ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

মণিপুরে সহিংসতার নেপথ্যে

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২১:১৩, ২০ অক্টোবর ২০২৪

মণিপুরে সহিংসতার নেপথ্যে

গত দেড় বছরেরর বেশি সময় ধরে সংঘাতে জর্জরিত মণিপুর  রাজ্যে

গত দেড় বছরেরর বেশি সময় ধরে সংঘাতে জর্জরিত মণিপুর  রাজ্যে শান্তি ফেরাতে সেখানে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে বলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সকল পক্ষ যদি সমঝোতায় পৌঁছায়, শুধু তাহলেই মণিপুরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব।

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত সাতটি রাজ্যের অন্যতম একটি হচ্ছে মণিপুর। বাংলাদেশের সিলেট থেকে পূর্বদিকে অসমের শিলচর জেলা পার হলেই মণিপুর রাজ্যের শুরু। বাংলাদেশের সঙ্গে মণিপুরের সীমান্ত না থাকলেও মণিপুরের পূর্বাংশে মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। ওই সীমান্তেও যথেষ্ট অস্থিরতা বিদ্যমান। প্রকৃতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় মণিপুরে আদিকাল থেকেই বিভিন্ন  জাতিগোষ্ঠীর বসবাস।

পাহাড়ি ও সমতলের আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরেই একত্রে বসবাস করে আসছে। তারা মূলত সিনো-তিব্বতি জাতিগোষ্ঠীর। তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। ১৯৪৯ সালে এটি ভারতের অংশ হয়েছিল। মণিপুরে সংঘাত নতুন কোনো ঘটনা নয়। কয়েক দশক ধরে রাজ্যটি বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা, একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় ও প্রান্তিক এই জনপদে দশকের পর দশক ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, জাতিগত সহিংসতা, প্রান্তিকীকরণের রাজনীতি সেখানকার মূল সংকট হিসেবে রয়েই গেছে।

ধারাবাহিক সরকারগুলো রাজ্যে সংঘাতের মূল কারণটি খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে; যা ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতাসীনদের নিকট হয়েছে অবহেলিত। মণিপুর যারা শাসন করছেন, তাদের রাজনৈতিক অপরিপক্বতায় ধারাবাহিক সরকারের সমষ্টিগত ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। এদিকে মণিপুরের কংগ্রেস এমপি ও জওহরলাল নেহরু বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ বিমল আকৌজাম মন্তব্য করেছেন, ভারত সরকার মণিপুরকে ক্রমে আফগানিস্তানের মতো একটি ‘ব্যানানা রিপাবলিক’ অর্থাৎ, রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল এবং আইনশৃঙ্খলাহীন রাজ্যে পরিণত করার চেষ্টা করছে। 
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সহিংসতার এক বছরের বেশি সময় পার হলেও, সেখানে শান্তি এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। মণিপুরের ৩৬ লাখ জনগোষ্ঠীর ৫৩ শতাংশই মেইতেই জনগোষ্ঠীর সদস্য; যারা মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বী। কাগজে-কলমে মণিপুর একটি রাজ্য হলেও বস্তুত দুটি রাজ্য। চুরাচাঁদপুর, ফেরজওয়াল ও কাংপোকপি জেলাগুলো নিয়ে একটি রাজ্য; যা রয়েছে কুকিদের নিয়ন্ত্রণে। অন্যটি হচ্ছে টেংরোপাল জেলা; যা কুকি-জোমি ও নাগা জনগোষ্ঠীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

তবে সেখানে পৃথক প্রশাসন চালায় কুকি-জোমিরা। সেখানে সরকারি চাকরিতে কোনো মেইতি নেই। কারণ, কুকি-জোমিরা এমন রাজ্য চায় না; যেখানে মেইতিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হোক। আবার মেইতিরা মণিপুরের পরিচয় ও আঞ্চলিক অখ-তা চায়। এগুলো নিয়েই মূলত মণিপুরে সম্প্রদায়গত বিভেদ বিদ্যমান রয়েছে। মণিপুরে মেইতেই এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে বিভেদ; তা মূলত রাজনৈতিক এবং ভৌাগোলিক। দুই পক্ষের মধ্যকার উত্তেজনা দীর্ঘদিনের এবং ভূমি অধিকার, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে এই বিভেদ চলছে।

