ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ২১:২৩, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক

কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু বলে কোনো কথা নেই। বিশ্বের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এটি স্বতঃসিদ্ধ। আজ যে বন্ধু কাল সে শত্রু ভাবাপন্ন হবে, এটি স্বাভাবিক। সময়ের ব্যবধানে বদলে যায় সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি। পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম প্রধান পরাক্রমশালী একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতও পৃথিবীর বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকৃত। শক্তি বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও দেশটির প্রতি পৃথিবীর সব দেশেরই একটা আগ্রহ রয়েছে। প্রসঙ্গত দুটো দেশের বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে কিছু আলোকপাত করতে চাই। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। যুগ যুগ ধরে বিশে^ ২টি পরাশক্তির দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের নাম বিবেচিত হয়ে আসছিল।

বিশ্ব রাজনীতিতে এ দুটো পরাশক্তি পরস্পর বিরোধী ভূমিকায় অবস্থান করে থাকত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর অনেকটা একক পরাশক্তির মূর্তিতে বিশ^ কাঁপিয়ে রাখত যুক্তরাষ্ট্র। তখন থেকেই বিশে^ যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী যুগের সূচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত আধিপত্য বিস্তারে লক্ষ্য স্থির করে এগোতে থাকে। অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও মূল ভূখ- রাশিয়া শক্তি-সামর্থ্য অর্জনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আজকের দিনে রাশিয়াও পরাশক্তির দেশ হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। 
দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তির গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের গতি-প্রকৃতিটা অনেকটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দৃশ্যমান। এ দুটো দেশের সম্পর্কের একটা ঐতিহাসিকতা রয়েছে। সেটা স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শুধু সাম্প্রতিক সম্পর্কের চিত্রটা তুলে ধরতে চাই। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বহুমাত্রিক। দুটো দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ছন্দপতন ঘটলেও বর্তমানে খুবই চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান। আসছে ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে।

নির্বাচনে জয়লাভ করে যিনিই অধিকর্তা হোন না কেন, তাতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কোনো হেরফের ঘটবে না। সাম্প্রতিক বিশ^ ব্যবস্থায় ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ককে স্থিতিশীল মর্যাদার প্রশ্নে ভারতকেই এগিয়ে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ^বাণিজ্য তথা অগ্রসরমান অর্থনীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হচ্ছে চীন। এক সময় চীন আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। কিন্তু এখন সে অবস্থা নেই। ভূরাজনীতির প্রতিযোগিতায় চীন যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করে।

প্রশান্ত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের আধিপত্য বিস্তারে চীনকে পরাস্ত করতে হলে ভারতকে খুব বেশি প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। এদিকে ভারত ভূরাজনীতির খেলায় নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন। কৌশলগত সুবিধার কথা মাথায় রেখে ভারত-আমেরিকার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে পিছপা হবে না। তদুপরি চীন সব সময়ই ভারতের বিরোধী অবস্থানে রয়েছে। যদিও ভারত-চীনের যে সমস্যা, তা আলোচনার ভিত্তিতেই সমাধানযোগ্য। কিন্তু চীন সে পথে না হেঁটে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে তৎপর রয়েছে। যেটা ভারতের মোটেও পছন্দের নয়। অঙ্কটা এখানেই জটিল আকার ধারণ করছে।

এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে ফাটল ধরেছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এ দুটো দেশের মতভেদের বিষয়টি আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। বদ্বীপ বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কথা কারও অজানা নয়। কিন্তু ভারতকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার সম্ভব কিনা, সেটা তারা ভাবনায় নিয়েই কাজ করবে। শেখ হাসিনার সরকার সুদীর্ঘকাল একটানা শাসন করেছেন। তার শাসনকালে সীমাহীন দুর্নীতির কথা চাপা থাকেনি।

জনমনে চরম অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও ভারত আওয়ামী লীগকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছে। যে জন্য এ দেশের মানুষ ক্রমশ ভারতবিরোধী হয়ে উঠতে থাকে। হাসিনার শাসনকালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই মধুর ছিল বলে প্রচার করা হয়েছে। আসলে সে সম্পর্কটা ছিল অনেকটা ফাঁপা বেলুনের মতো। এ দেশের জনগণের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে তেমন কোনো গ্রহণযোগ্য কূটনীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। দুই দেশের সম্পর্ক কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল। পারস্পরিক দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে না পারলে কখনো স্থায়িত্ব লাভ করে না।

