ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

এইচএসসির ফল ॥ ব্যতিক্রমী মূল্যায়ন

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২১:০৯, ২০ অক্টোবর ২০২৪

এইচএসসির ফল ॥ ব্যতিক্রমী মূল্যায়ন

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী সাড়ে ১৩ লাখ ৩১ হাজার ০৫৮ জন

দেশে এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী সাড়ে ১৩ লাখ ৩১ হাজার ০৫৮ জন। তাদের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে দফায় দফায় স্থগিত করা হয় পরীক্ষা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে ওই সরকার পতনের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন এলাকার থানায় হামলা হয়। সেসব থানায় প্রশ্নপত্রের ট্রাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে শিক্ষা বোর্ড জানায়, ১১ আগস্টের পরিবর্তে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে।

কিন্তু দেশের সচিবালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও পরীক্ষার ফল কীভাবে নির্ধারণ ও প্রকাশ করা হবে, সে বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেদিন জানানো হয়নি। তবে শিক্ষা উপদেষ্টা এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন যে, পরীক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে টেস্ট ও প্রি-টেস্টের মূল্যায়নপত্র নেওয়া হবে। 
যদিও কীভাবে ফল প্রকাশ করা হবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে শিক্ষা বোর্ড। যদি স্থগিত পরীক্ষাগুলোর বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়নপত্র প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নিয়ে ফল তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সহজ ও সুষ্ঠু উপায়ে মূল্যায়নপত্র প্রদান করে তা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি ভবিষ্যতে পরীক্ষা কার্যক্রমসহ শিক্ষাঙ্গন দ্রুত স্বাভাবিক করতে হবে। নয়তো তাদের উচ্চ শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শিক্ষার্থীদের উচিত এখন লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়া। এইচএসসির স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, এরই মধ্যে সম্পন্ন হওয়া পরীক্ষা এবং স্থগিত বিষয়ে এসএসসির সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে (ম্যাপিং) এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হোক।
এ ভাবেই যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি, সেগুলোর ফল প্রকাশ করা হয় এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে। এ প্রক্রিয়ায় একজন পরীক্ষার্থী এসএসসিতে একটি বিষয়ে যত নম্বর পেয়েছিলেন, এইচএসসিতে সেই বিষয় থাকলে তাতে এসএসসিতে প্রাপ্ত পুরো নম্বর বিবেচনায় নেওয়া হয়। আর এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার বিষয়ে ভিন্নতা থাকলে বিষয় ম্যাপিংয়ের নীতিমালা অনুযায়ী নম্বর বিবেচনা করে ফল প্রকাশ করা হয়েছে।
ফল বিশ্নেষণে দেখা যায় যে, চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সাতটি বিষয় ছাড়া বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা না হলেও এবার পাসের হার কমেছে ০.৮৬ শতাংশ। তবে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের চেয়ে এবার ৫৩ হাজার ৩১৬ জন বেড়েছে। তাদের মধ্যে এগিয়ে মেয়েরা। সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল প্রকাশের কারণে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান।

তিনি জানান, অংশগ্রহণকারী ৬ লাখ ৬৬ হাজার ১৩ জন ছাত্রের মধ্যে ৫ লাখ ৩ হাজার ৫৯৫ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। ছাত্রদের পাসের হার ৭৫ .৬১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৪ হাজার ৯৭৮ জন। অন্যদিকে ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫ জন অংশগ্রহণকারী ছাত্রীর মধ্যে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৭১৪ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। ছাত্রীদের পাসের হার ৭৯. ৯৫ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৮০ হাজার ৯৩৩ জন।
এ বছর সব শিক্ষা বোর্ডে ছাত্রের চেয়ে ৪ .৩৪ শতাংশ ছাত্রী বেশি পাস করেছেন। একই সঙ্গে ১৫ হাজার ৯৫৫ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছেন। ২০২৩ সালে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ছিলেন ৯২ হাজার ৫৯৫ জন। এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। চলতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার গত বছরের তুলনায় কমেছে। এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। চলতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার গত বছরের তুলনায় কমেছে। এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। গত বছর গড় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক।
প্রকাশিত ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এবার পাসের হারে সবচেয়ে এগিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং সবচেয়ে পিছিয়ে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড। এ দুই শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার যথাক্রমে ৯৩ দশমিক ৪০ ও ৬৩ দশমিক ২২ শতাংশ। এছাড়া ঢাকা বোর্ডে ৭৯ দশমিক ২১, রাজশাহী বোর্ডে ৮১ দশমিক ২৪, কুমিল্লা বোর্ডে ৭১ দশমিক ১৫, যশোর বোর্ডে ৬৪ দশমিক ২৯, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৭০ দশমিক ৩২, বরিশাল বোর্ডে ৮১ দশমিক ৮৫, সিলেট বোর্ডে ৮৫ দশমিক ৩৯, দিনাজপুর বোর্ডে ৭৭ দশমিক ৫৬ ও কারিগরি বোর্ডে ৮৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।

