ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৬ কার্তিক ১৪৩১

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ’২৪-এর ফল ও প্রত্যাশা

মো. ইকরামুল হক

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ২১ অক্টোবর ২০২৪

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ’২৪-এর ফল ও প্রত্যাশা

উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষা ’২০২৪-এর ফল প্রকাশিত হয়েছে

গত ১৫ অক্টোবর সারাদেশের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষা ’২০২৪-এর ফল প্রকাশিত হয়েছে। পাসের হার গড়ে ৭৭.৭৮ শতাংশ (দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার)। মাদ্রাসা বোর্ডে এককভাবে পাসের হার ৯৩.৪ শতাংশ এবং কারিগরিতে ৮৮.০৯ শতাংশ। সাধারণ শিক্ষায় ৯টি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হারে ভিন্নতা রয়েছে। তবে পাসের হার বিবেচনায় সবচেয়ে এগিয়ে সিলেট শিক্ষা বোর্ড (গড় পাসের হার ৮৫.৩৯ শতাংশ)। ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে (২০২৩ সালে মোট জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৯২,৩৬৫ জন এবং এ বছর জিপিএ ৫ পেয়েছে ১,৪৫,৯১১ জন)।

এতদসত্ত্বেও পাসের হার কমেছে (গত বছর পাসের হার ছিল ৭৮.৬৪ শতাংশ এবং এ বছর পাসের হার হলো ৭৭.৭৮)। উল্লেখ্য, গত জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে বিগত স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন সংঘটিত হয়, সে কারণে ২০২৪ সালের পরীক্ষার্থীরা তাদের সকল বিষয়ের পরীক্ষা (ব্যবহারিক পরীক্ষাসহ) দিতে পারেনি। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে ৬ বিষয়ের ওপর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিষয়গুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি, পদার্থ/ যুক্তিবিদ্যা/ হিসাববিজ্ঞান।

স্বৈরাচার পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলো নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পরীক্ষা না নিয়ে তাদের ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। অনুষ্ঠিত বিষয়গুলোর লিখিত পরীক্ষার ফল এবং যে সকল বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি, সেগুলোকে এসএসসি পরীক্ষার ফলের সঙ্গে বিষয় ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশ করা হয়। 
নিশ্চিত করে বলা যায়, এই সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের বিষয়টি সাধারণের বোধগম্য নয়। এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগে পড়ার নজির ভূরিভূরি। তাদের সাবজেক্ট ম্যাপিং কী করে হলো, আমাদের জানা নেই। বোর্ড থেকে কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছে বলে মনে হয় না। ফলে, বিভ্রান্তির অবকাশ থেকেই যায়। মনে রাখা দরকার, এই শিক্ষার্থীরা মহামারি করোনাকালে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। অর্থাৎ ২০২০ সালে নবম শ্রেণিতে এবং ২০২১ সালে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করে।

ফলে, ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষাও পূর্ণাঙ্গ বিষয় ও সিলেবাস অনুযায়ী দিতে পারেনি। এতে স্বাভাবিক পরিস্থিতির মতো শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি। যদি স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকত, তাহলে ফল যে ভিন্নরূপ হতো, এতে কোনো সন্দেহ নেই। উদাহরণস্বরূপ, বিগত কয়েক বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল দেখে বলা যায়, সিলেট বোর্ড প্রায়ই নিচের দিকে থাকত। এবার রয়েছে সবার ওপরে। বন্যার কারণে সিলেট বোর্ডের ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে, ইংরেজিতে সবাই পাস করেছে ধরা হয়েছে (প্রাপ্ত নম্বর হেরফের হতে পারে এসএসসির ফলের ওপর ভিত্তি করে)। আমাদের দেশের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কমবেশি ২৫% শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। যা এবার সিলেট বোর্ডের ক্ষেত্রে হয়নি।

তাই সকল বোর্ডের চেয়ে সিলেটে পাসের হার সর্বাধিক। এর ফলে, সিলেট ব্যতীত বাংলাদেশের সকল সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে ফল পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চত্বরে ইতোমধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। 
শেষে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি একরকম সমর্থন জানিয়ে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন যৌথ বাহিনীর সহায়তায়। প্রায় একই অবস্থা অন্য শিক্ষা বোর্ডগুলোতেও। আন্দোলনকারীদের দাবি হলো, প্রকাশিত ফল বাতিল করে নতুনভাবে ফল তৈরি ও প্রকাশ করতে হবে এবং তা হতে হবে শুধু সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে। এর মানে হলো, সবাইকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করতে হবে। সম্ভবত জিপিএ নির্ধারিত হবে এসএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে। কিন্তু এর শেষ কোথায় আমাদের জানা নেই। সমাধান যাই হোক না কেন, সামগ্রিক ঘটনা প্রবাহ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সুখকর নয়Ñ এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। 
এ বছর ৩০ জুন উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষা শরু হয় সারাদেশে একযোগে। সাবেক সরকারকে হঠাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দেলনের কারণে প্রায় একমাস পরীক্ষা স্থগিত ছিল। দেশ যখন মুক্ত হলো তখন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার পরও পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনীহার কারণে। এটা সিংহভাগ পরীক্ষার্থীর দাবি ছিল কিনা তাতে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিক্ষোভকারীদের চাপের মুখে পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও পছন্দ করেননি। এভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে মূল্যায়িত হওয়া ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক।

