ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১

নারীর প্রতি সহিংসতা

ড. মো.শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২১:১৪, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

নারীর প্রতি সহিংসতা

নারীর প্রতি সহিংসতা

নয় বছর বয়সী মেয়েশিশুটির জীবনের ওপর দিয়ে কি ধকল যাচ্ছে। প্রস্রাব করার জন্য লাগানো হয়েছে ক্যাথেটার। মল ত্যাগের জন্য আলাদা রাস্তা বানিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কোনো কুলাঙ্গার ও অমানুষ কর্তৃক মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলেই আজ মেয়েটির এই অবস্থা।  চিকিৎসকরা বলেন, ধর্ষণের কারণে মেয়েটির মলত্যাগ ও মাসিকের রাস্তা এক হয়ে গেছে। এখন তারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা মেরামত করার চেষ্টা করছেন। কী নির্মম মানুষ! এভাবে একটি শিশু মেয়েটিকে বিধ্বস্ত করার মতো মনমানসিকতা কোনো সুস্থ মানুষের থাকার কথা না।

যে করেছে সে সমাজের এক নরপশু। শুধুই কি মেয়েটির শারীরিক কষ্ট হচ্ছে, তা নয়, মানসিক আঘাতও মারাত্মক। মেয়েটি যে ট্রমার মধ্যে আছে, তা নিয়ে তাকে হয়তো জীবনভর ভুগতে হবে। ঘটনাটি ১২ অক্টোবর রাতের। কিন্তু মেয়েটি লোকটির পরিচয় দিতে পারছে না। ভবিষ্যতে মেয়েটি কী কী শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে, তা এখনই বলতে পারছেন না চিকিৎসকরা। মেয়েটির পুরোপুরি সুস্থ হতে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। কিন্তু ধর্ষণকারী এখনও শনাক্ত হয়নি, গ্রেপ্তারও হয়নি। অতি দ্রুত এই নরপশুকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদ- দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

গতবছর ভারতের মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়ীন শহরে এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। এই নির্যাতনের ঘটনা ছিল আরও নির্মম। কারণ, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ১২ বছর বয়সী ওই কন্যাশিশুটি রক্তাক্ত এবং অর্ধনগ্ন অবস্থায় নানা লোকের কাছে সহায়তা চাইছে। তবে সবাই তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ তাকে রক্ষা করতে আসেনি। কি দুর্ভাগ্য আমাদের! আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের মতো অবস্থা। ওই সময় তৎকালীন আরবের অবস্থা ছিল বিশৃঙ্খল, স্থিতিহীন ও নৈরাজ্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে নারী ও শিশুদের ওপর যৌন নিগ্রহের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

তবে বাংলাদেশের নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের মতো ঘটনা নেহাত কম নয়। ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটের রামপালে ৯ম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তিন যুবক ওই ছাত্রীকে একটি মৎস্যঘেরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালায় বলে অভিযোগ ওঠে, যা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এভাবে প্রায়ই অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অনেকেই নীরবে সহ্য করে যায় লোকলজ্জার ভয়ে। আর কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। 
গত ৮ মাসে দেশে ৪৯৩ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। উক্ত সময়ে ১০১ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। যাদের মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৩২২ জন, গণধর্ষণের শিকার হয় ৭২ কন্যাশিশু, প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু রয়েছে ৩৯ জন। প্রেমের ফাঁদে ফেলে ৭০ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও চলতি বছরের গত ৮ মাসে মোট ৩২৯ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই সময়কালে পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ৩০ জন কন্যাশিশু। 
এছাড়াও দেশে ২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ৩৬০ জন নারী। তাদের মধ্যে ৪৫০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। একই সময়ে সারদেশে সহিংসতার শিকার হন ৯ হাজার ৭৬৪ জন নারী। আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৩ উপলক্ষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লাইটহাউস এ সব তথ্য প্রকাশ করেছে। যা খুবই ভয়াবহ। প্রশ্ন হলো, কেন ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা বারবার ঘটে। সঠিক বিচার হলে এসব বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বা সামাজিক অবক্ষয় এজন্য অনেকাংশে দায়ী।