অন্যদিকে এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে মেয়েরা জিপিএ ৫ পেয়েছে ৮০ হাজার ৯৩৩ জন এবং ছেলেরা ৬৪ হাজার ৯৭৮ জন। বোর্ডভিত্তিক জিপিএ ৫-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার ঢাকা বোর্ডে ৪৮ হাজার ৫৪৮, রাজশাহী  বোর্ডে ২৪ হাজার ৯০২, চট্টগ্রাম বোর্ডে ১০ হাজার ২৬৯, বরিশাল বোর্ডে ৪ হাজার ১৬৭, সিলেট বোর্ডে ৬ হাজার ৬৯৮, কুমিল্লা বোর্ডে  ৭ হাজার ৯২২, যশোর বোর্ডে ৯ হাজার ৭৪৯, দিনাজপুর বোর্ডে ১৪ হাজার ২৯৫, ময়মনসিংহ বোর্ডে ৪ হাজার ৮২৬, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ৯ হাজার ৬১৩, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৪ হাজার ৯২২ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে।
এছাড়া এবার শতভাগ পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শতভাগ ফেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে। এ বছর দেশের ১ হাজার ৩৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর শতভাগ পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৯৫৩। সেই হিসাবে এবার শতভাগ পাস করা কলেজের সংখ্যা বেড়েছে ৪৩৫টি। অন্যদিকে, এ বছর ৬৫টি কলেজ থেকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কেউ পাস করতে পারেনি। ২০২৩ সালে শূন্য পাস করা কলেজের সংখ্যা ছিল ৪২টি। সেই হিসাবে এবার শূন্য পাস কলেজের সংখ্যা বেড়েছে ২৩টি।

এবার পাসের হার কমে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি বলেন, ‘উচ্চ মাধ্যমিক পাসের হারটি মূলত নির্ভর করে ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ের ওপর। কিছু পরীক্ষা বাতিল হলেও এ দুটি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছিল। এ কারণে অন্যান্য সময়ে পরীক্ষা বাতিল হলে পাসের হার বেড়ে যাওয়ার যে প্রবণতা দেখা যায়, এবার তা হয়নি, স্বাভাবিক সময়ের মতো হয়েছে।’
সরকার স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটি জরিপ পরিচালনা করতে পারত। জেলা প্রশাসন ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর মাধ্যমে আহত শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা যেত। এ বিকল্প ব্যবস্থা ম্যাপিং ছাড়াও অন্য কিছু হতে পারত। যেমনÑ সাবজেক্ট ভিত্তিতে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া। যেটা করোনাকালে করা হয়েছিল শিক্ষার্থীর পড়ালেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। তারপরও দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখায় ছন্দপতন হয়েছিল। যারা পরবর্তী সময়ে আর সেভাবে পড়ালেখায় মনোযোগী হতে পারেনি।

তাই পুনরায় এ পথে হাঁটা কতটা যথোচিত তা নিয়ে নানা সমালোচনা চলছে। অবশ্য, স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এ নিয়ে আরও অনেক আলোচনা ও চিন্তার অবকাশ ছিল এ কথা শিক্ষা উপদেষ্টা নিজেও স্বীকার করেছেন। তবে সচিবালয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে। উপরন্তু, পরীক্ষা হওয়া ও না হওয়া নিয়ে এক ধরনের বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তখনো স্বাভাবিক হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে পরীক্ষা না হওয়াটাই সমীচীন বলে মনে করেছে কর্তৃপক্ষ।

উপদেষ্টার এসব কথা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা যায় না। তবে কেউ যেন অবমূল্যায়নের শিকার না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা কিভাবে নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে ভাবা উচিত এবং সে মোতাবেক ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করা উচিত। রাজনৈতিক ট্রমা থেকে বেরিয়ে পড়ালেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে শিক্ষার্থীদের। তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ যাতে ব্যাহত এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

তাছাড়া ভবিষ্যতে আবারও বিরূপ পরিস্থিতি হলে ম্যাপিং বা অটোপাসের বাইরে আর কী করা যায়, সে বিষয়েও প্রস্তুতি থাকা উচিত। এখন অভিভাবকরা ভাবছেন তাদের ছেলেমেয়েরা এই রকম একটি সমস্যা সংকুল দেশে কিভাবে সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকবে এবং যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বিকল্প হিসাবে বিদেশের কথা ভাবছে।  যা দেশের জন্য কতটুকু সুফল বয়ে আনবে, তাও ভেবে দেখার মতো।

    লেখক : গবেষক ও শিক্ষাবিদ

×