ইতোমধ্যে স্নাতক (পাস) শ্রেণির শিক্ষার্থীসহ আরও কিছু শিক্ষার্থীও পরীক্ষা না দিয়ে ফল প্রকাশের দাবি তুলেছেন। এ অপসংস্কৃতি থেকে যত তাড়াতাড়ি বের হওয়া যায় ততই মঙ্গল। কোমলমতি এ সকল শিক্ষার্থীই জাতির ভবিষ্যৎ। এ বছরই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করবে। শিখন ঘাটতি নিয়ে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করলে শিক্ষা জীবন শেষে এসব দুর্বলতা রয়ে যাবে বা শিক্ষাজীবনে ছেদ পড়বে বলে শিক্ষাবিদদের ধারণা।
এমনিতেই আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনার বিষয়টি সবারই জানা। বলে রাখা ভালো, সদ্য প্রকাশিত ফলে দেখা যায়, ৬৫টি কলেজ হতে একজন পরীক্ষার্থীও উত্তীর্ণ হতে পারেনি। অর্থাৎ পাসের হার শূন্য। যা ২০২৩ সালে ছিল ৪২টি কলেজের ক্ষেত্রে। এ থেকে বোঝা যায় যে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার দুরবস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার সুদীর্ঘ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলে রাখি, এ জাতীয় ক্ষেত্রে কেউ দায়িত্ব নেয় না বা এ সকল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা ছাড়া কোনো কার্যকর বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয় না। যার ফলে, শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়/বোর্ডগুলো যাচাই বাছাই না করে যত্রতত্র এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের অনুমতি দেওয়া ছাড়াও কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তও করা হয়েছে। এতে রাষ্ট্রের অর্থ এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সময় এবং অর্থ দুটোরই অপচয় হচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিকে আইসিটি নামক একটি আবশ্যিক বিষয় রয়েছে। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিষয়টিতে ফেল করে। সরকারি কিছু কলেজ ব্যতীত অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এটির বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই। ফলে, ভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক অথবা অতিথি শিক্ষক দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে বছরের পর বছর। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিশ্চিত না করে কিভাবে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়ের কার্যক্রম চলছে, তা বোধগম্য নয়।

অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার সময় বিষয়টি নিয়ে বেশ বিপাকে ছিলাম। বিশেষ করে মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে সমাধানের পথ বের করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমাদের দেশে বাস্তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রম মনিটরিং অথবা পরিদর্শনের কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর থাকলেও মূলত প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। অদ্যাবধি এ সকল পরিদর্শন প্রতিবেদনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ব্যবস্থ্ াউন্নয়নের জন্য কোনো কার্যকর সুপারিশ করেছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

বরং প্রতিষ্ঠানটির কর্মকা- সম্পর্কে নানা মুখরোচক গল্প প্রচলিত রয়েছে। শিক্ষা প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, একটি মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজন দক্ষ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ, সুযোগ্য প্রতিষ্ঠান প্রধান নির্বাচন/নিয়োগ, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক এবং তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ। প্রতিষ্ঠানগুলোকে আনতে হবে জবাবদিহির আওতায়। এই সব সূচকের গতি স্থির অথবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নি¤œমুখী। জাতি হিসেবে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইলে প্রথমেই হাত দিতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের কাজে। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা যেমন শিক্ষা খাতে কাক্সিক্ষত বাজেট বরাদ্দ দিতে পারিনি, ঠিক তেমনি সুশৃঙ্খল শিক্ষা ব্যবস্থাপনা তৈরিতেও আমরা পিছিয়েছি বারবার।

অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা অধিক দলীয়করণ এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দক্ষ ব্যক্তিদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সম্প্ক্তৃ না করা এর অন্যতম কারণ। জাতির সকল সংকটে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে শিক্ষার্থীরা। তাদের স্বার্থসংরক্ষণে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। কোনোভাবেই যেন শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফসল হিসেবে আমরা একটি অন্তর্বর্তী সরকার পেয়েছি, যারা রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। এটা চলমান ও সার্থক হোক, এটাই প্রত্যাশা।

কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, প্রায় ১০টি খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অদ্যাবধি শিক্ষা সংস্কার বিষয়টি অধরাই রয়ে গেছে। বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা শুধু নোবেল বিজয়ী নন, তিনি একজন প্রতিথযশা শিক্ষকও বটে। তার কাছে আমাদের প্রত্যাশাÑ অচিরেই একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থায় দৃশ্যমান যুগান্তকারী ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হবে। 
লেখক : অধ্যাপক (অব.), শিক্ষাবিদ

×