কয়েক মাস শান্ত থাকলেও গত ১ সেপ্টেম্বর নতুন করে সহিংসতা আরম্ভ হয়। ড্রোন ও রকেট হামলায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ চলেছে। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভও শুরু হওয়ায় মণিপুরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাজভবনের দিকে যাওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষের একদিন পর মণিপুরের গভর্নর লক্ষ্মণ প্রসাদ আচার্য ১১ সেপ্টেম্বর অসমের গুয়াহাটির উদ্দেশে ইম্ফল ত্যাগ করেন।
মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থতার জন্য আন্দোলনকারীরা ডিজিপি এবং রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টার অপসারণের দাবি জানিয়েছিলেন। কুকিগোষ্ঠী মেইতি অধ্যুষিত এলাকায় ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে মণিপুরের পুলিশ দাবি করলেও কুকি সংস্থাগুলো এই অভিযোগ অস্বীকার করে মেইতি গোষ্ঠী ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে। মণিপুরে প্রথমবারের মতো এই ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে এবং রাজ্য সরকার উল্লেখযোগ্য হারে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে।

সরকারি তথ্যানুসারে, সংঘাতের পর থেকে এখন পর্যন্ত ২২৫ জনের প্রাণহানি হয়েছে এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মণিপুরের অনেক বাসিন্দাই প্রাণ বাঁচাতে পাশের রাজ্য নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মেঘালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। গত দেড় বছরের সহিংসতায় অন্তত ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গৃহহীন হয়েছেন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। নতুন করে দুই সম্প্রদায়ের ছড়ানো সংঘর্ষে বিজেপি সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

অস্থিতিশীলতার সুযোগে মণিপুরের বেশ কয়েকটি পুলিশ স্টেশন থেকে অন্তত চার হাজার অস্ত্র লুট হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগ বলছে, এ সকল অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ এখন কুকি ও মেইতে সম্প্রদায়ের হাতে। মণিপুরের চুরাচাঁদপুর ও কাংপোকপি জেলার গহীন জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী গোপন একটি অস্ত্রাগারের সন্ধান পেয়েছে। ১ জানুয়ারি থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মণিপুরের কাংপোকপি জেলায় অন্তত ৩৩টি অভিযান চালিয়ে সর্বাধিক সংখ্যক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। 
ভারতের মণিপুর  রাজ্যে চলমান অস্থিরতার পেছনে বিদেশী শক্তির হাত রয়েছে বলে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী এন. বিরেন সিং মন্তব্য করেছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মণিপুরের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ভারতীয় অস্ত্রের পাশাপাশি চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং মিয়ানমারের অস্ত্র ব্যবহার করছে। এর মধ্যে রয়েছে একে-৪৭, আইএনএসএএস, ৭.৬২ এমএম ও বিভিন্ন স্টেন কার্বাইন মেশিনগান।

এ ছাড়াও দুই সম্প্রদায়ের অস্ত্র ভা-ারে জার্মানির হেকলার অ্যান্ড কোচ, আমেরিকার কোল্ট এ-আর-ফিফটিন, এম-সিক্সটিন, এম-ফোর-এ-ওয়ান এবং চীনা এ-কে-ফিফটি সিক্স রাইফেল রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বিধ্বংসী বোমা, ড্রোন, হ্যান্ড গ্রেনেড, রকেট লঞ্চার, মর্টার শেল ও ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী বিভিন্ন অস্ত্র। কুকি ও মেইতেই সম্প্রদায়ের অস্ত্র পর্যালোচনা করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কালেক্টিভ অ্যাওয়ারনেস টু আনএক্সপ্লোডেড অর্ডন্যান্স নামের একটি সংস্থা। তাদের মতে, কুকি ও মেইতেদের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো চীন ও রাশিয়ার তৈরি। মণিপুরে ব্যবহার করা ড্রোনগুলো চীনের ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডিজেআইয়ের তৈরি বলে ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে। 
পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকায় রাজ্য সরকার পূর্ব ও পশ্চিম ইম্ফল, থৌবাল, বিষ্ণুপুর ও কাকচিং জেলায় ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মণিপুরের নাগা এলাকাতেও বিক্ষোভ ছড়িয়েছে। মেইতিরা প্রধানত হিন্দু এবং তাদের বেশিরভাগই রাজ্যের রাজধানী শহর ইম্ফল এবং এর আশপাশের এলাকায় বসবাস করে। অপরদিকে কুকিরা প্রধানত খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এবং পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বসবাস করে। ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো মেইতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে কুকি সম্প্রদায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মেইতি সম্প্রদায় আনুষ্ঠানিকভাবে উপজাতীয় মর্যাদা দেওয়ার দাবি তুলেছিল; কুকিরা তার প্রতিবাদ করে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, সহিংসতার ঘটনায় অসম রাইফেলস সম্প্রতি এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে।

