ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১

চা শ্রমিকদের মানবেতর জীবন

মাহমুদুল হাসান

প্রকাশিত: ২১:১৬, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

চা শ্রমিকদের মানবেতর জীবন

বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের জীবন

বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের জীবন এক অবর্ণনীয় দুঃখ ও বঞ্চনার প্রতীক। শতবর্ষ ধরে তারা চা বাগানগুলোতে কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে। কিন্তু তাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরি ও মৌলিক অধিকার এখনো অনিশ্চিত। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য বারবার আন্দোলন করে তারা আজও তাদের ন্যায্য অধিকার পায়নি। আজও যৎসামান্য মজুরিতে অমানবিক দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করছে তারা। সকাল-সন্ধ্যার নাস্তায়, বন্ধুদের আড্ডায়, মিটিংয়ে কিংবা মেহমান আপ্যায়নে, চা যেন বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

গরম ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা দিয়েই আমাদের দিন শুরু হয়। চা’কে আমাদের জাতীয় পানীয় বললে খুব একটা ভুল হবে না। চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা আপনি হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না এক কাপ চা তুলে দেওয়ার পেছনে চা-শ্রমিকদের কতটা অমানুষিক পরিশ্রম ও মানবেতর জীবনযাপনের করুণ কাহিনী রয়েছে। ঘরের পুরনো চালের ফুটো দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। একপাশে মাটির ওপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছে অসুস্থ সন্তান। হাঁড়িতে এক কেজি চাল আর আলু সিদ্ধ হচ্ছে। ৯ জনের পরিবারের রাতের খাবার এটুকুই।

শেষবার মাংস জুটেছিল আট মাস আগে। ১৭০ টাকার মজুরিতে মাংস যে বিলাসিতা। এই গল্প মৌলভীবাজারের কোনো এক চা-শ্রমিক পরিবারের। শুধু একটি পরিবার নয়, বাংলাদেশের প্রায় সকল চা-শ্রমিক পরিবারই এমন মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের সবার জীবনই এক দীর্ঘ সংগ্রামের গল্প, যা আমাদের অধিকাংশের কাছে অদেখা, অচেনা।

বাংলাদেশ চা বোর্ড এর তথ্যমতে, দেশে সব মিলিয়ে চা বাগান ২৫৬টি। এর মধ্যে বাণিজ্যিক চা বাগানের সংখ্যা ১৬৮টি। এই সকল চা বাগানে নিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩ হাজারের বেশি। ২০২১ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশের চা শিল্পের বাজার প্রায় ৩৫০০ কোটি। চা শিল্প বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে ১ শতাংশ অবদান রাখছে। দেশে চা শিল্পের সূচনা মূলত ব্রিটিশদের হাত ধরে। ১৮৩০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশ, মাদ্রাজ, ওড়িশা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চল থেকে প্রায় ১১৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা।

কালের বিবর্তনে তারা এ দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। তাদের কিছু অংশ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের হয়ে মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের নাগরিক হয়েও তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা তারা ভোগ করতে পারে না। শ্রমিক হিসেবে দৈনিক ন্যূনতম ২০ কেজি চা পাতা সংগ্রহের শর্তে একজন চা-শ্রমিক ১৭০ টাকা মজুরি পায়। ২০ কেজির বেশি চা পাতা সংগ্রহ করলে বাড়তি প্রতিকেজির জন্য দেওয়া হয় মাত্র দুই টাকা। অপরদিকে ২০ কেজির কম চা পাতা সংগ্রহ করলে, কম হওয়া প্রতিকেজি চা পাতার জন্য ছয় টাকা কেটে রাখা হয়। অসহনীয় দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে এই অর্থ নিতান্তই নগণ্য। 
২০২২ সালের আগে চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল ১১৮ টাকা। ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে ২০২২ সালে আন্দোলনের ডাক দেয় চা-শ্রমিক নেতারা। পরবর্তীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারিত হয়। চা-শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাগান মালিকরা দাবি করেন, দৈনিক মজুরির পাশাপাশি এসব শ্রমিকের রেশন, বোনাসসহ নানা সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। বাগান মালিকদের মতে, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধাসহ একজন শ্রমিক দৈনিক ৪৫০-৫০০ টাকা উপার্জন করেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। চা-শ্রমিকদের মতে, সকল সুযোগ সুবিধার আর্থিক মূল্য কোনোভাবেই ৩৫০-৪০০ টাকার বেশি নয়। বাগান মালিকদের মতে, প্রত্যেক চা-শ্রমিককে আবাসিক সুবিধা, ফ্রি চিকিৎসা ও প্রায় ৪৬ কেজি রেশন প্রদান করা হয়।