দেশে ধর্ষণের ঘটনাও উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। গত বছর ধর্ষণের মামলা হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি। তার আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার বেশি (৬ হাজার ৩২টি)। যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার ক্ষেত্রে সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি পর্নোগ্রাফিও বড় একটি কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।   
সোশ্যাল মিডিয়াসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে যেভাবে ধর্ষণ নামে নৃশংস ঘৃণ্য বর্বরোচিত ঘটনা দেখতে পাই, যা করোনাভাইরাস বা ডেঙ্গুর চেয়ে ভয়াবহ। ধর্ষণের ঘটনা এতই বেড়ে চলেছে যে, যা আমাদের বাকরুদ্ধ করে ফেলছে। সমাজে সবাই সুখ,শান্তি এবং নিরাপদে থাকতে চায়। কিন্তু কিছু মানুষরূপী অমানুষের কারণে শান্তি এখন বিনষ্ট হচ্ছে। এখান থেকে উত্তরণ না হলে ভবিষ্যতে আরও খারাপ হতে পারে। বর্তমানে চাচা ভাতিজিকে, শিক্ষক তার ছাত্রীকে ধর্ষণের কথা শুনতে হয়, যা খুবই দুঃখজনক। কোনো ধর্ষণই কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্ষণ সমাজে একটি মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।

এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, স্ত্রীকে আরও সচেতন করতে হবে। সব নারীকে সাহস দিতে হবে যে, আমরা তাদের বিপদে পাশে আছি। কারণ, তারা খুবই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ধর্ষণরোধে পরিবারেরও দায়িত্ব রয়েছে। ছেলেমেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কি করছে এবং কার সঙ্গে চলাফেরা করছেÑ এসব বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে। অন্যথায় তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।     
বর্তমানে ধর্ষণ নারীদের জীবনেও কালো মেঘের ছায়া হিসেবে হানা দিয়েছে। ধর্ষণ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে, যাতে নারীরা সমাজে নিরাপদ থাকতে পারে। পুরুষ হিসেবে এই বিষয়ে সবাইকে সজাগ এবং সতর্ক করতে হবে, যাতে সমাজে কেউ ধর্ষণের মতো ঘটনা সংঘটিত করার সাহস না পায়। অবশ্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ধর্ষণ বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।  
দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের পিছনে কারণগুলো হচ্ছেÑ নিরবচ্ছিন্ন যৌন ইচ্ছা, যৌন হতাশা, পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ, নারীকে দুর্বল মনে করা, শক্তির প্রকাশ, ক্ষমতার রাজনৈতিক দাপট, প্রতিশোধ, ধর্মীয়  মূল্যবোধ, সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক বন্ধন ও মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি। এছাড়াও ধর্ষণের পেছনে আরও কারণ রয়েছে। যেমনÑ ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার না করা, যৌনশিক্ষা এবং ন্যায়বিচারের অভাব।

সমাজবিজ্ঞানী, আইনজীবী এবং মাঠপর্যায়ের অপরাধ তদন্তকারীরা ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জঘন্যতম ঘটনা ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য অপরাধমূলক বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি, অপরাধীদের জামিন দেওয়া, মাদকাসক্তি এবং বেকারত্বকে দোষারোপ করেছেন। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক অবক্ষয় ছাড়াও এ জাতীয় অপরাধ ক্রমশ বাড়ছে। কারণ, সমাজের কোনো অংশই তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না বলে মনে করি। 
ধর্ষণ বন্ধে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নীতিশাস্ত্রের অধ্যয়নকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সামাজিক তদারকি ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। আইন প্রয়োগ আরও কার্যকর এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আইন প্রয়োগকারী বাহিনীদের সদসদের ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন বন্ধে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা, লিঙ্গ সংবেদনশীলতা এবং আইনি সচেতনতা অপরিহার্য। ধর্ষিতাকে ক্ষতিগ্রস্তের পরিবর্তে ধর্ষককে কলঙ্কিত করা দরকার। এছাড়াও দরকার আইনের সুশাসন।

প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে জনসম্মুখে এসব নরাধম পশুর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। অন্যথায়, ধর্ষণ ব্যাধি বন্ধ করা যাবে বলে মনে হয় না।  আমরা চাই এসব অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি শীঘ্রই বাস্তবায়ন হোক। অপরাধীদের আইনের মুখোমুখি করার জন্য সরকারকে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। 

লেখক :  সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

×