ওই ব্যক্তি কুকি ন্যাশনাল আর্মির (বার্মা) ক্যাডার বলে জানা যায়। সশস্ত্র গোষ্ঠীটির অপর নাম কেএনএ-বি। পরে জানা যায়, ব্যক্তিটি মিয়ানমারের নাগরিক। তার বিরুদ্ধে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী শহর মোরেহ থেকে কুকি অধ্যুষিত জেলা চুরাচাঁদপুর পর্যন্ত জঙ্গলের ধারে অস্ত্র সরবরাহের জন্য নজরদারি মিশন চালানোর অভিযোগ রয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বর দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে দুই হাজার সদস্য বিশিষ্ট দুই ব্যাটালিয়ন কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী (সিআরপিএফ) মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, মণিপুরে চলমান সহিংসতা প্রশমনে সরকার একের পর এক উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দিয়েছে। এরপর ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ, তিন জেলায় কার্ফু ঘোষণা করা হয়েছে। নতুনভাবে দেশের কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 
মণিপুরে স্থায়ী শান্তি প্রচেষ্টায় আলোচনার টেবিলে বসার জন্য আনুষ্ঠানিক আহ্বান ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠায় সুনির্দষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনও রাজ্যে যাননি বা বিবৃতিও দেননি বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। মণিপুরের জনগণের জানমাল ও সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং সে কারণেই মণিপুরীদের মধ্যে ক্ষোভ তীব্র হচ্ছে। এ ঘটনাকে মণিপুরের ইতিহাসে ‘অন্ধকার সময়’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলেও তেমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কুকি সম্প্রদায় মনে করে, কয়েক দশক ধরে তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছে; যা জাতিগত উত্তেজনার অন্যতম কারণ। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিভাবে শোষিত হয়েছে বলেও তারা মনে করেন। পাহাড়ে বসবাসকারী এবং উপত্যকায় বসবাসকারীদের মধ্যে একটি অবিশ^াস রয়েছে। পাহাড়ে তুলনামূলকভাবে উন্নয়নমূলক কাজ খুব কম হয়েছে। আর উপত্যকায় অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে এবং কুকি সম্প্রদায় উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে মনে করেন।

আবার মেইতিরা মনে করেন, তারা পাহাড়ে জমি ক্রয় করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং কয়েক বছর ধরে মিয়ানমার থেকে কুকিদের অবৈধ অভিবাসন এই সংঘাতকে আরও বৃদ্ধি করেছে। মেইতিরা দাবি করেন, তারা একটি তফসিলি উপজাতির মর্যাদা চায়, যাতে তারা পাহাড়ে জমি কিনতে পারে। তারা মনে করেন, এই সরকারি পদবি ভারতের সংবিধানের অধীনে বিশেষাধিকার এবং ইতিবাচক পদক্ষেপের সুবিধা প্রদান করবে। মেইতিরা মনে করেন, কুকিরা মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে এসেছে। তারা পপি চাষ ও মাদকপাচারের সঙ্গেও জড়িত বলে অভিযোগ করেন। 
ভারতে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে সংবিধানে ‘শিডিউলড ট্রাইব’ স্বীকৃতির বিধান রয়েছে। সংবিধানে ‘শিডিউলড কাস্ট’ (ভারতে যারা মূলত দলিত বা হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে পরিচিত) এবং ‘শিডিউলড ট্রাইব’ ভারতের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। মণিপুরে মেইতিরা তফসিলি জাতিগোষ্ঠী বা ‘শিডিউলড ট্রাইব’ হিসেবে গণ্য না হওয়ায় সরকারি চাকরি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘সংরক্ষণ সুবিধা’র সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিগণিত হলেও মণিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় মেইতিদের ‘শিডিউলড ট্রাইব’ স্বীকৃতি দিলে অন্যান্য সংখ্যালঘু আদিবাসী গোষ্ঠীর জন্য ওই রাজ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। এই আশঙ্কা থেকে মেইতিদের ‘শিডিউলড ট্রাইব’ স্বীকৃতির বিরোধিতা করছে অন্য আদিবাসী সংখ্যালঘুরা। মেইতি সম্প্রদায় ‘শিডিউলড ট্রাইব’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হওয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল গত কয়েক বছর ধরে। ভারতের কেন্দ্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপিও তাদের এই দাবির পক্ষে ছিল সহানুভূতিশীল।

