যায্য সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত হতে পারেন। অন্যদিকে, তথ্য প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে তার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা ও অবিশ্বাস দূর করে জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। এভাবে সেবাদাতা ও সেবা গ্রহীতার মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি হয়, যা গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 
জনসেবা কার্যক্রম ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, তার জন্য বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না, কোনো গাফিলতি, অনিয়ম বা দুর্নীতি রয়েছে কি না, তা নিজ অবস্থানে থেকে জনগণের স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়াটা হচ্ছে স্বচ্ছতা। তথ্য না পেলে জনগণ এসবের কিছুই জানতে পারে না। সব তথ্য জানলে জনগণের  সামনে সব কাজ, সব খরচের তথ্য স্পষ্ট হয়।  নিজের অবস্থান থেকে জনগণ সবকিছুর ওপর নজরদারি করতে পারে।

উপরন্তু, তথ্য পাওয়ার মাধ্যমে জনগণ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। জনগণ তথ্য জানলে তার প্রাপ্য সেবা ও অধিকার মিলিয়ে নিতে পারে। কোনো ঘাটতি থাকলে তা আদায়ে সচেষ্ট হতে পারে। কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হলে সে ব্যাপারে সোচ্চার হতে পারে। আবার, তথ্য অধিকার আইনের আওতায় বরাদ্দকৃত অর্থ, দায়িত্বপ্রাপ্ত ও সম্পাদিত কাজের হিসাবসহ সব তথ্য জনগণকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করা এ আইন দ্বারা অনেকাংশে সহায়ক হয়।
এভাবে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ সবকিছুর ওপর গণনজরদারি প্রতিষ্ঠাসহ আগামীতে দুর্নীতি কমিয়ে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরও জোরালো ভূমিকা রাখবেÑ এটাই প্রত্যাশা। 

লেখক : অধ্যাপক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×