সে জন্যই হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেরও কিছুটা অবনতি ঘটেছে। সাম্প্রতিক বিশ^ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শক্তিশালী করা খুবই জরুরি। এ উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখে চলার নীতি গ্রহণ করতে হবে। আধুনিক সভ্যতা বিকাশে কোনো দেশই এককভাবে চলতে পারে না। বিশেষত প্রতিবেশীর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ককে সমতা ও ন্যয্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

যা হোক, বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে কোনো টানাপোড়েন তৈরি হবে, সেটি বিশ^াসযোগ্য নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ভারতের তরুণ তুর্কিদের চোখে যে স্বপ্নের ঝিলিক ছিল, তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছিল। ভারতের সবুজ বিপ্লবে যুক্তরাষ্ট্র বিস্ময়কর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রবহমান সম্পর্ক এগিয়ে নিতে উভয়ে ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। বিশেষত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহজভাবে নিতে পারেনি।

এর আগে প-িত জহরলাল নেহেরুর জোটনিরপেক্ষ নীতিকে আমেরিকা মেনে নিতে পারছিল না। তখন থেকেই দুই দেশের সম্পর্কে ভাটা পড়ে। এমনি পরিস্থিতিতে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। ঐতিহাসিক নানা ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে গতি-প্রকৃতির বদল ঘটে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ভারত অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে হয়ে ওঠে বলীয়ান। কৌশলগত কূটনীতির আলোকে ভারতীয় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে ভারত অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।

ভারত হয়ে ওঠে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। দেশটির ক্ষমতার পালা বদল ঘটলেও রাষ্ট্র দর্শনের কোনো পরিবর্তন হয় না। দীর্ঘদিন ভারত শাসন করে ভারতীয় কংগ্রেস, পরবর্তীতে ইন্দিরা কংগ্রেস। ২০১৪ সালে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ক্ষমতাসীন হলে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন নরেন্দ্র মোদি। মোদিকে যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম অভিনন্দন জানায়। অথচ গুজরাট দাঙ্গার অভিযোগে মোদিকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। মোদি ক্ষমতায় এসেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান।

দুই দেশের কৌশলগত সহযোগিতা বেড়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে ঘোষণা করে। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্য কোয়াড এবং আই-২, ইউ-২ গ্রুপের মতো বহুপক্ষীয় গোষ্ঠীর মধ্যেও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে থাকে। বর্তমান, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক উপভোগ করছে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সৃষ্টকৃত অপরাধ দমনে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। ভারতীয়রা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের অনুকূলে বিবেচনা করছে।

২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় দুই দেশ ‘বিস্তৃত বৈশি^ক কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।’ উভয়ের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল স্যাটেলাইট ডেটা ভাগ করার জন্য একটি সামরিক চুক্তিও স্বাক্ষর করে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইঊঈঅ-এর ওপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অরুণাচল প্রদেশে সংঘর্ষের সময় চীনকে পরাজিত করতে সাহায্য হিসেবে চখঅ সৈন্যদের রিয়েল টাইম অবস্থানের তথ্য সরবরাহ করে। সম্পর্কের ধারাবাহিকতা এখনো বজায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক বাংলাদেশ ইস্যুতে কখনো খারাপ হবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। 
বর্তমানে বিশ^ রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। লেবানন-ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে ইরান মিশাইল নিক্ষেপ করেছে। ইসরাইলও ইরানকে আক্রমণের জন্য সীমাহীন প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। ইসরাইলের সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছে। ইরান ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে। ভারত কোন্ দিকে যাবে? ইরান ও ইসরাইল দুটি দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক ভাল।

ভারত এখন তার কূটনৈতিক কৌশলকে কাজে লাগিয়ে দুটো দেশকেই খুশি করতে তৎপর রয়েছে। ভারত কোনোক্রমেই মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে কোনো পক্ষ অবলম্বন করবে না। অন্যদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধও বিশ^বাসীকে ভাবিয়ে তুলছে। সব মিলিয়ে মানুষের মনে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের শঙ্কা কাজ করছে। এই যুদ্ধ এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত ঐকমত্যের ভিত্তিতে মানবসভ্যতা বাঁচাতে পারে বলে বিশ^বাসী বিশ^াস করে। ভারতীয় দর্শন কোনো অন্যায় যুদ্ধকে সমর্থন করে না। বিশে^র মনুষ্য সমাজ শান্তিময় বিশ^ দেখতে চায়। তাই বিশ^ নেতাদের মতভেদ ভুলে সৃষ্টকৃত সমস্যা সমাধানে গ্রহণযোগ্য ঐকমত্য ও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। 
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

×