এ ছাড়াও প্রতি কেজি বাড়তি চা পাতা সংগ্রহের জন্য বাড়তি বোনাস ও বিভিন্ন ভাতা প্রদান করা হয়। অপরদিকে চা-শ্রমিকদের মতে, যারা চা বাগানে ঘরের আশপাশে খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য শাকসবজি চাষ করেন, সেসব শ্রমিককে রেশন প্রদান করা হয় না। চা বাগানের অভ্যন্তরে সামান্য অর্থের বিনিময়ে আবাসন সুবিধা প্রদান করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। এ ছাড়াও ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মেরামতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চায় না কর্তৃপক্ষ।
চা-শ্রমিকদের জন্য ফ্রি চিকিৎসাসেবার কথা বলা হলেও এর মান যথেষ্ট বাজে এবং প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। চা-শ্রমিকদের অভিযোগ, এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে যথাযথ সেবা প্রদান করা হয় না ও সার্বক্ষণিক চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলস্বরূপ, পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে চা-শ্রমিকরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। এক জরিপে দেখা যায়, সিলেট ও মৌলভীবাজারের মোট যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীর ৩৬ শতাংশ চা-শ্রমিক। 
চা বাগানের মালিকরা চা-শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন বলে দাবি করলেও মূলত চা বাগানগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার পর আর পড়াশোনার সুযোগ নেই বললেই চলে। কিছু এনজিও নিজ উদ্যোগে শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছে, তাও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এর ফলে চা-শ্রমিকদের বেশিরভাগ সন্তানই প্রাইমারির পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না।

এ ছাড়াও এত কম উপার্জনে সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। অনেক চা-শ্রমিকই বাড়তি উপার্জনের আশায় অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদেরও চা পাতা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করে। এভাবে পরবর্তী প্রজন্মও চা-শ্রমিক হিসেবেই বড় হয়। দারিদ্র্যের গোলকধাঁধায় থেকেই কেটে যায় তাদের বাকি জীবন। 
চা বাগানগুলোতে নারীরা চরম বৈষম্যের শিকার হয়। বাংলাদেশের মোট চা-শ্রমিকের প্রায় ৬৪ শতাংশই নারী। তাদের বেশিরভাগই অপুষ্টিতে ভোগে এবং পর্যাপ্ত সেনিটেশন ও নিরাপদ মাতৃত্বের সুবিধা পায় না। নারী চা-শ্রমিকদের মাত্র চার মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা যায়, চা বাগানগুলোতে বাল্যবিয়ের হার প্রায় ৪৬ শতাংশ এবং ১৮ বছরের আগেই মা হয় ২২ শতাংশ কিশোরী। এ ছাড়াও অপুষ্টির কারণে চা বাগানের প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু খর্বকায়, ২৭ শতাংশ শীর্ণকায় ও স্বল্প ওজনের শিশু ৪৭.৫ শতাংশ। 
শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ নানা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চা-শ্রমিকরা। বছরের পর বছর ধরে নামমাত্র মজুরিতে অমানুষিক পরিশ্রম করে যাচ্ছে মানুষগুলো। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে একটানা কাজ করেই যাচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই, ২০ কেজি পাতা সংগ্রহ করতে হবে, নইলে যে নির্ধারিত ১৭০ টাকাও পাওয়া হবে না। এ যেন নব্য দাসত্ববাদ। 
সময় হয়েছে এই মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবার। দেশজুড়ে যে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে, তাতে যেন এই মানুষগুলোর ভাগ্যেরও পরিবর্তন হয়। সরকারের উচিত, চা বাগান মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ন্যূনতম ৩০০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা। পাশাপাশি, চা-শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা। প্রতি বছর চা রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আমরা অর্জন করছি, তার বড় কৃতিত্ব চা-শ্রমিকদের। দাসত্ব নয়, চা-শ্রমিকদের প্রাপ্তি হওয়া উচিত যথাযথ সম্মান ও অধিকার। 

লেখক : সমাজকর্মী

×