তাদের এই দাবিকে সমর্থন জানিয়েই মণিপুরে বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে বিজেপি সেখানে সরকারও গঠন করেছে। এর মধ্যে গত মাসে মণিপুর হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে মেইতিদের দাবি বিবেচনার নির্দেশ প্রদান করলে রাজ্যের অন্য আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। হাইকোর্টের আদেশের প্রতিক্রিয়ায় মণিপুরের অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ডাকা মিছিল থেকে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সিএনএন-এর তথ্যানুযায়ী, রাজ্য সরকার এবং প্রশাসনের বিভিন্ন পদে মেইতিদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো।

সেখানে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত সুবিধাদিও অন্য আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর তুলনায় তারাই বেশি উপভোগ করে। সম্প্রতি বিজেপি ক্ষমতা গ্রহণের পর সেখানকার হিন্দু ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। ২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ও সামরিক বাহিনীর অভিযানের ফলে সেখানকার আদিবাসী গোষ্ঠী চিন সম্প্রদায়ের অনেকে সীমানা পেরিয়ে মণিপুরে আশ্রয় গ্রহণ করে। মণিপুরের কুকিরা জাতিগতভাবে চীন সম্প্রদায়ের সমগোত্রীয় হওয়ায় ভারতে আশ্রয় নেওয়া এই সকল শরণার্থীর বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার অভিযান পরিচালনা করছে। তাই কুকিরা মনে করছে, তারা জাতিগত বিদ্বেষের শিকার।
আলোচনা সংকট সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হলেও সরকারের তরফ থেকে জাতিগত কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গেই আলোচনার উদ্যোগ নেই। আবার মেইতি-কুকি-জোমিদের মধ্যেও আলোচনায় বসার লক্ষণ নেই। নাগা জনগোষ্ঠী কোনো দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না। তবে তাদের অভিযোগ হচ্ছে, কেন্দ্র সরকার ও রাজ্য সরকার কেউই তাদের প্রতি আন্তরিক নয়। ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম মনে করেন, এটি জাতিগত নির্মূলের শুরু মাত্র। ইম্ফলে কার্যত কোনো কুকি-জোমি নেই এবং কুকি-জোমি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে কোনো মেইতিও নেই। মণিপুরে কার্যত কোনো প্রশাসন নেই।

বিরেন সিংয়ের সীমাহীন অদক্ষতা ও পক্ষপাতদুষ্ট শাসনব্যবস্থার কারণেই অশান্ত হয়ে উঠেছে মণিপুর। সন্দেহ, প্রতারণা ও জাতিগত সংঘাতের জালে মণিপুর আটকে পড়েছে। এ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখা ও সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনা করা কখনোই সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এটি আরও অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের নির্মমতা ও বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারের অযোগ্যতার কারণে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন, মণিপুরে যাওয়া মানে চাঁদের অন্ধকারের দিকে যাত্রা করার মতোই বিপজ্জনক।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের অতীতের সরকারগুলো সংঘাতের মূল কারণটির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে। নয়াদিল্লিতে ক্ষমতায় থাকা শাসকরা ঐতিহাসিকভাবে বিষয়টিকে নিয়ে অবহেলা করে এসেছেন বলে কয়েক দশক ধরেই সেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম চলে আসছে। ভারত সরকারের উচিত ছিল বিভিন্ন জাতিকে একত্র করা এবং নিশ্চিত করা যে, সেখানে আস্থা তৈরির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

লেখক :  সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×